চায়ের দোকানের গোপন রিপোর্টার পেয়ে যাবেন সর্বত্র, এবং ঠাট্টা নয়, এঁদের অনেকেই ৫-৬টা খবরের কাগজ পড়েন, বিভিন্ন টিভি চ্যানেল দেখেন, ইউটিউব চ্যানেলে মতামত দেন। তেমন একজন আমাকে বিস্তারিত বুঝিয়ে বললেন বাংলার যুবরাজ কেন এক্কেবারে ঠিক কথাটাই বলেছেন। মনে করিয়ে দিই যে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন ২০২৬-এ বাংলায় বিজেপি ৫০-এর বেশি আসন পাবে না। এক্কেবারে তথ্যপ্রমাণ দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন কেন সেটা হবে। এবং শেষ করলেন যা বলে সেটা না বলে থাকতে পারছি না, উনি শেষে মুখের নিভে যাওয়া বিড়িটা আবার ধরিয়ে বললেন, বাকিটা ২০২৬-এর ভোটবাক্স বলবে। আপাতত চায়ের কাপের ধোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে গেরুয়া স্বপ্নটাও ধোঁয়া হয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা বিজেপির নেতারা কবে শেষ পাড়ার চায়ের দোকানে গেছেন, যে চায় পে চর্চা দিয়ে তাঁদের যাত্রা শুরু, সেই চায় পে চর্চার বদলে তাঁরা সম্ভবত অন্য কিছু নিয়ে চর্চা চালাচ্ছেন। সে থাক। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে একটা সময় ছিল, প্রবল গেরুয়া ঝড় উঠেছিল বাংলায়। চায়ের দোকানে, লোকাল ট্রেনে, বৌঠানের রান্নাঘর থেকে শুরু করে কলেজ ক্যান্টিন, সর্বত্র আওয়াজ উঠেছিল, অবকি বার বিজেপি সরকার, “এইবার বিজেপি!” কিন্তু ২০২১-এর সেই ঘোর কাটতেই এখন অনেকের মুখেই শুধু একটাই প্রশ্ন, “আচ্ছা, বিজেপি কি সত্যিই ২০২৬-এ ৫০-এর ঘরে আটকে যাবে?” তার মানে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল নিয়ে এমন আলোচনাও হচ্ছে, যাতে তারা ক্ষমতা দখলের ধারেকাছেও নেই, খান পঞ্চাশেক আসন পাবে কি না সেটা নিয়েই চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। মনে আছে ২০২১-এ, আমাদের চোখে আঙুল দাদা অভিনেতা জানিয়েছিলেন যে তিনি তথ্যসংস্কৃতি দফতর পেলে মন্ত্রিত্বে যাওয়ার কথা ভাববেন। এক অভিনেত্রী জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী পদে মহিলা মুখই রাখা উচিত হবে। এক আইনজীবী বিজেপি নেতা জানিয়েছিলেন আগামী বছরে পা দেওয়ার আগেই মমতা ব্যানার্জির গোটা মন্ত্রিসভাই জেলের ভিতরে থাকবে। সেই দলের ভিতরেও এখন অনেকের বুকে চিনচিনে ব্যথা। অনেক বিজেপি নেতা মুখে বলছেন, “এটা তৃণমূলের প্রপাগান্ডা,” কিন্তু মনের ভেতরে অনেকেই গুনগুন করে উঠছেন, “পঞ্চাশ পেরোবে না গো পঞ্চাশ পেরোবে না…” প্রায় সাজানো বাগান শুকিয়ে গেলর মতো হাহাকার। তো সেটাই বিষয় আজকে বিজেপির বাংলা দুঃস্বপ্ন: ২০২৬-এ কি আসন কমে হবে প-এ পঞ্চাশ?
হাঁকডাক চলছে, এ নেতা, ও নেতা– আর নেতা কোথায়? দলের রাজ্য সভাপতির পদটাই এখন যেন হট পটেটো। কেউই আন্দাজ করে উঠতে পারছে না। আগে দিলীপ ঘোষ ছিলেন, তাও গলা ফাটিয়ে কিছু বলতেন। এখন যিনি বসে আছেন, তিনি এতটাই নীরব যে দল না কি তাঁকে ‘ঘরে বাইরে নীরব’ বলে ডাকে। বহু বিজেপি নেতার রাজ্য সভাপতির চেয়ারে বসার লোভ যেমন আছে, তেমনই চেয়ারে বসে পরে কতদিন বসে থাকা যাবে, সেটাও একটা রহস্য।
আরও পড়ুন: Aajke | বাংলায় কথা বললেই বাংলাদেশি? তাকে ছাড়তে হবে দেশ?
