শনিবার বেলা দশটার পরে
জজকোর্টেতে লোক না ধরে মাগো
হল অভিরামের দ্বীপচালান মা ক্ষুদিরামের ফাঁসি।
হ্যাঁ, ১৮ বছর বয়সে এক বাঙালি যুবকের ফাঁসি হয়েছিল, দেশ তোলপাড় হয়েছিল, বাল গঙ্গাধর তিলক লিখেছিলেন স্বরাজ চাই। সেই ক্ষুদিরাম বসু বলিউডের চক্রান্তে ক্ষুদিরাম সিং আর সহযোগী প্রফুল্ল চাকীর নামটাও বাদ পড়েছে, তিনি হয়েছেন বীরেন্দর সিং। অক্ষয় কুমারের কেশরী টু ছবিতে। আর নায়ক কৃপাল সিং, ইনিই সিনেমার নায়ক, যিনি দেশসুদ্ধ বিপ্লবের আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করছিলেন, ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করেছে। তো এই কৃপাল সিং কে? ইতিহাস ঘেঁটে যা পাওয়া গেল তাতে একজনই বিখ্যাত কৃপাল সিং আছেন, তিনি বিশ্বাসঘাতক, হ্যাঁ সাভারকরের বহু আগে তিনি সম্ভবত দেশজোড়া বিশ্বাসঘাতকদের মধ্যে অন্যতম। ১৯১৫, উত্তর ভারত জুড়ে এক বিপ্লবের পরিকল্পনা হয়েছে, ফোর্ট উইলিয়ামে সেই বিপ্লবের পরিকল্পনা গেছে, নিয়ে গেছেন বাঘা যতীন, জার্মানি থেকে অস্ত্র আসবে, মাথায় মহানায়ক রাসবিহারী বসু, মহারাষ্ট্রের ভার গণেশ পিংলের হাতে, উত্তরপ্রদেশ বা মধ্য ভারতের ভার শচীন্দ্রনাথ সান্যালের ওপর। হঠাৎ এই বিপ্লবের খবর চলে গেল ব্রিটিশদের কাছে, আয়ারল্যান্ডের কিছু বিপ্লবীদের ডাবল এজেন্ট কৃপাল সিংয়ের বিশ্বাসঘাতকতায় ধরা পড়ে গেল সব কিছু। অস্ত্র বোঝাই জাহাজ এস এস ম্যাভেরিক ধরা পড়ল, বালেশ্বরে বুড়ি বালামের যুদ্ধে মারা গেলেন বাঘা যতীন। শচীন সান্যাল গ্রেফতার হন, আন্দামানে পাঠানো হয়। হ্যাঁ, কৃপাল সিংয়ের বিশ্বাসঘাতকতায়। তো অক্ষয় কুমার অ্যান্ড কোম্পানি বিপ্লবীদের নাম খুঁজতে গিয়ে এক বিশ্বাসঘাতকের নাম দিয়েই কাহিনি শুরু করে ক্ষুদিরামকে সিং বানিয়েছেন, সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, ক্ষুদিরাম সিং? দেশদ্রোহী সাভারকরের বাচ্চাদের বাঙালিকে অপমান।
বাঙালিরা হিন্দি সিনেমাতে বহুদিন ধরে ভাঁড়, এখন স্বাধীনতা সংগ্রামের সিনেমা করতে গিয়ে ভারি সমস্যাতে পড়েছে হিন্দি সিনেমার প্রযোজক আর পরিচালকেরা, গুজরাটি নাম তো একটাও নেই, যিনি আছেন তিনি মহাত্মা গান্ধী, তাঁকে ছুঁলেই ইডি ধরবে। প্যাটেলের মূর্তি গড়া যায়, সিনেমায় সুবিধে হবে না। ভগৎ সিং তো কমিউনিস্ট। মহারাষ্ট্রের বিপ্লবীরা সাভারকর বিরোধী, পড়ে রইল বাংলা, তাদের নেতা নেতাজি সুভাষ বসু হিন্দু মহাসভার নেতা আজকের বিজেপির মহান আইডল শ্যামাপ্রসাদের টাকে আব গজিয়ে দিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন: Aajke | ১০০ দিনের কাজের বকেয়া টাকা সাধারণ মানুষ কবে পাবেন?
