ট্রাম্পের সমস্যা সারা দুনিয়ার দখলদারি নিয়ে, আমাদের শুভেন্দু অধিকারীর সমস্যা এই বাংলা নিয়ে। অনেকে বলছেন, আলোচনা চলছে দিলীপ ঘোষ নাকি নতুন দল খুলবেন। আমার একবারের জন্যও সেটা মনে হয় না। তবে বাংলা বিজেপি বা বঙ্গ বিজেপি নামে একটা নতুন দল খুলতেই পারেন আমাদের শুভেন্দু অধিকারী, ইন ফ্যাক্ট সেটাই তাঁর এসকেপ রুট হয়ে উঠতে পারে। তো সে নিয়ে আর একদিন ডিটেলে আলোচনা করব। আজ আলোচনা কাঁথির খোকাবাবুর সমস্যা নিয়ে, যা নাকি এখন বঙ্গ বিজেপিরও সমস্যা। ২০১৯-এর পরে ২০২১-এর স্লোগান অবকি বার ২০০ পার। বাইরে যে দলের তখনও ডাবল ডিজিট এমএলএ নেই, তাঁরা চেল্লাচ্ছিলেন ২০০ পার? কেন? কার ভরসাতে? মুকুল রায়? সে দম তেনার নেই, ইনফ্লেটেড পেপার টাইগার, ততদিনে বিজেপি দিল্লি নেতৃত্ব তা বুঝে ফেলেছিলেন। তাঁরা একজনকে খুঁজছিলেন যিনি বিজেপির চেয়েও নোংরাভাবে মুসলমানদের দিকে ঘৃণা ছুড়ে দিয়ে এক প্রবল মেরুকরণের রাজনীতি করতে পারেন। সেখানে খাপে খাপ পঞ্চুর বাপ পেয়ে গেলেন তাঁরা, শুভেন্দু অধিকারী, তিনিই হয়ে উঠবেন আগামী দিনে এই বাংলার হিমন্ত বিশ্বশর্মা। যিনি প্রকাশ্যেই চটি হাতে তেড়ে যেতে পারেন, যাঁকে দেশের নেত্রী বলেছিলেন তাঁকে বেগম মমতা বলে তাচ্ছিল্য করতে পারেন আর যিনি তৃণমূলের দুর্নীতির অন্যতম স্তম্ভ হিসেবেই দুর্নীতির সব ফাঁকফোকরগুলো জানেন। হ্যাঁ ওনার ভরসাতেই অবকি বার ২০০ পার, বাকি সব খুচরো, দু’কড়ি, তিনকড়ি, নকড়া ছকড়ারা। তো হল কী? ৭৭-এ ধপাস। সে সাতাত্তরও পূর্ণিমার চাঁদের মতো ক্রমশ ক্ষয়ে যাচ্ছে। সেই বিজেপির উত্থানের চাবিকাঠি কি পাওয়া গেল? সেটাই বিষয় আজকে, শুভেন্দুর সমস্যা, বিজেপির সমস্যা।
কালীগঞ্জের ফলাফল বার হচ্ছিল আর শুভেন্দু হিন্দু ভোটের ৭৩ শতাংশ পাচ্ছেন বলে দাবি করছিলেন। তিনি নিজেও জানেন, সব্বাই জানে যে সেই অঙ্ক ক্লাস থ্রি-র ফেল্টুস ছাত্রও ধরে ফেলবে। কিন্তু তিনি আউট অফ ডেসপারেশন, কিছু একটা বলে আপাতত মুখ বাঁচাতেই হবে তাই বলছিলেন। কেন? কারণ এই ২০২৪-এর লোকসভার নির্বাচনের পরে সাকুল্যে ১১টা উপনির্বাচন হয়েছে আর তার প্রত্যেকটাতে হেরেছে বিজেপি। কেবল হারেনি উত্তর থেকে দক্ষিণে ধারাবাহিকভাবেই ভোট কমেছে। কেন?
