আজ তিন জনের কথা, এই তিনজনের নাম পাশাপাশি রাখা যায় না, এক উচ্চারণে তিন জনের নাম নেওয়া যায় না, কিন্তু ঠিক এই সময়ে বাংলা, বাঙালি মনন, বাংলার সংস্কৃতির ওপর যে ভাবে আক্রমণ নেমে আসছে, তাতে মনে হল এখনই এই তিনজনকে নিয়ে কিছু বলা উচিত। প্রথমজনকে নিয়ে মেদিনীপুরের মানুষ ছড়া বেঁধেছেন,– চোর চোর চোরটা, শিশিরবাবুর ছেলেটা… তাঁদের ছড়ার মর্যাদা দিতে, কয়েকদিন আগেই ত্রিপল কেলেঙ্কারি ঘটে গেলো। হ্যাঁ, আমি বোতলের অধিকারী নয়, শিশির বাবুর জ্যেষ্ঠ সন্তান শুভেন্দু অধিকারীর কথা বলছি, তো তিনি পড়াশুনো করে কথা বলেন, এ অপবাদ শত্রুতেও দেবে না। সেই তিনি নির্বাচন চলাকালীন এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, আমার পলিটিক্যাল ক্যারিয়ার শেষ করার ষড়যন্ত্র করছেন। চলছিল তাঁতির তাঁত বুনে, কাল হল এঁড়ে গোরু কিনে। সাতটা আটটা পদে আসীন হয়ে, এধার ওধার করে দিব্য চলে যাচ্ছিল, তেনার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার সাধ জাগলো, মিরজাফর হয়ে বসেই ছিলেন, এবার সরাসরি দলবদল করে মাঠে নামলেন, তীব্র সাম্প্রদায়িক প্রচার করে জিতলেনও, খুব সামান্য ভোটে হলেও জিতলেন। মুখ্যমন্ত্রীর বদলে বিরোধী দলনেতা, যতবার মুখ খুলছেন, ততবার মূর্খ বলে প্রমাণিত হচ্ছেন। কেবল একবার মুখ খোলেননি, সিবিআই যখন নারদা মামলায় ফিরাদ হাকিম, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, মদন মিত্রকে গ্রেফতার করলো, তখন মুখ লুকিয়ে ছিলেন, মুখ খোলেননি। দুটো বড় বিষয়ে মুখ খুলেছেন, প্রথমে একটা ট্যুইট করেছেন, তাতে বলেছেন কেন মুখ্যমন্ত্রী, ব্রাকেটে নন এমএলএ, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে থাকলেন না? এটা নাকি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর অবমাননা। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ইত্যাদি ছেড়ে দিন, ওগুলো উনি বোঝেন বলে মনে হয় না, কিন্তু এই ট্যুইটে একটা জিনিস খুব পরিস্কার, উনি, মুখ্যমন্ত্রী যে এখনও বিধায়ক নন, তাই নিয়ে ঠাট্টা করেছেন। পড়াশুনো করলে উনি জানতে পারতেন যে, নির্বাচিত দলের লেজিসলেটিভ কমিটির নেতা যে কেউ হতে পারেন, তিনিই মুখ্যমন্ত্রী হবেন, এবং ৬ মাসের মধ্যে তাঁকে বিধানসভায় নির্বাচিত হয়ে আসতে হবে, এটা সংবিধান বলছে, আরএসএস নয়, দেশের সংবিধান। জানা না থাকলে ইদানিং ওনার গুরু নরেন্দ্র মোদীকে জিজ্ঞেস করে নিন, নরেন্দ্র মোদী গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন, ৭ অক্টোবর ২০০১, আর গুজরাট বিধানসভায় মণিনগর থেকে বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন, ১৫ ডিসেম্বর ২০০২। আর একজনকেও জিজ্ঞেস করে নিতেই পারেন, তিনি হলেন আদিত্যনাথ যোগী, যিনি উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন, ১৯ মার্চ ২০১৭, এবং না, তিনি মানুষের ভোটে জিতে এমএলএও হননি, তিনি উত্তরপ্রদেশের বিধান পরিষদের সদস্য হয়েছিলেন, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭। এখন