যে দলটা এক সময় দিলীপ ঘোষের ‘রক্ত চাই’ টাইপ বক্তব্যে তুঙ্গে উঠেছিল, এখন সেই দিলীপ ঘোষকেই যেন দল অপমানের শীতলপাটি দিয়ে বিদায় জানাতে চাইছে। একদিকে কেন্দ্র দিলীপকে একটু একটু করে সরাতে চাইছে, আর দিলীপবাবু দমছেন না। দলের ভিতরে এখন যেন দিলীপ বনাম নতুন ছেলেপুলে লড়াই। নতুন বিজেপি বনাম পুরনো বিজেপি, ইনার পার্টি স্ট্রাগল চলছে, কিছু কিছু জায়গাতে তা ইনার পার্টি আর্মস স্ট্রাগল হয়ে ওঠার অপেক্ষা। একসঙ্গে থাকা মানে? বিজেপি এখন যেন বিয়ে বাড়ির প্যান্ডেল – পুরনো আত্মীয়রাও এসেছে, আবার নতুন পাড়ার লোকও এসে খাচ্ছে। ২০১৯-২১-এর উত্তেজনায় তৃণমূল থেকে যাঁরা ঝাঁপ দিয়েছিলেন বিজেপিতে, তাঁদের এখন অনেকেই নিজেকে ‘মূল বিজেপি’ মনে করেন। আর যাঁরা সত্যিই দশ বছর আগে রোদে দাঁড়িয়ে লিফলেট বিলিয়েছেন, তাঁরা এখন রেগে গিয়ে বলেন, “আমরাই তো আসল বিজেপি।” দলের ভিতরে এই নতুন বনাম পুরনো দ্বন্দ্ব এতটাই প্রকট যে পাড়ার ক্রিকেট টিমেও এত মারামারি হয় না। তার সঙ্গে জুড়েছে মুসলিম ভোটে বিজেপির ঝাঁড়ু চালানো, চালিয়েছেন স্বয়ং খোকাবাবু। পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম ভোটার প্রায় ৩৩ শতাংশ। ২০২১-এ বিজেপি মুসলিম ভোট থেকে যা পেয়েছিল, তা লজ্জাজনক শব্দটাকেও লজ্জা দেবে। ২০২৬-এও যদি এই ধারা বজায় থাকে, তাহলে ৫০ ছুঁতে গেলে বাকি আসনগুলিতে বিজেপিকে প্রায় দেবতা নেমে এলেন এমন পারফরম্যান্স দিতে হবে। সেটা কি বাস্তব? আর এগুলোকে মাথায় রেখেই তৃণমূলের দ্বিতীয় নম্বর নেতা, অনেকে বলেন আসলে প্রথম, অভিষেক ব্যানার্জি সাফ বলে দিয়েছেন, “২০২৬-এ বিজেপি পঞ্চাশ পেরোতে পারবে না।” শুনে বহু চায়ের দোকানের রিপোর্টার শুধু নয়, অভিজ্ঞ রিপোর্টারেরাও একমত। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম যে অভিষেক ব্যানার্জি বলেছেন আগামী ২০২৬-এর নির্বাচনে বিজেপি ৫০ পার করতে পারবে না, এটা কতটা বাস্তব ধারণা? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
তবুও বিজেপির মুশকিল আসান কি সম্ভব? কারণ দলটা এখনও কেন্দ্রের ক্ষমতায় আছে, কাজেই টাকা-পয়সার অভাব নেই। তাতে যদিও ‘জনভোট’ কেনা যায় না – সেটা ২০২১-এ বেশ বোঝা গেছে। আসলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখনও বাংলায় রীতিমতো জনপ্রিয়। একের পর এক প্রকল্প, রাস্তাঘাট, গরিব মানুষদের হাতে টাকা পৌঁছে দেওয়া শাসন – এই কঠিন বর্ম ভাঙা বেশ কঠিন। শেষ কথা হল বিজেপির বাংলা চ্যাপ্টারে এখন রোমাঞ্চের চেয়ে বিভ্রান্তিই বেশি। না নেতা ঠিকঠাক আছে, না কাঠামো, না ভোট ব্যাঙ্ক। তৃণমূল মাটিতে মিশে থাকা সংগঠনের উপর ভর করে বেশ নিশ্চিন্ত, আর কংগ্রেস ও সিপিএম এখনও নিজেদের অস্তিত্ব খুঁজে চলেছে। তাই এখন প্রশ্নটা আর বিজেপি সরকার গড়বে কি না? নয়। প্রশ্নটা হল, বিজেপি কি পঞ্চাশ পেরোবে?