ব্রিগেড শুনেছে হেঁই সামালো ধান হে, কাস্তে টা দাও শান হে, ব্রিগেড দেখেছে বামফ্রন্ট সরকারকে চোখের মণির মত রক্ষা করার শ্লোগান নিয়ে আসা বিস্তর মানুষ, ব্রিগেড দেখেছে বোফর্সের কমিশন খাবার দায়ে রাজীব গান্ধীর কুশপুত্তলিকা পুড়তে বা এই বাংলায় কংগ্রেসী গুন্ডাদের মলোটভ ককটেলে পুড়ে যাওয়া শহীদদের ছবি নিয়ে মিছিল ঢুকতে। এই ব্রিগেড শুনেছে মাথা ভেঙে দেবো বক্তৃতা, এই ব্রিগেডে এসেছে ন্যানো গাড়ির কাট আউট কিন্তু এই প্রথম এই ব্রিগেডে লাল সমাবেশে সবথেকে ওপরে উড়লো তেরঙ্গা পতাকা, যে উত্তাল যৌবন তরঙ্গ সেদিন বলেছিল লাল কিলে পর লাল নিশান তাদের সভার ওপরে লাল ঝান্ডার ওপরে উড়ছে দেশের জাতীয় পতাকা। যে পার্টির এক বাচাল অর্ধশিক্ষিত প্রায় চালু করেই দিয়েছিল রবীন্দ্রনাথ এক বুর্জোয়া কবি তাঁর রচনা দিয়ে শুরু হল ইন্সাফ এর দাবিতে জনগণের বৈঠক। যে নজরুলের সাম্যের গান আর মুজফফর আহমেদের মানে কাকাবাবুর সঙ্গে সম্পর্কের জেরেই নজরুল ছিলেন আবদ্ধ সেই নজরুলের গান দিয়ে শেষ হল ব্রিগেড মিটিং। এক আমূল পরিবর্তনের দিকে পথ হাঁটা। খালি তাই নয় গতকালের ব্রিগেড সব অর্থেই ছিল এক অন্য ব্রিগেড, কবে শেষ ব্রিগেড দেখেছে কমরেড বিমান বসুকে মঞ্চের নীচে? ৭৭ থেকেই ব্রিগেডে শক্তি প্রদর্শন বামেদের, বিশেষ করে সি পি এম এর, সেই থেকে আজ অবদি এই প্রথম কমরেড বিমান বসু মঞ্চে নেই। পুরনো থেকে নতুন বহু ছক ভেঙে বহু নতুন ছবি এলো আমাদের সামনে এই ব্রিগেড মিটিং এ, সেটাই আমাদের বিষয় আজকে ছক ভাঙা ব্রিগেড, পাল্টাচ্ছে দল।
কমিউনিস্ট পার্টিতে বদল আসে, নীতি থেকে কাঠামো এক ঝটকায় পালটে যায়, কবছরের মধ্যে পালটে গ্যালো সোভিয়েত রাশিয়াতে, একঝটকায় চীনের অর্থনীতি, এসব আমরা দেখেছি, আবার খুব ধিরে ধিরে একটা দল বদলায় সেতাও দেখেছি, ৭৭ এর সি পি এম ২০১১ র সি পি এম তো এক ছিল না। কিন্তু বহুদিন ধরে ব্রিগেডের মিটিং এ যা যা দেখতে আমরা অভ্যস্ত ছিলাম তা এক ঝটকাতে ভেঙে গ্যালো। প্রচুর মানুষ আসেন বামেদের ডাকা ব্রিগেডে, এবারে কিশোর, কিশোরী, তরুণ তরুণীদের সংখ্যা চোখে পড়ার মতন, মাঠজুড়ে এক যৌবনের আবাহন, মঞ্চেও ব্যতিক্রম নয়, সবচেয়ে বয়স্ক মহম্মদ সেলিম বাকিদের প্রত্যেকেই প্রায় তাঁর অর্ধেক বয়সী, এই মুখেদের অনেকে সাইঁবাড়ি, মরিচঝাঁপি, রুনু গুহ নিয়োগীর নামও শোনেন নি। এমন কি শতরূপ বা কৌস্তুভও ছিলেন না মঞ্চে। আর এই প্রথম আমার স্মরণের ব্রিগেডে কাঁধে গামছা বা তোয়ালে নিয়ে বিমান বসু নেই, তিনি তলায় বসে শুনছিলেন পরের প্রজন্মের বক্তৃতা, অস্ফুটে হয় তো মনে পড়ছিল, “আমাদের গেছে যে দিন একেবারেই কি গেছে, কিছুই কি নেই বাকি।” তারপরেই মাথায় এসেছিল শেষ লাইনটা “রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে।” এই বয়সে এসে স্বান্তনা, আছে তরুণেরা, তারাই ধরেছে হাল। জাতীয় পতাকা নিয়ে কিকেবল আর এস এস এর অসুবিধে ছিল? কমিউনিস্ট পার্টিরও তো ছিল, সেই জাতীয় পতাকা এবারে মাথার এক্কেবারে ওপরে, লাল ঝান্ডা ছাড়িয়ে