আমি নিশ্চিত অন্য যে কোনও সরকার হলে হাত তুলে নিত, সাফ জানিয়ে দিত। হ্যাঁ, দুর্নীতির অভিযোগ এসেছে, তার তদন্ত চলছে, আদালত রায় দিয়েছে, আমরা আদালতের রায় মেনে ওই ২৬ হাজারের চাকরি বাতিল করছি, তাদের মাইনে ফেরতের বিষয়টাও দেখে নিচ্ছি এবং সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ মতোই নতুন পরীক্ষার ব্যবস্থা করছি, যাঁরা সেখানে চাকরি পাবেন, তাঁরা চাকরি করবেন। আইন মেনে এই কথা না বলার তো কিছু ছিল না। ত্রিপুরাতে বাম আমলেই তো এমন হয়েছে, ১০ হাজার শিক্ষকের চাকরি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, সরকার হাত তুলে নিয়েছে, সে সময়ে বিরোধী বিজেপি দলের থেকে সেই আন্দোলনরত শিক্ষকদের সমর্থন দেওয়া হয়েছে, সরকার পাল্টেছে এবং বিজেপি তাদের স্বাভাবমতো চোখ উল্টিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, আইন আইনের মতোই চলবে, সেই শিক্ষকরা রাস্তায় নেমে মিছিল করতে গিয়েছিলেন বেধড়ক ঠ্যাঙানি খেয়ে রণে ভঙ্গ দিয়েছেন। ত্রিপুরার সঙ্গে বাংলার যোগাযোগ তো খুব খারাপ নয়, তো এখনকার বিপ্লবী উকিলরা তো তখন দুধের বাটির শিশু ছিলেন না, তাঁদের একজনকেও দেখা যায়নি। একই ঘটনা ঘটেছে উত্তরপ্রদেশেও, একজন মুখ্যমন্ত্রীকে দেখেছেন শিক্ষকদের ডেকে বলছে ধৈর্য ধরুন আমি আপনাদের পাশে আছি? আইন আইনের মতো চলুক বলে চোখ উল্টে চলে গেলে মমতা সরকার পড়ে যেত বলে যাদের ধারণা তাদের বলি, আগামী দিনে এই ঘটনাতে যদি ২৬ হাজারের চাকরি চলে যায়, যদি সরকার তাদের পাশে নাও থাকে তাহলেও এই সরকারের স্থায়িত্ব নিয়ে কোনও প্রশ্নই উঠবে না কারণ এই সরকারের সমর্থনভূমি, ভিত্তিভূমি এই ২৬ হাজার চাকরির উপরে নির্ভরশীল নয়। কিন্তু যেটা দেখার সেটা হল এই এত রকমের বিরোধিতার পরেও মুখ্যমন্ত্রী বারবার কথা বলছেন, চেষ্টা করছেন আর প্রতিটা পদক্ষেপে বোঝানোর চেষ্টা করছেন যে আমি আছি, এটা কি কম কথা? সেটাই বিষয় আজকে, মানবিক মমতা।
চাকরি চুরি হয়েছে? নিশ্চয়ই হয়েছে, আর সেই জন্যই তো তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী সমেত এতজন নেতা আমলারা জেলে, এখন তাঁরা দোষী নাকি নির্দোষ, তা তো আদালত নির্ধারণ করবে। তদন্তও চলছে, কিন্তু সব মিলিয়ে রাজ্য সরকারের, শিক্ষা দফতরের যে ভালো রকমের গাফিলতি ছিল, তা পরিষ্কার। আর একটা কথাও না বললেই নয় যে, যে সময়ে এই অভিযোগ উঠে আসছে, সেই সময়েই এই অভিযোগের দিকে গুরুত্ব দিয়ে নজর দিলে বিষয়টা এত জটিল হত কি?
