৬ ডিসেম্বর কর্পোরেশন বিল্ডিংয়ের পাশে এক জনসভা করে জনচেতনা যাত্রার সূচনা হল। এই জনচেতনা যাত্রা কী? কারা করছেন? তাঁদের পোস্টার বলছে, আরএসএস-বিজেপির ক্রমবর্ধমান ফ্যাসিবাদী হামলার বিরুদ্ধে জনমত গড়তে, সাধারণ মানুষের উপর নেমে আসা সমস্ত নয়া উদারবাদী আগ্রাসনে বিরুদ্ধে, ধর্ম জাতপাত জাতির নামে উগ্র বিদ্বেষ ও হানাহানির বিরুদ্ধে, দেশজুড়ে গণতন্ত্র, প্রগতি ও সমতার লড়াইকে শক্তিশালী করতে জনচেতনা যাত্রা হচ্ছে কলকাতা থেকে বেনারস। এই দূরত্ব জনচেতনা যাত্রার মানুষজন বাসে করে যাবেন এবং যাওয়ার পথে বিভিন্ন জায়গায় সভা করবেন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। যাত্রা বেরিয়ে গেছে, সভায় ভাষণ ইত্যাদি দেওয়ার পর থেকে সভার উদ্যোক্তাদের সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট দেখে বোঝা গেল তাঁদের এই যাত্রায় শ’ দেড় দুই মানুষ আছেন। এটাও কম কথা নয়, বিবেকানন্দ নাকি শ’ খানেক মানুষ চেয়েছিলেন সমাজটাকে বদলানোর জন্য। এই জনচেতনা যাত্রার নেতৃত্বে কারা আছেন? পোস্টার বলছে মজদুর ক্রান্তি পরিষদ, সিপিআইএমএল-এর বিভিন্ন গোষ্ঠী, শ্রমজীবী নারী মঞ্চ, ফ্যাসিস্ট আরএসএস-বিজেপির বিরুদ্ধে বাংলা ইত্যাদি বেশ কয়েকটা গণ সংগঠন, এবং কিছু ইনডিভিজুয়াল। তো এঁরা কি এই প্রথম এমন কাজে নামলেন? এই প্রথম বুঝলেন যে দেশের সামনে বিরাট বিপদ আরএসএস–বিজেপি? না, এমন তো নয়। এঁদের এক বিরাট অংশ বা বলা যাক এঁরাই ২০২১-এ রাজ্য বিধানসভা ভোটের আগে মাঠে নেমেছিলেন। বাংলা জুড়ে প্রচার করেছিলেন, নো ভোট টু বিজেপি। সে প্রচারে মানুষ সায় দিয়েছিল, বিরাট প্রভাব পড়েছিল, বিজেপির বিরাট সম্ভাবনার অনেকটাই খর্ব করেছিল ওই প্রচার, নো ভোট টু বিজেপি। না, মঞ্চের নাম এমনটা ছিল না, বিভিন্ন গণসংগঠন, বিভিন্ন মানুষজন মিলে এক মঞ্চে হাজির হয়েছিলেন, মঞ্চের স্লোগান ছিল নো ভোট টু বিজেপি। তার মানে এক আপাত সফল রাজনৈতিক আন্দোলনে নেমেছিলেন যে মানুষজন তাঁরাই আবার জনচেতনা যাত্রা নিয়ে মাঠে নেমেছেন। বেশ করেছেন, মানুষকে তো বোঝাতেই হবে যে এই ফ্যাসিবাদী চরিত্রের একটা দলকে শাসন ক্ষমতা থেকে সরানো উচিত। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই জনচেতনা যাত্রার সময় ওই নো ভোট টু বিজেপি স্লোগানটা উচ্চারিতও হল না কেন? সাধারণ মানুষ সরকারের পরিবর্তন কীভাবে করবেন? কখন করবেন? সামনের নির্বাচনে। সেই কারণেই তাঁরাও এই সময়টাকে বেছে নিয়েছেন, কিন্তু ওই নো ভোট টু বিজেপি স্লোগানের সমস্যাটা কোথায়? সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, যাঁরা বলেছিলেন নো ভোট টু বিজেপি, তাঁরা আর সেই কথা বলছেন না কেন?