উড়েছে সারাটা সময়। সি পি এম এর নব্য ক্যাডারেরা নীল সাদা জামা পরেন না, ঐ রঙ টাকেই ত্যাগ করেছেন কারণ মমতা, মমতার যা কিছু সব পরিত্যাজ্য, একটাই কারণে মমতাকে নিয়ে তাঁদের মনের গভীরে এই উষ্মা, তিনিই কেড়েছেন অষ্টম বামফ্রন্টের স্বপ্ন, কাজেই, মমতা কিছু করলে সেটা পরিত্যাজ্য। কিন্তু এবার সেই ব্যকরণ ভুলেই এই কদিন আগে ঘোষিত ম্বাংলার মাটি বাংলার জল, রবিঠাকুরের গান দিয়ে শুরু হল ব্রিগেড, হ্যাঁ প্রাচীন গণসঙ্গীত তার সমসাময়িকতা হারিয়েছে আর ইদানিং গণনাট্য সংঘ মধ্যও নয় নিম্ন মেধার কারবার কাজেই গণসঙ্গীত নয় রবি ঠাকুরের গান বেছে নিলেন যুবরা, রবীন্দ্রনাথ বুর্জোয়াদের কবি, সেই অর্ধসত্য প্রচারের জবাব এল সঠিক ভাবেই। শেষে এল নজরুল, একই ভাবে সমসাময়িক বিতর্ককে মাথায় রেখেই। গোটা ব্রিগেডে মমতার দল আর সরকার কে ফালাফালা করা হল দূর্নীতির প্রশ্নে, কিন্তু দিদি মোদি এক হ্যায় গোছের কথা মঞ্চ থেকে বলা হল না, আক্রমণ শানানো হল বিজেপির বিরুদ্ধেও কিন্তু বিজেমুলের মত শব্দবন্ধ শুনলাম না মঞ্চের যুব বক্তাদের মুখে। শোনাই গ্যালো না জোটের কথা, ইন্ডিয়া অ্যালায়েন্সের কথা, যুব নেতৃত্ব কি ধরেই নিয়েছেন জোট হবে না? উলটে শোনা গ্যালো সিস্টেম বদলানোর মত বেসিক কথাবার্তা, এবারের ব্রিগেড যে কোনও কারণেই হোক উলটো মুখো এটাও আমরা দেখিনি কখনও। এই ব্রিগেড দেখলো এক বাম সমাবেশ, যে সমাবেশে ডাকাই হয় নি অন্য বাম সংগঠন বা নেতাদের, এটাও নতুন এক ব্যাপার, এর তাৎপর্য বুঝতে সময় লাগবে তবে সি পি এম দলের মধ্যে এক অংশ বহুকাল ধরেই নিজেদের উদ্যোগেই আন্দোলন জমায়েত গড়ে তোলার পক্ষে সওয়াল করে যাচ্ছিলেন, এই সিদ্ধান্ত কি সেই অংশের চাপেই হল? জানা নেই। এবং এই প্রথন বাংলায় ব্রিগেড, বামেদের ডাকা ব্রিগেড, সর্ব ভারতীয় দলের উপস্থিতিও নেই, কিন্তু বক্তাদের এক বিরাট অংশ হিন্দিতে বহুক্ষণ বললেন, হিন্দি বাংলা মিশিয়ে বললেন, এটাও এক নতুন ফিনোমেনন, যা এর আগে জ্যোতি বসু, প্রমোদ দাশগুপ্ত, বুদ্ধ ভট্টাচার্যদের বক্তৃতাতে শোনা যায় নি। সব মিলিয়ে এক নতুন ব্রিগেড দেখলাম আমরা। কিন্তু এই নতুন ব্রিগেড, প্রচুর মানুষ, যৌবনের উচ্ছাস, ইয়ং ব্রিগেড কি ভোটের বাক্সে বামেদের কিছুটাও এগিয়ে দিতে পারবে? এই প্রশ্ন করেছিলাম আমাদের দর্শকদের। শুনুন তাঁরা উত্তরে কী বলেছেন।
ব্রিগেড শেষ, পড়ে থাকা কাগজ, ঠোঙাও পরিস্কার করেছেন ঐ যুবরা। যৌবন ছিল, উচ্ছাস ছিল, শ্লোগান ছিল, মঞ্চ থেকে বক্তাদের গা গরম করা বক্তৃতাও ছিল, প্রচুর মানুষ এসেছিলেন তাই এক নতুন ভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর কথাও ছিল, অনেক দিন পরে বামেদের এই জমায়েত ঘিরে মিডিয়ার কভারেজও ছিল, কিন্তু লাখ কথার এক কথাটা হল এই জমায়েত কি বামেদের ভোটের বাক্সে খানিক হলেও এগিয়ে দেবে? সংগঠন কি খানিক নড়ে চড়ে বসেছে, ভোট কি ফিরবে। এর আগে এর থেকেও বেশি ভিড়ের পরেও ভোটের বাক্সে খরা কিন্তু কাটে নি, কাজেই আপাতত নজর সবার সেই দিকেই, ভিড় কবে ভোট হবে?