সমস্যা হল, পড়াশুনো তো করবেনই না, পড়াশুনো করা লোকজনের সঙ্গেও তেমন নেই, অতএব ভুল বকছেন। তারপর তিনি আবার বলেছেন, মুখ্য উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত আমলা আলাপন বাবুর জন্য কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কেন খরচ হচ্ছে? কথাটা বলার আগে জেনে নিলে পারতেন যে, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর অমন দু দু’জন উপদেষ্টা আছেন, তাঁদের জন্যও টাকা খরচ হয়, তাঁরাও অবসরপ্রাপ্ত আমলা, অন্তত ১৫ বছর আগে অবসর নিয়েছেন, এসব তিনি জানেন না, জানার কথাও নয়, বোঝালে বুঝবেন, তাও নয়। তাই একটা সোজা উপদেশ, চুপ করে বসে থাকুন, অনেক ছড়িয়েছেন, আর ছড়াবেন না।
দ্বিতীয় জন হলেন, শ্রীযুক্ত স্বপন দাশগুপ্ত। শুভেন্দু অধিকারীর ঠিক বিপরীতে, পড়াশুনো প্রচুর। সেন্ট পলস দার্জিলিং, লা মার্টিনিয়র কলকাতা, গ্রাজুয়েশন সেন্ট স্টিফেন্স, দিল্লি। তারপর স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ, লন্ডন থেকে এমএ, পিএইচ ডি। কিন্তু পড়াশুনো করলেই কি আত্মসন্মানবোধ জন্মায়? কারোর কারোর যে জন্মায় না, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ এই স্বপন বাবু। উনি বিজেপি হলেন, হতেই পারেন। তারপর রাষ্ট্রপতি তাঁকে, রাজ্যসভার মনোনীত সদস্য করলেন, সংবিধানের ৮০ (১) অনুযায়ী সমাজের ১২ জন বিশিষ্ট মানুষজনদের রাষ্ট্রপতি মনোনীত করতেই পারেন, শর্ত তাঁরা দলীয় রাজনীতি করবেন না, দীর্ঘদিন এই রীতি বজায় ছিল, এই আমলে রীতিনীতি চুলোর দুয়োরে দেওয়াটাই রীতি, মনোনীত সদস্য তো কী? খুলে আম তিনি, রূপা গাঙ্গুলি বিজেপির রাজনীতি প্রচার করতে শুরু করলেন, চলছিল। কিন্তু ওনার আরও বড় খোয়াইস আছে, অন্তত ছিল, উনি বাংলায় বিজেপির এক প্যারালাল নেতৃত্ব দেওয়া শুরু করলেন, একটু এলিট নেতৃত্ব, টলিউডের এক অভিনেত্রী, মুকুল রায় ইত্যাদিকে নিয়ে দিলীপ ঘোষের প্যারালাল সংগঠন, মনোবাসনা, বিজেপি জিতলে মুখ্যমন্ত্রী হবেন। তারপর যথাসময়ে নমিনেশন ফিল আপ করলেন, নিজের আইনজীবী পুত্রও বলে দিল না যে, মনোনীত সদস্যরা দলীয় রাজনীতি করতে পারেন না, সময়ে মনে করিয়ে দিলেন তৃণমূল সাংসদ, মহুয়া মৈত্র, না হলে নমিনেশনে ক্যান্সেল হত। আসলে তখন তো মুখ্যমন্ত্রী হবার খোয়াইস, পদত্যাগ করে তারকেশ্বর থেকে প্রার্থী হলেন, তৃণমূলের প্রার্থীর কাছে হারলেন, দল হেরে ভূত। তাঁর সহমর্মীরাও হেরে গেছেন, মুকুল রায় সেই যে কথা বন্ধ করেছেন আর মুখ খোলেন নি। স্বপনবাবু শিক্ষিত, অনেকে আশা করেছিলেন যে ওনার একটু হলেও আত্মসম্মানবোধ থাকবে, কিন্তু না, হেরে যাবার ২৯ দিনের মাথায় তাঁকে আবার মনোনীত করা হল, রাজ্যসভার মনোনীত সদস্য হিসেবে। জানেন খুব ভালো, লোকে ছি ছি করবে, কিন্তু ওই যে লজ্জা ঘেন্না ভয়, তিন থাকলে আর যাই হোক, বিজেপি হওয়া যায় না। তিনি কেবল হলেন না, হয়ে ট্যুইটটা নিজেই করলেন। আমাদের লজ্জা হচ্ছে। গ্রামের মানুষরা বলেন, দেখন্তিরও লাজ আছে, হাগুন্তির নেই গো, হাগুন্তির লাজ থাকে না।
