বাংলায় জনসঙ্ঘ বা পরবর্তীতে বিজেপি বিরাট একটা কলকে কখনও পায়নি, পায়নি তার কারণ দুটো। প্রথম কারণ হল বাংলার মাটিতে রেনেসাঁ আর বাম আন্দোলনের প্রভাবে এক উদার আধুনিক সমাজের কাছে গোঁড়া হিন্দুত্ববাদীদের পছন্দের তালিকাতে রাখাটাই ছিল অসম্ভব। আর দ্বিতীয় কারণ হল ওই শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিই শেষ, তারপরে এ বাংলায় সেই মাপের নেতা জনসঙ্ঘ বা বিজেপি পায়নি। উল্টোদিকে বিধান রায় থেকে সিদ্ধার্থ শঙ্কর, প্রিয়, সুব্রত, সোমেন। অন্যদিকে জ্যোতি প্রমোদের পরে বুদ্ধ, অনিল, সুভাষ, শ্যামল ইত্যাদি তারকাদের উঠে আসা। এবারে তুলনা করুন। নিপাট ভালমানুষ বিষ্ণুকান্ত শাস্ত্রী তো অনেক বাঙালির চেয়েও ভালো বাংলা বলতেন কিন্তু গা থেকে অবাঙালি ছাপ মুছে ফেলতে পারেননি, সেই ক্যারিশমাও ছিল না। তপন শিকদার, মুরলীধর লেনে প্রদীপ জ্বালিয়ে বসে থাকতেন, নিষ্ঠাভরে দলের কাজ করতেন কিন্তু জনপ্রিয়তা বা ক্যারিশমা? না, কোনওটাই ছিল না। পরবর্তীতে কারা উঠে এলেন? রাহুল সিনহা, শমীক ভট্টাচার্য ইত্যাদিরা না ভালো সংগঠক না জনপ্রিয় নেতা। কাজেই ভোটের শতাংশের হার ছিল কখনও ৬ কখনও ৯। দু’ সংখ্যা ছুঁতে কালঘাম বওয়াতে হয়েছে তাঁদের। একটু হিসেবের দিকেই চোখ রাখুন না। লোকসভার ভোটের হিসেবে ১৯৮৪-তে ০.৪ শতাংশ, ১৯৮৯-এ ১.৬৭ শতাংশ, ১৯৯১-তে ১১.৬৬ শতাংশ ১৯৯৬-এ আবার ৬.৮৮ শতাংশ ১৯৯৮-এ ১০.২ শতাংশ, ১৯৯৯-এ ১১.১৩ শতাংশ ভোট, ২০০৪-এ ৮.০৬ শতাংশ আর ২০০৯-এ ৬.১৪ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। মানে জন্ম থেকে ওই ২০০৯ পর্যন্ত বিজেপি খুব জোর ১১ শতাংশ আর কম করে ৬ শতাংশ ভোট পেয়েছে। বোঝাপড়া ছিল বলে তপন শিকদার দমদমের আসনে জিতেছিলেন কিন্তু সে বোঝাপড়া শেষ হতেই বিজেপি শূন্য। কিন্তু ওই ২০১৪-তে হঠাৎই বিজেপির রাজ্য সভাপতি পদে আনা হয়েছিল একজন আরএসএস প্রচারককে, যিনি ভালো করে বাংলা বলতে পারেন না কিন্তু বিজেপি ক্যাডারদের বুঝিয়ে দিলেন, মারের বদলা মার দিতে পারলে ফল মিলবে। হ্যাঁ, দিলীপ ঘোষকে আনা হল, বাইকে চেপে গলায় গামছা দিয়ে তৃণমূলের মাটিতে দাঁড়িয়ে চোখ রাঙানোর ক্ষমতা দেখালেন তিনি। একবারই দার্জিলিংয়ে চড়চাপাটি খেয়েছিলেন, সেটা বাদ দিলে তাঁর তেড়িয়া মেজাজ বিজেপির সমর্থক ক্যাডারদের অক্সিজেন জুগিয়েছে এবং তাঁরই সভাপতিত্বের সময়ে বিজেপি ২০১৪-তে ১৭.০২ শতাংশ, ২০১৯ এ ৪০.২৫ শতাংশ আর ২০২১-এর বিধানসভাতে ৩৮.১৪ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। বিজেপি এ রাজ্যে দু’ নম্বর দল হওয়ার পিছনে এই দিলীপ ঘোষের অবদান সবথেকে বেশি। কিন্তু ওই ২০২১-এই তৃণমূল থেকে বিজেপি দলে এলেন শুভেন্দু অধিকারী। তারপর থেকেই বিজেপিতে নেতৃত্বের সংঘাত শুরু। এই সময় থেকেই দলের ডাকাবুকো নেতার পিছনে হাঁটার শুরুয়াত। ক্রমশ দল চলে আসছে অধিকারীর অধিকারে। সেটাই বিষয় আজকে।
২০২১-এর নির্বাচনেই রাজ্য বিজেপি দলে নেতৃত্বের টানাপোড়েন শুরু হয়েছিল, আজন্ম আরএসএস প্রচারক দিলু ঘোষ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মন জুগিয়ে চলেননি বা বলা ভালো মন জুগিয়ে চলাটা তাঁর ধাতেও নেই। অন্যদিকে তাঁর সম্বন্ধে কিছু আপত্তিকর অভিযোগ উপরতলায় পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল, তিনি ফোন ধরছেন না, তাঁর হয়ে ফোন ধরছেন কোনও সুললিত কণ্ঠের অধিকারিণী, তাঁর ডাবল ডেকার প্রচার ভ্যান নিয়েও বিভিন্ন কথাবার্তা। এবং চিরটাকাল সব দেশের সব রাজারাই কর্ণেন পশ্যতি, রাজারা কান দিয়েই দেখে। এক্ষেত্রেও খুব তাড়াতাড়িই দিলু ঘোষ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে বহু কারণেই অপ্রিয় হয়ে উঠলেন।
আরও পড়ুন: Aajke | কেজরিওয়ালের পরেই মমতা?