তাহলে উপায়? ক্ষুদিরাম বসুকে বানিয়ে দাও ক্ষুদিরাম সিং, প্রফুল্ল চাকীকে বীরেন্দর সিং আর হেমচন্দ্র কানুনগো, এঁদের হাতে যিনি বোমা তুলে দিয়েছিলেন, বা বারীন ঘোষ যাঁর পরিকল্পনায় কিংসফোর্ড হত্যার পরিকল্পনা হয়েছিল, তাকে কৃপাল সিং বানিয়ে দাও। এবং দেখবেন এই ছবি বাংলার মাল্টিপ্লেক্সে রমরম করেই চলবে, কারণ সেগুলোও তো গুজুমাড়ুদের দখলে, সেগুলোতে এখন এগ রোল চিকেল রোল পাওয়া যায় না, ভেজ মোমো বিক্রি হয়। সবটাই গুজরাটি স্টাইল। এবং এটা প্রথমবারও নয়, এর আগে এক জোচ্চর গুমনামী বাবাকে নেতাজি সাজিয়ে মহান চলচ্চিত্রকারের ছবি আমরা দেখেছি, হাততালিও দিয়েছি, কেবল একবারও ভাবিনি যে নেতাজির মতো এক সাহসী, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানুষের পক্ষে স্বাধীন ভারতবর্ষে লুকিয়ে থাকাটা সম্ভব ছিল কি না? আরও আছে, জি ফাইভের এক ওয়েব সিরিজে থানায় অপরাধীদের ছবি ঝোলানো ছিল, তারমধ্যে ক্ষুদিরামের ছবিও ছিল। বাঙালি সে ছবি দেখে আঁতকে উঠেছে, সচেতনভাবেই বাঙালি বললাম, ভারতবর্ষের অন্য কোনও প্রান্ত থেকে আঁতকে ওঠার খবর পাওয়া যায়নি। বিক্ষোভ জমায়েত করার কথা হয়েছে, ফেসবুকে উপচে পড়ছে প্রতিবাদ, এক অভিনেত্রী ছি-এর পরে বিসর্গ দিয়ে তাঁর ঘৃণা প্রকাশ করেছেন, এক অভিনেতা সাতসকালে ভিডিও তৈরি করে ছেড়ে দিয়েছেন। সত্যিই প্রতিবাদ করার মতো বিষয়। যে ছেলেটি, ফাঁসিকাঠে প্রাণ দিল দেশ স্বাধীন করার জন্য, তার ছবি স্বাধীন দেশের থানায় অপরাধী তালিকায়। কারণ ওই অভিনেতা বা অভিনেত্রী জানেন, ‘তখত পলট’ হতেই পারে, এবং হলে বিভিন্ন কমিটির চেয়ারম্যান, লক্ষ টাকার মাসোহারা, গাড়ির তেল, কাউন্সিলারের পদ বা এমপি-এমএলএ হওয়ার চান্স আছে, তাঁদের কণ্ঠে হিরণ্ময় নীরবতা তখন। স্বাধীন ভারতবর্ষের থানায় মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় ১৮ বছর ৭ মাস ১৪ দিনের কিশোর, হাসতে হাসতে ফাঁসিকাঠে চড়েছিল এই ভেবে যে সে দেশ স্বাধীন করতে নেমেছে, একদিন দেশ স্বাধীন হবে। জানতই না যে, সে সেই স্বাধীন দেশেও মোস্ট ওয়ান্টেড ক্রিমিনাল থেকে যাবে। সে ভারতীয় হবে না, সে ‘পোচা মাছ খানেবালা’ এক কমিউনিটির লোক হবে, যে কমিউনিটি তাকে নিয়ে রগড় করবে, ক্ষুদিরাম জানতেনই না যে তাঁর পিতৃদত্ত পদবি বোস হয়ে যাবে সিং। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম যে ওই ছবি, যেখানে ক্ষুদিরাম বোসের বদলে ক্ষুদিরাম সিং, প্রফুল্ল চাকীর বদলে বীরেন্দর সিং বলে চালানো হচ্ছে, সেই ছবি বাংলাতে রিলিজ করতে দেওয়া উচিত কি না? আর রিলিজ হলে তা চলতে দেওয়া উচিত কি না? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
আসলে সাভারকরের বাচ্চাদের ওই সমস্যাটা থেকেই গেছে, সব্বাই জেনে ফেলেছে যে সাভারকর একজন বিশ্বাসঘাতক, সাভারকর মুচলেকা দিয়ে আন্দামান জেল থেকে বেরিয়েছিলেন। যখন আমরা এই কথা বলি, তখন কিছু পণ্ডিত সাভারকরের বাচ্চা বলেন কেন তোমাদের শচীন্দ্রনাথ সান্যালও তো ব্রিটিশদের কাছে এক্কেবারে একই বয়ানে মুচলেকা দিয়েই জেল থেকে বের হয়েছিলেন। একদম সত্যি। তারপরে? সাভারকর জেল থেকে বেরিয়ে ইংরেজদের সেবা করেছিলেন, গান্ধী-হত্যার পরিকল্পনার অন্যতম মাথা হয়েছিলেন আর শচীন সান্যাল? জেল থেকে বেরিয়ে হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন তৈরি করেছিলেন, যা কিছুদিন পরে ভগৎ সিংয়ের নেতৃত্বে হিন্দুস্তান রিপাবলিকান সোশ্যালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন হয়েছিল। ১৯২৭ সালে কাকোরি ষড়যন্ত্রের আসামী হিসেবে তিনিই একমাত্র বিপ্লবী যাঁকে আবার আন্দামানে পাঠানো হয়েছিল। সেই বাঙালির, বাংলার অসম্মান আমরা মেনে নেব কি না? সরকার মেনে নেবে কি না? তা আলোচনা করার প্রয়োজন আছে বইকী।