তিন নম্বরে যিনি তাঁর নাম এনাদের সঙ্গে নেওয়া পাপ, তবুও নিচ্ছি। তিনি হলেন অমর্ত্য সেন। শান্তিনিকেতনের মানুষ, বাঙালি। এখনও ভারতীয়, নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, সবচেয়ে বড় কথা সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলার ক্ষমতা রাখেন, ৮৭ বছর বয়সেও তীক্ষ্ণ যুক্তি আর শাণিত বোধ আমাদের ঋদ্ধ করে, ডিমনিটাইজেশনের পরের দিন তিনি বলেছিলেন, সাংঘাতিক ভুল, এভাবে কালোটাকা উদ্ধার হয় না, হবে না, দেশের অর্থনীতির ক্ষতি হবে। আমাদের এন্টায়ার পলিটিকাল সায়েন্স পাস করা, প্রধানমন্ত্রী, আবার পড়াশুনো জানা লোকজনদের পছন্দ করেন না, মোসায়েব হলে তবুও চলতো, স্বপন দাসগুপ্তের মতো জি হুজুর হলেও চলত, অমর্ত্য সেন হজম হবে কেন? রবীন্দ্রবিক্ষায় বড় হওয়া এক মানুষকে, আরএসএস এর প্রচারকের পছন্দ হবার কথা নয়, মোদীজি নাকি হার্বাডের থেকে হার্ড ওয়ার্ক বেশি পছন্দ করেন, তাতে অবশ্য অমর্ত্য সেনের কিছু যায় আসে না, তিনি বার বার এই ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক সরকার আর তার প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে তাঁর মত করে দেশবাসীকে সাবধান করেছেন, এই ফ্যাসিস্ট জামানার অবসান চান তাও বলেছেন, এসব সবার জানা। এও জানা যে, ওনাকে নালন্দা মহাবিদ্যালয় থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল এই মোদীজির নির্দেশেই। আর এটাও সবাই জানেন যে, অটলবিহারী বাজপেয়ীর জামানায়, ১৯৯৯ তে ওনাকে ভারতরত্ন পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল, পুরস্কারের মধ্যেই ছিল আরও অনেক রকমের সুযোগ সুবিধে, ছিল ন্যাশন্যাল ক্যারিয়ার এয়ার ইন্ডিয়াতে বিনামূল্যে ভ্রমণের অনুমতি। এদিকে মাত্র গতকাল বিজেপি আইটি সেল, গবেষণা করে বার করেছে যে, অমর্ত্য সেন ২১ বার আন্তর্জাতিক ভ্রমণের সুবিধে নিয়েছেন, এ নিয়ে তারা প্রচারও শুরু করেছে, অন্যান্যরা নেয়নি, কেন অমর্ত্য বাবু এই সুযোগ নিলেন? প্রথমত অমর্ত্য সেনকে তাঁর কাজের জন্যই যতবার দেশ বিদেশ যেতে হয়, ততবার লতা মঙ্গেশকর বা শচীন তেন্ডুলকরের যাবার কথা নয়, সে যুক্তি বাদই দিলাম, একজন নোবেল পুরস্কার জয়ী, ভারতরত্ন কতবার তাঁকে দেওয়া সুযোগ নিলেন, এ নিয়ে কথা বলা ধৃষ্টতা আর রুচি কোথা থেকে জন্ম নেয়? এ এক ধোকলা সংস্কৃতি, এক বেনিয়া সংস্কৃতি আমাদের ওপরে চাপানো হচ্ছে, একদিকে অশিক্ষিতের নির্লজ্জ হুঙ্কার, আত্মসম্মানবোধহীন শিক্ষিতের নির্লজ্জ আস্ফালন, আর অন্যদিকে এক নোবেল জয়ী ভারতরত্ন বাঙালিকে অপমান করার চেষ্টা, কতদিন এসব সহ্য করা হবে? সাংবিধানিক রীতিনীতি, বোধ বুদ্ধি তো ছেড়েই দিলাম, সাধারণ রুচিবোধও থাকবে না? এ কোন সময়ে পা দিয়েছি আমরা? এখনও যারা বিজেপিকে একটু হলেও পছন্দ করেন, ভাবুন, যারা বিরোধিতা করেন, তাঁরা এই তথ্য মানুষের কাছে রাখুন, মানুষের ওপর বিশ্বাস রাখতে বলেছিলেন, আমাদের ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।