অন্য আর এক ডাকাবুকো শুভেন্দু অধিকারী আর পরবর্তী রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের টানাপোড়েনের মাঝে তিনি ক্রমশ গুরুত্বহীন হয়ে পড়লেন বা বলা ভালো তাঁকে গুরুত্বহীন করে রাখা হল। একটা অলিখিত সমঝোতা আছে শুভেন্দু আর সুকান্তর মধ্যে, দিলীপকে বৃত্তের বাইরে রেখেই হোক বাংলার রাজনীতি। এ ব্যাপারে দুজনেই একই জায়গায়। এবং সত্যিই দেখা গেল দিলু ঘোষ তাঁর সংসদীয় এলাকার বাইরে যাতায়াতও কমিয়ে দিলেন বা দিতে বাধ্য হলেন। এবারে মাঝমাঠে দুজন, কাজেই আবার একবার ক্ষমতার লড়াই শুরু হয়েছে আর এই লড়াইয়ে মাহির শুভেন্দু অধিকারী ক্রমশ তাঁর ফুটপ্রিন্ট বাড়িয়েই চলেছেন। প্রথমে নিজের ভাইকে নমিনেশন দেওয়ানো, তারপর তাঁর দৌত্যে দলে আনা অভিজিৎ গাঙ্গুলিকে তমলুকের আসন দেওয়া। এরপর দিলীপ ঘোষকে তাঁর জেতা আসন থেকে সরিয়ে সেখানে তাঁর লবির অগ্নিমিত্রা পালকে মেদিনীপুরে দাঁড় করানো, ইন্টেলেকচুয়াল বলে নাম আছে, সেই স্বপন দাশগুপ্তকে বারাসতে পাঠিয়ে দেওয়া, অর্জুন সিংকে আবার ব্যারাকপুরে আনা, রায়গঞ্জে দেবশ্রী চৌধুরীর জায়গাতে শুভেন্দু লবির কার্তিক পালের টিকিট, দেবশ্রী শেষমেশ বাঘের গুহায় এমনকী কৃষ্ণনগরে রাজ পরিবারের অমৃতা রায়ের টিকিটও ওই শুভেন্দু অধিকারির হাত ধরে। এক কথায় বলাই যায় যে এবারের নির্বাচনে শুভেন্দু অধিকারীর যাবতীয় আবদার মেনে নিয়েছে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব, অমিত শাহ, মোদি, নাড্ডা। তলার সারিতে এর প্রভাব কী? বিজেপির র্যাঙ্ক অ্যান্ড ফাইলে সব্বাই খুব শুভেন্দু-প্রেমী তা তো নয়, এক দীর্ঘ সময় ধরে এই শুভেন্দুই পুলিশ আর প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে তৃণমূলের মাসলম্যান হয়ে উঠেছিলেন, কাজেই বিজেপিতে তাঁর শত্রু যথেষ্ট আছে। একটা হুইস্পারিং ক্যাম্পেন শুরু হয়েছে যে অধিকারীদের দখলে চলে গেছে গোটা রাজ্য বিজেপি। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, মাত্র তিন বছর আগে তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বে থাকা শুভেন্দু অধিকারী এখন বাংলা বিজেপির পুরোপুরি কন্ট্রোল হাতে নিয়েছেন, এতে সাবেক বিজেপি বা আদি বিজেপিদের প্রতিক্রিয়া কী? এই হঠাৎ উঠে আসা শুভেন্দু অধিকারী কি দলকে প্রয়োজনীয় জয় এনে দিতে পারবে? শুনুন কী বলেছেন তাঁরা।
জায়ান্ট কিলার শুভেন্দু বিজেপিতে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন তো বটেই কিন্তু আদি বিজেপি নেতাদের এক বিরাট অংশ এই উত্থানে খুশি নয়, তাদের চোখের সামনে এমনকী দিলু ঘোষের মতো নেতাদের অপদস্থ হতে দেখছেন বিজেপির পুরনো কর্মী সমর্থকেরা। তাঁদেরই একজন বললেন, ১৮ থেকে বেড়ে যদি ২৫ হয়ে যায় তাহলে এ নিয়ে আর কোনও কথাই হবে না, প্রত্যেকেই মেনে নেবে শুভেন্দুর নেতৃত্বকে। কিন্তু ১৮ যদি কমে ১২ কি তারও নীচে ৮-১০-এ চলে যায়, তাহলে শুভেন্দু তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়াবেন। বিজেপির বেস বা কোর ভোট কিন্তু ওই ৯-১০ শতাংশ, তারপরের বৃদ্ধি কিন্তু সরকার বিরোধী ভোটের সিংহভাগের অংশ। সেই ভোট সরে গেলেই কিন্তু বিজেপি আবার তার কোর ভোটারদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে। আর তেমন হলে লোকসভা নির্বাচনের পরে এক বিরাট হারের সব দায়িত্ব গিয়ে পড়বে শুভেন্দু অধিকারীর উপরে। এবার জেনে বা না জেনেই তিনি জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষার মুখোমুখি, বিজেপির ১৮কে তিনি ২৫-৩০ করতে পারলে তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের শীর্ষে উঠবেন, আর ওই ১৮ কমে ৯-১০ হয়ে গেলে তাঁর নির্মম পতন অনিবার্য।