আরও পড়ুন: Aajke | কালীগঞ্জ বলে দিল ২০২৬-এ আবার মমতা
তার প্রথম কারণ হল আমাদের কাঁথির খোকাবাবু যত বিষ ছড়িয়েছেন তত রাজ্যের সাধারণ বাঙালি মুসলমানদের ভোট জড়ো হয়েছে দিদিমণির পাশে, ওদিকে হিন্দু ভোট? তাহলে মনে করাই, একটা কনজারভেটিভ এস্টিমেট বলছে রাজ্যে কমবেশি ১০ কোটি মানুষ আছে, তো কাঁথির দাদাবাবু বলেছিলেন তার মধ্যে ২ কোটি নামবে রাস্তায় এই রামনবমীতে, নেমেছিল কত? উত্তর থেকে দক্ষিণে হিসেব বলছে কমবেশি ২ লক্ষ মানুষ নেমেছিলেন রাস্তায়, এরমধ্যে আবার তৃণমূলের ছিল হাজার ৫০, তাঁরাও হাতে গদা, হাতে ত্রিশূল, গেরুয়া ফেট্টি পরেই নেমেছিলেন, ফারাক ছিল ওই এক চিলতে তেরঙ্গা আর ঘাসফুলের ফ্ল্যাগ-এ। তৃণমূল নেমেছিল রাস্তায় এটাই জানান দিতে যে আম্মো আছি, আমরাও হিন্দু, বোলপুরে রামনবমীর মিছিলে কেষ্ট মোড়ল হাঁটলেন, পাল্লা দেওয়ার ব্যাপার তো ছিলই, কাজেই কাজল শেখ কেবল হাঁটলেন না, ত্রিশূল হাতে হাঁটলেন, ধর্মনিরপেক্ষতার হদ্দমুদ্দ করে ছেড়েছেন। ওদিকে বাগুইআটির তাপস চ্যাটার্জি তো আদতে সিপিএম ছিলেন, মার্কসবাদী, তো তিনি মুসলমান মানুষজনদের সঙ্গে রাখলেন, বিজেপির মিছিল এল, প্রত্যেককে মিষ্টি খাওয়ালেন, উনি নিজে নয়, সেই স্থানীয় মুসলমান মানুষজনই খাওয়ালেন, নে খা। তাঁরাও সোনামুখ করেই খেলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা ছাড়া পাড়ায় টেকা দায়। কিন্তু এই সব রগড়ের মাঝে হারিয়ে গেল আমাদের কাঁথির খোকাবাবুর ২ কোটির সেই প্রবল হুঙ্কার, দেড় লাখ মানুষও নামল না আর মিডিয়ার আর্ক লাইটের অনেকটাই কেড়ে নিল এই রাজ্যজুড়ে তৃণমূলের হিন্দুত্ব, মুখের উপর তাঁরা বললেন রাম কি কারও বাবার? একইভাবে জগন্নাথ দেব নিয়ে দলে তো বিদ্রোহ, মাথায় দিলীপ ঘোষ। মানে ওই হিন্দু ভোটের মেরুকরণ হচ্ছে না, হচ্ছে না তার বড় কারণ মমতা সরকারের বিভিন্ন ডাইরেক্ট বেনিফিশিয়ারি প্রকল্প আর দু’ নম্বর হল তৃণমূলের নেতারা অনায়াসে হিন্দু, পরম হিন্দু হয়ে উঠতে পারেন যা বামেদের পক্ষে সম্ভব নয়। সব মিলিয়ে ২০২১-এর ৭৭-এ থমকে যাওয়া, ২০২৪-এ ১৮ থেকে কমে ১২ হয়ে যাওয়া নিয়ে দলের মধ্যে বিদ্রোহ, প্রশ্ন, বিক্ষোভ আর ২৪ থেকে সবকটা নির্বাচনে ধারাবাহিকভাবেই ভোট কমে যাওয়ার ছবিই দিল্লির নেতাদের কপালে ভাঁজের কারণ। তাঁদের অনেকেই বলা শুরু করেছেন যে ভুল ঘোড়ার উপরে বাজি ধরা হয়ে গেছে। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম যে ২০২৪-এর পর থেকে ১১টা উপনির্বাচন হয়েছে, ১১টাতেই বিজেপি কেবল হেরেছে এটাই কথা নয়, বিজেপির ভোটও ধারাবাহিকভাবেই কমেছে। এটার জন্যে বিজেপির অনেকেই শুভেন্দু অধিকারীর দিকে আঙুল তুলেছেন, আপনাদের কী মনে হয়? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
মমতা যে পথে চলছেন, সেই পথ তো দেখিয়েছেন রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, রামমোহন, আরও অনেকে। তারপরে এই আর্য, ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্ম ব্যবস্থার বিরুদ্ধেও বাংলার প্রতিবাদী ধর্ম প্রচারকরা আছেন, চৈতন্য থেকে লালন থেকে গুরুচাঁদ ঠাকুর। এই মনীষীদের সর্বধর্ম সমন্বয় বা ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ধারণাই এই বাংলাতে বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ব বা রাম-কেন্দ্রিক হিন্দুত্বকে বেড়ে উঠতে দিচ্ছে না। এখানেই তো শেষ নয়, এরও উপরে গোদের ওপর বিষফোঁড়া, রবি ঠাকুর, নজরুল। মানবতাবাদ আর হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির যে পাঠ তাঁরা দিয়ে গিয়েছেন তা ওই রিপাবলিক উচ্চিংড়ের কর্কশ চিৎকারে মুছে যাবে তেমন তো নয়। এবং শুভেন্দুর সমস্যা বাড়াতে এক দীর্ঘ বাম আন্দোলনের ইতিহাস এই ভূমিতে ওনাদের রাজ্যজোড়া গ্র্যান্ড প্ল্যানের বীজ ছড়াতেই দিচ্ছে না। আর এসব ছেড়ে দিয়েই যদি কেবল ধর্মই দেখেন, সেখানেও দাদার যাবতীয় পরিকল্পনায় গ্যামাক্সিন ছিটিয়ে দিয়ে গেছে বাংলার প্রাচীন সময় থেকে বারো মাসে তেরো পার্বণের আবহ। এই আবহে বিজেপি বেড়ে উঠবে? না, তা অসম্ভব।