এক সফল আন্দোলনের ঐতিহ্য নিয়ে চলাটা কেবল স্বাভাবিকই নয়, সেটাই দস্তুরও বটে। নেতারা এক, উদ্দেশ্য এক, সংগঠন? তাও এক, কিন্তু স্লোগান উধাও। কেন? এরকমটা কি যে সংগঠনের নেতাদের ওই আন্দোলন নিয়ে, আন্দোলনের স্লোগান নিয়ে দ্বিধা আছে? থাকতেই পারে। যাঁরা সেদিন নো ভোট টু বিজেপি বলে রাস্তায় নামলেন, তাঁদের এক বিরাট অংশ এখন শাসকদলের সঙ্গেই রাস্তায় আছেন। না, বিজেপি তে যাননি, কিন্তু অন্যতম নেতা তন্ময় ঘোষ এখন তৃণমূল দলের সাধারণ সম্পাদক। অন্যতম সংগঠক যিনি তাঁর সংগঠন এবং রিসোর্স দিয়ে এই আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন সেই সামিরুল ইসলাম এখন তৃণমূলের রাজ্যসভা সদস্য, তাঁর সংগঠনের লক স্টক ব্যারেল আপাতত তৃণমূল। সেই কারণেই এত সফল আন্দোলনের সফলতম স্লোগানটা উচ্চারণ করতে দ্বিধা হচ্ছে? আচ্ছা এটাই কি স্বাভাবিক ছিল না?
আরও পড়ুন: কে নাচবে, কে গাইবে, সেটা ঠিক করে দেবে বিজেপি?
বিজেপি ছাড়া যাকে খুশি ভোট দিতে বলা হয়েছিল মানে তৃণমূল এবং সিপিএম বা বামফ্রন্টের মধ্যে তো কোনও ভেদাভেদ রাখা হয়নি। তৃণমূল জিতেছে, নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই এই আন্দোলন যে তাঁদের জিততে সাহায্য করেছে এমন কথাও বলেছেন। তারপরে যদি মঞ্চের কয়েকজন তৃণমূলেই চলে যায়, তা কি স্বাভাবিক নয়? বামফ্রন্ট জিতলে কয়েকজন বামফ্রন্টেও চলে যেতেন। এই আন্দোলন প্রচার চালানোর সময়ে কি কোথাও বামফ্রন্ট বা তৃণমূলের তুল্যমূল্য আলোচনাতে কাউকে এগিয়ে বা পিছিয়ে রাখা হয়েছিল। হয়নি তো। তাহলে আজ দ্বিধা কেন? সেদিন এই মঞ্চের সঙ্গে সিপিআইএমএল রেড স্টার ছিল। শর্মিষ্ঠা, শঙ্কর, অলীকরা ছিল। আজ শর্মিষ্ঠা বেঁচে নেই, ওই এক বিঘত দলে ফাটল ধরেছে, শঙ্কর এই নতুন মঞ্চে নেই, অলীক আছেন। কিন্তু সেটা তো এই মঞ্চের স্লোগান নির্ধারণ করেনি। তাহলে কোন পাপবোধ, কোন দ্বিধা কাজ করল? নাকি ঐতিহাসিক ভাবেই নো ভোট টু বিজেপি বলার বাস্তব কারণগুলোই উবে গেছে? আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, আজ যখন সারা দেশে এক উন্মত্ত ফ্যাসিবাদের আক্রমণ এসে হাজির, তখন সাধারণ মানুষের কাছে নো ভোট টু বিজেপিই কি এক সাধারণ স্লোগান হয়ে ওঠা উচিত নয়? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
রাজনৈতিক লড়াই আন্দোলনে সঠিক স্লোগান বেছে নেওয়া সবথেকে বড় বিষয়। মানুষের কাছে সোজা বিষয়টা সোজা করে বলাটাই প্রথম কথা। যাবতীয় ভাষণের পরে মানুষের মাথায় ঢুকেছিল এক অমোঘ স্লোগান, অনেক তর্কাতর্কির পরে, আলোচনার পরে কলকাতার ক্রিক রো-তে বসে, বাংলায় তৈরি হওয়া এই স্লোগানের অনুরণন আজ দেশজুড়ে। কৃষকরা এই স্লোগান দিচ্ছেন, শ্রমিকরা দিচ্ছেন, বিভিন্ন মঞ্চ থেকে এই স্লোগান উঠছে। সেখানে যাঁরা এই স্লোগানের উদগাতা তাঁদের কোন দোলাচল গ্রাস করল, কেন তাঁদের ব্যানার থেকে পোস্টারে, মিছিলে সভায় অনুপস্থিত আজকের সবথেকে দরকারি স্লোগান নো ভোট টু বিজেপি?