মাও সে তুং বলেছিলেন কাগুজে বাঘের কথা, পেপার টাইগারের কথা, বলেছিলেন এদের চিনতে হবে, এদের হাঁকডাককে বুঝতে হবে এবং শেষে বলেছিলেন এরা আসলে ভিতু, সুযোগসন্ধানী এবং আসলে তালপাতার সেপাই। আরেকবার সেই সত্যি প্রমাণিত হল, কিছুকাল যাবৎ বামেদের নয়নের মণি হয়ে ওঠা কমরেড অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বিজেপিতে যোগ দিলেন। দিনদুয়েকের মধ্যে বঙ্গবাসী এই সুযোগ সন্ধানীকে চিনতে পেরে গেছেন, মিলিয়ে নেবেন ক’দিন পর থেকে ওনাকে যে মিডিয়া এঁটুলি পোকার মতো গায়ে লেপ্টে ছিল, এবেলা ওবেলা এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ নিয়েছে, তাদেরকেও সাধ্যসাধনা করে ডাকতে হবে কথা বলার জন্য, মানুষ তো কোন ছার। কাজেই ওই অভিজিৎবাবু এ বাংলার শাসকদলের একটি কুঞ্চিত কেশও উৎপাটন করতে পারবেন না। তৃণমূল কংগ্রেস এক জমাট সংগঠন যার মূল আকর্ষণ হল, additive power হল ক্ষমতায় থাকা, যার শক্তি হল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো এক ক্যারিশম্যাটিক লিডার, যার মাস বেস নিম্ন মধ্যবিত্ত, গরিব, তস্য গরিব মানুষ যাঁরা ১০০০-র বদলে দেড় হাজার পেলে সেদিন ৪০০ মুরগির মাংস কিনে আনেন আর রাজ্যের সংখ্যালঘু মানুষজন যাঁদের মনের মধ্যে দেশের মধ্যেই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হওয়ার ভয় ঢুকে গেছে। সেইরকম এক সংগঠনকে ভাঙা ওসব কাগজের বাঘের কাজ নয়, এটা আর কিছুদিন পরেই বুঝবে বিজেপি। কিন্তু এটাও বুঝেছে যে এই সংগঠন এই সমর্থনভূমিকে ভাঙতে হলে ভিতর থেকেই আঘাতটা করতে হবে। তাই তাদেরকে আবার তাপস রায়দের খুঁজতে হবে, একটা নয় অনেকগুলো তাপস রায় দরকার, সেই লক্ষ্যেই চলেছে বিজেপি আর সেটাই বিষয় আজকে তাপস রায় দল ছাড়লেন, লাইনে আর কারা আছেন?
ন্যায় প্রতিমূর্তি রাম, অন্যধারে নারী হরণের মতো অন্যায়ের দায় রাবণের কাঁধে, তবুও বিষ্ণুর অবতারের দরকার হয়েছিল ঘরশত্রু বিভীষণকে। বিজেপির স্ট্রাটেজিই হল দেশজুড়ে বিভীষণদের খোঁজা। রাজ্যে রাজ্যে বিভীষণেরাই বিজেপিকে লাগাতার অক্সিজেন জুগিয়ে যাচ্ছে। ২০২১-এর নির্বাচনের আগে তৃণমূল দল থেকে বেরিয়ে যাওয়া শুভেন্দু অধিকারীই তো আপাতত এ বঙ্গে বিজেপির কাণ্ডারি।
আরও পড়ুন: Aajke | আবার কি এক ভাঙনের মুখে দাঁড়িয়ে আছে তৃণমূল?