আরও পড়ুন: Aajke | বিড়ালের গলায় ঘণ্টাটা বেঁধে দিলেন মমতা
কিন্তু এটা ঠিক যে এক শ্রেণির উকিলরা বা এক নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ইচ্ছে এই সমস্যাকে এমন এক জায়গাতে এনে দাঁড় করিয়েছে যা কাম্য ছিল না। ২৬ হাজার মানুষের চাকরি কি কম কথা। এই ২৬ হাজার মানুষের উপর কত মানুষের নির্ভরতা, একটা গোটা প্রজন্মের ছাত্রদের ধ্যানধারণা বিশ্বাস সবই সত্যি এক দুঃসময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। একজন পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ হিসেবে, আইন আইনের পথে চলুক বলে হাত ধুয়ে নিতেই পারতেন মুখ্যমন্ত্রী, যেমনটা নিয়েছিলেন মানিক সরকার বা বিপ্লব দেব। না, বরং তিনি প্রতিটা পদক্ষেপে শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলছেন, তাঁদের জটিলতাগুলো জানাচ্ছেন, সরকার কী করছে তাও জানাচ্ছেন? কেন? এই দায় কেন? কারণ তিনিও জানেন এক শ্রেণির তৃণমূল নেতা, মন্ত্রীদের জন্যই শিক্ষকরা আজ রাস্তায়, সেই দায় চোকাতেই নিজের থেকেই বার বার একটা সমাধানের চেষ্টা করে চলেছেন। যদি সত্যিই এই ২৬ হাজার মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে এতটুকু সংবেদনশীলতা থাকত তাহলে বিকাশবাবু শামিমবাবুদের এগিয়ে আসা উচিত ছিল, এইটা হয়েছে, এটা হলে বিষয়টা মেটানো যায়, বিরোধী দলনেতার এগিয়ে আসা উচিত ছিল ওই ২৬ হাজার শিক্ষকের স্বার্থে, কিন্তু সম্ভবত রাজনীতির রুটির স্বাদ আর গন্ধে লেগে থাকে মানুষের অসহায়তা, তাই তাঁরা ডুবন্ত নৌকা আরও কতটা ডোবে তা দেখার জন্য আগ্রহ নিয়ে বসে আছেন, জানিয়েই দিয়েছেন প্রকাশ্যেই, কিচ্ছু হবে না, ওই ২৬ হাজারের চাকরি যাবেই। হতে পারে, হতেই পারে তিনি যা বলছেন, তাঁরা যা বলছেন তাই সত্যি হল, কিন্তু হবেই, সেই গ্যারান্টি কে দেবে? কারণ আপনাদের মনে করিয়ে দিই, এই পণ্ডিত জ্ঞানী উকিলেরা বলেছিলেন যে অধিগ্রহণ করা জমি আর ফেরানো যাবে না, সিঙ্গুরের জমি আর কোনওমতেই চাষিদের আইনত ফেরানো যাবে না। তাঁরা ভুল বলেছিলেন আজ তা প্রমাণিত, তাঁরাই আইনের শেষ কথাটি জেনে ফেলেছেন সে দাবি তাঁরা করেন বটে, কিন্তু সেই দাবি সত্যি নয় আমরা জেনে ফেলেছি। সে থাক, কিন্তু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যে ভূমিকা আজ নিয়েছেন, সেই ভূমিকা আমাদের মনে থাকবে। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, সেই শুরুর দিন থেকেই মুখ্যমন্ত্রী শিক্ষকদের চাকরি যাতে থাকে, শিক্ষকদের এই অসহায়তার মধ্যে যেন না পড়তে হয়, তারজন্য নিয়ম করে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছেন, তাঁদের নিয়ে কথা বলেছেন, যে ভূমিকা আমরা এর আগে কোনও মুখ্যমন্ত্রীর দেখিনি। এটাই কি সেই মানবিক মমতার মুখ যা তাঁকে আজও সমান জনপ্রিয়তার শিখরে রেখেছে? শুনুন মানুষজন কী বলছেন।
আবার বলছি এক সীমাহীন দুর্নীতি হয়েছে, কারা কতটা জড়িত, কীভাবে এই দুর্নীতি হল তা নিয়ে তদন্ত চলছে, না কোনওভাবেই এই তদন্তের কোনও স্তরে মুখ্যমন্ত্রী বা পুরো মন্ত্রিসভা এই দুর্নীতিতে জড়িত, তেমন কোনও অভিযোগ আসেনি। কিন্তু এতে যে তৃণমূল দলের নেতা-কর্মীরা আছে সেটা তো অস্বীকার করা যাবে না। সম্ভবত এটাই আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর দুর্ভাগ্য যে তাঁর পাশাপাশি কর্মী নেতাদের যে সততা তিনি আশা করেছিলেন সেই সততার প্রমাণ তাঁরা দেননি, উল্টে বহুক্ষেত্রে তাঁদের এই অসততা সরকার আর দলকে বিপন্ন করে তুলেছে।