সেই শিকারির গল্প, যিনি বন্দুক হাতে বাঘ শিকারে বেরিয়েছিলেন, তিনি বাঘের পিছু পিছু যাচ্ছিলেন কিন্তু বুঝতেই পারেননি বাঘই তার পিছনে আছে, দিনের শেষে শিকারির দেহ পাওয়া যায়নি, কেবল বন্দুকটা মিলেছিল। তো আমাদের বাংলাতে ভোটের সিজন এলেই বিজেপির নেতারা চার ফেলে, বঁড়শি নিয়ে বসে পড়েন, কিছুদিন পর পর দেখান কেমন মাছ বিঁধেছে বঁড়শিতে, পাড়াপড়শি দেখে আমোদ পায়। তো এবারেও সেই পর্ব চালু কিন্তু অন্য দিকেও কি শিকারি নেই? শিকার হবে না। হতেই পারে, খিদে থাকলেই মাছ টোপ গেলে আর উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকলেই দলবদল হয়। আমাদের রাজ্যে বিজেপির সংগঠনে তেমন মানুষ কম নেই, নেই বলেই তো কচুবনে লাথি খেয়ে পড়ে থাকা জয়প্রকাশ তৃণমূলেই যোগ দিয়েছেন। নেই বলেই তো মাত্র ক’দিন আগেই প্রধানমন্ত্রীর সভা আলো করে বসে থাকা মুকুটমণি চলে এলেন তৃণমূলে, কিন্তু এখানেই কি লিস্ট থামবে? না, ভোটের আগে দুধারেরই সে সব উচ্চাকাঙ্ক্ষীদের ছবি সামনে আসছে। আড়ালে আবডালে নয়, প্রকাশ্যেই সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষীদের অনেকেই তাঁদের আকাঙ্ক্ষার কথা জোর গলাতেই জানাচ্ছেন, এবং অনেকেই এরকমও গাইছেন, অন্তত গেয়ে রাখছেন যে নব্য বিজেপিদের দলই যদি নেতৃত্বে এসে যায়, তাহলে দল করে আর লাভ কী? কাজেই খেলা শুরু হয়ে গেছে, নদীর একধারে পাড় ভাঙছে, এক ধারে তাপস রায়ের দল তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যাচ্ছেন, মুকুটমণি তৃণমূলে যাচ্ছেন। অন্য আরও অনেকেই কিন্তু তৈরি হচ্ছে। এ বাংলায় চলছে প্রস্তুতি পর্ব, আজ যাকে দেখছেন বন্দেমাতরম বলে গলা ফাটাতে, তিনি কিছুদিন পরে জয় শ্রী রাম বলতেই পারেন, আজ যিনি মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায় বলে খুশি তিনিই ক’দিন পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়ন যজ্ঞে ঝাঁপ দেবেন না, এমন কথা গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায় না। কেউ কেউ বলবেন যাক, বামেরা এর থেকে মুক্ত। না মশাই, সেখানে যা হওয়ার তা হয়ে গেছে, হাতে চে গ্যেভারার ট্যাটু নিয়ে কমরেড এখন বিজেপি, ঝকঝকে ছাত্রনেতা একদা সাংসদ তৃণমূলে তো কবেই গেছেন। আপাতত ভাঙনের পর, ক্ষয়ের পরে সেখানে ভাঙার জন্য উপযুক্ত ক্ষেত্র নেই, থাকলে ভাঙত। তবে এটাও তো স্বীকার করাই যায় যে বামাদের মধ্যে আদর্শগত কমিটমেন্ট অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি। যাই হোক আমাদের আলোচনা এ বাংলাতে বিজেপির সম্ভাব্য দলত্যাগ নিয়ে আর সেটাই বিষয় আজকে, জন বার্লা, শান্তনু ঠাকুর কী করতে চলেছেন?
আপাতত যা ভাবাই সম্ভব নয়, অ্যাট লিস্ট বিজেপির কোনও নেতার পক্ষে ভাবাও সম্ভব নয় সেটাই করে দেখালেন শান্তনু ঠাকুর। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি হেলিকপ্টারে উড়ে গেলে তলাতে এমএলএ-এমপি হাতজোড় করে যাত্রাপথে দাঁড়িয়ে থাকে, কারণ মোদিজি নাকি সব দেখতে পান। তিনি তাঁর যাত্রাপথে ওই উপর থেকেই লয়াল, অনুগত এমএলএ-এমপিদের দেখতে পাবেন। সেই হেন নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদির জনসভা, যা হচ্ছে তাঁর এলাকাতে, শান্তনু ঠাকুর তাঁর ব্যক্তিগত কাজ আছে বলে গেলেনই না।
আরও পড়ুন: তাপস রায় দল ছাড়লেন, লাইনে আর কারা আছেন?