অসমে হিমন্ত বিশ্ব শর্মা, মহারাষ্ট্রে একনাথ শিন্ডে, অজিত পাওয়ার, মিলিন্দ দেওরা, অশোক চব্যন, মধ্যপ্রদেশে জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া, উত্তরপ্রদেশে জিতিন প্রসাদ, আরপি এন সিং, পঞ্জাবে অমরিন্দর সিং, গুজরাতে হার্দিক প্যাটেল, কর্নাটকে এস এম কৃষ্ণা, অরুণাচল প্রদেশে প্রেমা খান্ডু, উত্তরাখণ্ডে বিজয় বহুগুণা, অন্ধ্রে কিরণ রেড্ডি, মণিপুরে বীরেন সিং, ত্রিপুরাতে মানিক সাহা, বাবুলাল মারান্ডি ঝাড়খণ্ডে। বিরাট তালিকা, এরা প্রত্যেকে হয় কংগ্রেস না হলে অন্য দল থেকে বিজেপিতে এসেছে এবং এরাই আপাতত বিজেপির মুখ। কারণ বিজেপির ওই গুজরাত, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, কিছুটা হলেও ওই রাজস্থান বা ছত্তিশগড় ছাড়া দেশের আর কোথাও তো বিরাট প্রতিপত্তি ছিল না, সেখানে প্রথমে শরিক দলগুলোর হাত ধরে সমর্থন বাড়িয়েছে বিজেপি, তারপর সরকারে এসেছে এবং সরকারে এসেই দল ভাঙিয়েছে, আজ সেটাই তাদের বল-ভরসা। পৃথিবীর একমাত্র দল যাদের একটা গোটা শাখা কাজ করছে অন্য দলের অখুশি, অসন্তুষ্ট উচ্চাকাঙ্ক্ষী নেতাদের চিহ্নিত করা, তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলা, তাদের ভয় দেখিয়ে, লোভ দেখিয়ে দল ছাড়তে বাধ্য করা। কংগ্রেসকে তারা বলে বলে ভাঙছে, পারছে না আপকে ভাঙতে, পারছে না আরজেডিকে ভাঙতে, পারছে না তৃণমূলকে ভাঙতে। আমি আড়াআড়িভাবে ভাঙার কথা বলছি, যে ভাঙনের পরে সরকার পড়ে যায়, না, সেরকম ভাঙন এখনও আসেনি এই বাংলায়। কিন্তু অখুশি? অসন্তুষ্ট? উচ্চাকাঙ্ক্ষী? অনেক অনেক আছে। একটা তাপস রায় গেছে। অবাক হবেন না নজরে অনেকেই আছেন। উত্তরবঙ্গে তুলনামূলকভাবে কম কিন্তু দক্ষিণবঙ্গে মন্ত্রী পর্যায়েরও কয়েকজনের সঙ্গে কথাবার্তা চলছে। কিছুদিন পরেই তাঁদের এক দুজন দলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে দল ছাড়বেন, তাঁরা সন্দেশখালির কথা বলবেন, দলে গণতন্ত্রহীনতার কথা বলবেন। জেলে বসেও সে আলাপ আলোচনা চলছে বলেও অনেকে জানাচ্ছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ বৃত্তের দু’ একজনের মতিগতি সুবিধের নয় বলেই মনে হচ্ছে, সম্ভবত ভোটের দিন ঘোষণার পরেই এই ভাঙনের চেষ্টা হবে। আমরা আমাদের দর্শকদের প্রশ্ন করেছিলাম, ১০ বছর ধরে বিকাশের জুড়িগাড়ি হাঁকিয়ে, বিশ্বগুরু হয়ে ওঠার পরে নরেন্দ্র মোদি আর তার সরকারকে ফিরিয়ে আনার জন্য ব্যাগ হাতে ঘোড়া কেনাবেচা করতে নেমেছেন কেন মোদি-শাহ? এ বাংলায় তৃণমূল দলকে ভাঙার জন্য কি চেষ্টা চলছে? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন?
দলের ভিতরে উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্ম নতুন কিছু নয় আর আঞ্চলিক দলে এই প্রবণতা আরও বেশি কারণ একজনের মতামত আর নির্দেশ নিয়েই দল চলে, তা সবাইকে খুশি করতে পারে না। কাজেই এক একটা নির্বাচন আসে আর তাস খেলতে বসার আগের স্টাইলে তাস ফেটানো হয়, ফুটবল সিজন শুরুর আগের মতোই দল পরিবর্তন হয়। তবে মজার কথা হল সেই ভাঙন কি একধারেই হবে? মানছি বিজেপি শক্তিশালী, কিন্তু দু’ একটা ভাঙন তো ওনাদের দিকেও হতেই পারে, তো চোখ রাখুন দক্ষিণ পরগনার দিকে, কেবল উত্তরে জন বার্লা নয়, দক্ষিণেও তেমন নেতা আছেন বিজেপিতে যিনি দেওয়াল টপকাতে রাজি, কেবল মূল্য নির্ধারণের অপেক্ষায় বসে আছেন।