রাজনীতি হল এক অনন্ত সম্ভাবনার অঙ্ক, থাউজেন্ড প্রবাবিলিটি। আপনি অন্য অনেক বিষয়ে শেষ কথা বলে দিতেই পারেন, অনেক কিছুরই সম্ভাবনার হিসেবনিকেশ করা যায়। লাল গোলাপের গাছে লাল গোলাপই ফুটবে এমন সম্ভাবনার কথা বললে কেউ হাসবে না। কিন্তু রাজনীতিতে সম্ভাবনার কথা? কেউ জানে না। কেউ হলফ করে বলতে পারবে না যে এটাই হবে, অন্য কিছুই হবে না। ধরুন তৃণমূল কংগ্রেসের জন্ম, শেষ পর্যন্ত তো সেটা ছিল রাজ্য কংগ্রেসের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী সোমেন মিত্রের সঙ্গে যুব কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধায়ের লড়াই। শেষ পর্যন্ত সাংগঠনিক ভোটের ময়দানে রিগিংয়ের অভিযোগ, হেরে যাওয়ার পরে পাকাপাকি বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত এবং তৃণমূল কংগ্রেসের জন্ম। একবারও তখন কেউ ভেবেছিলেন যে সেই সোমেন মিত্র কালীঘাটে গিয়ে তৃণমূলে যোগ দেবেন, ডায়মন্ডহারবার থেকে তৃণমূলের সাংসদ হবেন। না, কেউ ভাবেননি। যাঁরা কালীঘাটের মোড়ে দাঁড়িয়ে সৌগত রায়কে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ভাষণ দিতে শুনেছেন, তাঁরা জানেন কোন সুসভ্য ভাষার প্রয়োগ সেদিন সৌগতবাবু করেছিলেন। অমন এক শিক্ষিত মানুষের মুখে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে অমন অসভ্য অশালীন ভাষা শুনে সব্বাই চমকে গিয়েছিল, কিন্তু কেউ কি ভেবেওছিল যে কিছুদিন পরে সেই সৌগত রায় তৃণমূলে কেবল যাবেন না, দলের একজন কেউকেটা হয়ে উঠবেন? হয়েছে। জরুরি অবস্থার পরে কংগ্রেস ভেঙেছিল, প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সী আর্স কংগ্রেসে গিয়ে আবার কংগ্রেস যাওয়া এবং নিজের নামের কুকুর পোষার মিল টেনে অপূর্ব ভাষণ দেওয়ার মাত্র ক’বছরের মধ্যেই আবার কংগ্রেসে গিয়েছিলেন। এবং এসবের চেয়ে অনেক বড় উদাহরণ হল সিপিএম কংগ্রেসের রাজনৈতিক জোট। এমন কোনও মহল্লা দেখাতে পারবেন যেখানে কংগ্রেসি সরকারের পুলিশের গুলিতে, কংগ্রেসি গুন্ডার আক্রমণে নিহত সিপিএম কর্মীর শহীদ বেদি নেই? পারবেন না, কিন্তু সেই কংগ্রেস এবং সিপিএম আপাতত গলায় গলায়। এটাই রাজনীতি, সেটাই বিষয় আজকে, মমতা, অধীর, সেলিম এক মঞ্চে আসা সম্ভব?
আপাতত প্রায় রোজ নিয়ম করেই সেলিম সাহেব প্রেস মিটে তৃণমূলের গুষ্টির তুষ্টি করছেন, সিপিএম মুখপত্রের সিংহভাগ জুড়ে ওই তৃণমূল নেতাদের দুর্নীতি, সরকারের দুর্নীতি, আসলে যে তৃণমূল বিজেপির বি টিম এসব থাকে। ভাষণেও ফালাফালা করা হয় তৃণমূলকে। অধীরবাবু আরও এককাঠি উপরে। তাঁর ব্যক্তিগত জ্বালা থেকেই তিনি বিজেপিকে নিয়ে কম বলেন, তৃণমূল নেতাদের নিয়েই বেশি বলেন। তৃণমূলের দুর্নীতি নিয়ে তিনি মুখর, প্রতিদিন বিবৃতি কেবল তৃণমূল নয়, নেত্রী মমতার বিরুদ্ধেও চোখাচোখা শব্দ আমরা শুনি। এবং তৃণমূলের তরফে সে দায়িত্ব মূলত পালন করেন কুণাল ঘোষ, তিনিও নিয়ম করেই সিপিএম, কংগ্রেসের বিরুদ্ধেই বলেন কিন্তু যে হেতু রাজ্য রাজনীতিটাকে বিজেপি তৃণমূল বাইনারির মধ্যে রাখাটা তাঁদের লক্ষ্য তাই বিজেপি নিয়ে বেশি, কংগ্রেস সিপিএম নিয়ে কম বলেন।
আরও পড়ুন: Aajke | মহম্মদ সেলিমের নীতীশ কুমারে অরুচি নেই, আপত্তি মমতাকে নিয়ে, কেন?