ভাবা যায়? মোদিজির সভা তো আগেরদিন রাতে ঠিক হয়নি, দিন ২০ আগে ঘোষিত জনসভাতে সাংসদের এমন কী ব্যক্তিগত কাজ পড়ল যে তিনি জনসভাতে হাজিরই থাকলেন না? মোদিজি ভাষণ দেবেন বারাসতে, না মতুয়ারা দল বেঁধে খোল করতাল নিয়ে হাজির থাকলেন না। কার নির্দেশে এটা হতে পারে? কেন হল সেটাও জানা। শান্তনু ঠাকুর আজ বছর চারেক ধরেই বলে যাচ্ছেন, সিএএ লাগু হল বলে এবং সমস্ত মতুয়ারা নাগরিকত্ব পাবেন। কেন বলছেন জানা নেই, কিন্তু বলছেন। যে মতুয়ারা তাঁকে নির্বাচিত করে দিল্লি পাঠালেন, যাঁদের ভোটে জিতে তিনি সাংসদ মন্ত্রী সেই নির্বাচকমণ্ডলীকে কেন আবার করে নাগরিকত্ব পেতে হবে তা জানা নেই, কিন্তু তিনি বার বার বলেছেন নাগরিকত্ব দেওয়া হবে, সিএএ লাগু হবে। মজার কথা হল প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে একবারের জন্যও সেই সিএএ বা নাগরিকত্ব নিয়ে একটা কথাও বললেন না। মোদিজিকে যাঁরা জানেন তাঁরা ভালো করেই জানেন মোদিজি আর যাই পছন্দ করুন না কেন, ডিসেন্ট, বিদ্রোহ পছন্দ করেন না। বিশ্বাস না হলে হরেন পান্ডিয়ার মাকে জিজ্ঞাসা করুন, গুজরাতের হোম মিনিস্টার হরেন পান্ডিয়া তো খুন হয়ে গেছেন সেই কবে, তিনি তো জবাব দিতে পারবেন না, তাঁর মা এই মৃত্যুর জন্য সরাসরি অভিযুক্ত করেছিলেন নরেন্দ্র মোদিকে। হ্যাঁ, মোদিজি বিরোধিতা পছন্দ করেন না। অন্যদিকে আমাদের উত্তরের জন বার্লা, টিকিট পাননি, বদলের ক্যান্ডিডেটকে প্রকাশ্যেই হুমকি দিয়েছেন, মনোজ ছোড় দে তেরা ক্যান্ডিডেচার, নহি তো ঘুসনে নহি দেঙ্গে। কী কাণ্ড বলুন তো। খানিক গব্বর সিংয়ের মতো আবদার, ইয়ে হাত মুঝে দে দে ঠাকুর। দলের হাই কমান্ড জানিয়েছে, মনোজ টিগগা নির্বাচনে লড়বেন, জন বার্লা বলছেন লড়লে এলাকাতেই ঢুকতে দেব না, আফটার অল এখনও জন বার্লা তো মন্ত্রী। কাজেই দুই মন্ত্রীর গোসাঘরের দিকে নজর রেখেছি আমরা, আপনারাও রাখুন। এই ক্ষোভ ও বঞ্চনার অভিযোগ ক্রমশ দলে গণতন্ত্রহীনতা, মণিপুর ইত্যাদির প্রসঙ্গে নিয়ে যেতেই পারে। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, প্রধানমন্ত্রীর জনসভাতে ব্যক্তিগত কাজের অজুহাত দেখিয়ে মন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর বা টিকিট না পেয়ে জন বার্লার প্রকাশ্যেই হুমকি কি আগামী দিনে বিজেপিতে বিপত্তি ডেকে আনতে পারে? শুনুন কী বলেছেন মানুষজন।
ওই যে বহুবার বলেছি, আরএসএস থেকে বিজেপি হয়ে ওঠা দিলীপ ঘোষ, শমীক ভট্টাচার্যদের থেকে শুভেন্দু অধিকারী, জন বার্লা বা শান্তনু ঠাকুর যাঁরা কদিন আগেই অন্য দল করতেন, তাঁরা আলাদা। কোনও আদর্শ নয় নির্ভেজাল ক্ষমতা আর ধান্দাবাজির জন্যই এঁরা দল বদলেছেন, কাজেই স্বার্থে আঘাত লাগলে ওঁরা আবার পাল্টি খেতে এতটুকু সময় নেবেন না। আপাতত তৃণমূলে, কিন্তু তাতে কী? ওই জয়প্রকাশ, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় বা প্রবীর ঘোষালদের দেখেই সেটা বুঝে নেওয়া সহজ।