মাঝেমধ্যে সে দায়িত্ব নেন অভিষেক। গতকালই বলেছেন, অসমে যাঁরা নিজেদের এলাকাতেই আমাদের চেয়েও কম ভোট পেয়েছেন তাঁরা এ রাজ্যে বড় বড় কথা বলছেন কেন? খুব মাঝেমধ্যে এই কোরাসে যোগ দেন দলনেত্রী নিজেও। কিন্তু সেগুলো হল সাইড টক, মূল ভাষণে বিজেপির বিরুদ্ধে যা যা বলার আছে তা বলার পরে ওই যে কংগ্রেস আর সিপিএম বলে দুটো কথা বলা বা ওই জগাই মাধাই গদাই ইত্যাদি বলা। এসব শুনে মাঝেমধ্যেই মনে হয় এর পরেও এনারা কীভাবে একসঙ্গে গিয়ে বৈঠক করছেন, ভেতরের খবর আসন সমঝোতা প্রায় হয়েই গেছে, তা ঘোষণা হবে দু’ তিন দিনের মধ্যেই। তার আগে এসব কী চলছে? আসলে এগুলো হল নিজের নিজের দলকে সামলানোর চেষ্টা। তৃণমূলের সে চেষ্টা কম কারণ কার্যত তাদের লড়াই বিজেপির বিরুদ্ধে, গোটার চার পাঁচ আসন বাদ দিলে অন্য আসনগুলোতে তাদের সিপিএম বা কংগ্রেসের কথা বলতেও হবে না, লড়াই সোজাসুজি বিজেপির সঙ্গে। কাজেই ছাপার অক্ষর বা টিভির পর্দায় কি দলনেত্রী, কি সেকেন্ড ইন কমান্ড অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় কি কুণাল ঘোষ বা শান্তনু সেন, ওনাদের প্রথম নজর বিজেপির দিকে। অন্যদিকে কংগ্রেস জানে তাদের যে আসনে জিতে আসার সম্ভাবনা কিছুমাত্রও রয়েছে সেখানে মানুষকে তাদের বোঝাতেই হবে যে লড়াইটা ওই আসনে তৃণমূলের সঙ্গে, বিজেপির ভোট বিজেপি পাক, তৃণমূলের ভোট না টানতে পারলে কংগ্রেসের একটা আসনও জেতা সম্ভব নয়। কাজেই সে তৃণমূল বিরোধিতা বাড়াচ্ছে। যে মুহূর্তে আসন সমঝোতা হবে, লিখে নিন অধীরবাবু তৃণমূলের নামও মুখে আনবেন না। অন্যদিকে সিপিএম জানে তৃণমূলের সঙ্গে কোনও আসন সমঝোতা করলে দলটাই উঠে যাবে, কাজেই হারুক আর জিতুক আপাতত তাদের তৃণমূল বিরোধিতা চালিয়ে যেতেই হবে। কিন্তু সেই বিরোধিতাকে যদি অজর অমর অক্ষয় মনে করেন, তাহলে ভুল করবেন। দিল্লি বা মুম্বই নয়, এই বাংলাতেও কংগ্রেস, সিপিএম, তৃণমূলকে এক মঞ্চে দেখতে পাওয়াটা কেবল সময়ের অপেক্ষা। ঠিক যে লজিকে কংগ্রেস সিপিএমকে এক মঞ্চে দেখা গেছে, কংগ্রেস সিপিএম তৃণমূলকেও একই মঞ্চে দেখতে পাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমরা আমাদের দর্শকদের প্রশ্ন করেছিলাম, বিজেপি বিরোধিতার বৃহত্তম প্রশ্নে সিপিএম, কংগ্রেস আর তৃণমূলকে কি একই মঞ্চে আসতে হতে পারে? যে ইন্ডিয়া জোট তৈরি হয়েছে তা কি এই রাজ্যেও হতে পারে? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
কি কমিউনিস্ট কি কংগ্রেস, বা তৃণমূল, রাজনীতি আপাতত বিভক্ত দুই শিবিরে। বিজেপি আর বিজেপি বিরোধী শিবির। এবং যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হল এই দুই শিবির কেবল দুটো আলাদা আলাদা দলের শিবির নয়, এক আলাদা দর্শনের উপর দাঁড়িয়ে। এক হিন্দুরাষ্ট্রের কল্পনাকে সামনে রেখেই বিজেপি জোট বেঁধেছে, সেই জোটে বিরোধীদের আজ বা কাল সব কিছু ভুলেই এক মঞ্চে আসতেই হবে। আজকের সাধারণ ভোটের লড়াই আর আসনের হিসেবের বাইরেও সেই রাজনীতি প্রাধান্য পাবেই। একধারে দেশের সংবিধান, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতান্ত্রিক চেতনা আর দেশের ফেডারেল স্ট্রাকচার, অন্যদিকে এক সাম্প্রদায়িক জঙ্গি জাতীয়তাবাদকে নিয়ে এগিয়ে চলা শক্তি একটা সময়ে দেশের মূল দ্বন্দ্ব হয়ে উঠবে। সেদিন আমরা রাজনীতির মঞ্চে অনেককেই একসঙ্গে বসতে দেখব আর সেই দিনটা খুব দূরেও নয়। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই তাদের এক মঞ্চে আসতে হবে।