কল্পনাও করা যায় না, ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে শুধুমাত্র বাংলায় কথা বলার অপরাধে ভারতীয় নাগরিকদের বাংলাদেশি বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে! কিন্তু আজকের বাস্তব এটাই। একের পর এক ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলো — গুজরাত, আসাম, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ — সেখানে যারা বাংলায় কথা বলছে, বা যাদের নাম একটু ‘বাঙালি গোত্রের’, তাঁদের টার্গেট করা হচ্ছে। মাত্র গতকাল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি বিধানসভায় দাঁড়িয়ে যে অভিযোগ করলেন, সেটা শুধু রাজনীতি নয়, এটা একটা সাংঘাতিক বিপজ্জনক প্রবণতা। তিনি জানান, পশ্চিমবঙ্গ থেকে যারা কাজের খোঁজে বাইরে গেছেন, তাঁরা বাংলায় কথা বলায় তাঁদের অনেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সন্দেহ করা হচ্ছে তাঁরা ‘বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী।’ এমনকি তাঁদের মধ্যে কয়েকশো জনকে রাজস্থান থেকে আটকও করা হয়েছে। এই শ্রমিকদের অনেকেই ইটাহারের বাসিন্দা। বিধায়ক মোসারফ হোসেন জানিয়েছেন, ওই কর্মীরা তাঁকে ফোন করে বলছেন, পুলিশ কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে, কিছু জায়গায় আটকে রাখছে।
এই ঘটনা অবশ্য নতুন নয়। ২০২৩ সালের শেষের দিকে গুজরাতের সুরাতে, বেশ কয়েকজন বাঙালি নির্মাণ শ্রমিককে ‘বাংলাদেশি’ বলে গ্রেফতার করা হয়। পরে দেখা যায়, প্রত্যেকের আধার কার্ড, ভোটার আইডি, সব কিছু ছিল। স্থানীয় বিজেপি কাউন্সিলর তখন বলেন, “ওরা তো বাংলায় কথা বলছিল, তাই সন্দেহ হয়েছিল।” ২০২৫-এ ‘অপারেশন সিঁদুর’ শুরু হওয়ার পরে এরকম এক বড় বাঙালি থাকে এমন অঞ্চলের বাসিন্দাদের গরু-ছাগলের মত হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তাঁদের ঘরবাড়ি ভেঙে ফেলা হয়েছিল। আজ আবার সেই একই ছবি রাজস্থানে, সেটাই বিষয় আজকে বাংলায় কথা বললেই বাংলাদেশি? তাকে ছাড়তে হবে দেশ?
২০২৪ সালের মার্চ মাসে মধ্যপ্রদেশের ভোপালে, এক তরুণীকে রেল স্টেশনে বাংলায় ফোনে কথা বলার কারণে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে দেয়। আধার, প্যান কার্ড দেখানোর পরেও তাঁকে ৪ ঘণ্টা আটকে রাখা হয়েছিল। অসম তো আপাতত এই গোটা ষড়যন্ত্রের পরীক্ষাগার। সেখানে এনআরসি প্রক্রিয়ার সময় প্রমাণ হয়ে গিয়েছে, যাঁরা বছরের পর বছর ধরে অসমে থেকেছেন, এমনকি স্বাধীনতার আগের দলিলও জমা দিয়েছেন, তাঁদের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। শুধু ধর্ম নয়, ভাষাও বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে সেখানে। বাঙালি মানেই ‘বাংলাদেশি’ — এই ধারণা এতটাই শক্তিশালী করে তোলা হয়েছে, যে একজন বাঙালি মুসলিম তো দূর, বাঙালি হিন্দুরাও নিরাপদ নন। তাঁদের ধরে ধরে বাংলাদেশে পাঠানো হচ্ছে, স্বাভাবিক কারণেই তাঁদের বাংলাদেশেও ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না, তাঁদের রাত কাটাতে হচ্ছে নো ম্যানস ল্যান্ডে, খোলা আকাশের নীচে।
আরও পড়ুন: Aajke | কালীগঞ্জ উপনির্বাচনের পর কী অবস্থা বঙ্গ বিজেপির?
এটাই কী ভারতের ভবিষ্যৎ? একটা দেশে কেউ তার মাতৃভাষায় কথা বললেই যদি সেটা অপরাধ হয়, তাহলে সেই দেশ আসলে কোন দিকে যাচ্ছে? বাংলা কি তাহলে ভারতের ভাষা নয়? সংবিধানে স্বীকৃত ভাষা নয়? এটাই রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বিবেকানন্দের ভাষা। আমাদের দেশের জাতীয় সঙ্গীত লেখা বাংলাতে, যে বিবেকানন্দকে নিয়ে অযথাই নাঁচন-কোঁদন করে আরএসএস বিজেপির দল, তিনি বাংলাতেই কথা বলতেন। তাহলে আজ বাঙালিদের এভাবে হেনস্থা করা হবে? এটাই কি ‘নতুন ভারত’? এটাই আমাদের মোদিজির আচ্ছে দিন? বিজেপি সরকারের এনআরসি, সিএএ নিয়ে যেভাবে গোটা দেশে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে, তার পরিণতিই আজ এই ঘটনাগুলো। এভাবে চলতে থাকলে শিগগিরই ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে শুধু ভাষা বা ধর্মের ভিত্তিতে ‘নাগরিকত্বের যোগ্যতা’ নির্ধারণ করা হবে। কিন্তু এটাও বুঝতে হবে যে এটা শুধু ভাষা নয়, ক্ষমতার রাজনীতি। মনে রাখতে হবে, এই টার্গেটিং শুধু ভাষাভিত্তিক নয়, এটা একেবারে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রাজনৈতিক কৌশল। বিজেপির রাজ্যগুলো এমন একটা বৃত্ত তৈরি করছে যেখানে যারা তাদের ভোট দেয়নি, বা অন্য সংস্কৃতির মানুষ, তাদের ক্রমাগত ‘অবৈধ’, ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এই বাংলা বিজেপিকে ভোট দেয়নি, বাঙালিরা তাঁদের বিরুদ্ধে বারবার রায় দিয়েছে, আর তারই বদলা নেওয়ার জন্য, পুরো একটি ভাষাভাষী গোষ্ঠীকে নিশানা করা হচ্ছে। আর তাই বাংলা ভাষা আজ অস্তিত্বের প্রশ্নে দাঁড়িয়ে, বাংলা ভারতের দ্বিতীয় সর্বাধিক কথ্য ভাষা। এই ভাষার সাহিত্য, ইতিহাস, সংস্কৃতি গোটা উপমহাদেশে শ্রদ্ধার জায়গা পেয়েছে। অথচ আজকের দিনে সেই ভাষায় কথা বললেই মানুষ সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে, আটকানো হচ্ছে, এমনকি বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। এটা শুধু বাঙালির অপমান নয়, ভারতের আত্মার অপমান। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, বাংলায় কথা বললে অন্য রাজ্যের বাঙালিদের বাংলাদেশি বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে। মূখ্যমন্ত্রী এর প্রতিবাদ করছেন। কিন্তু এসব তো ঘটছে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে, এই বাংলার বিজেপি বিধায়করা এ নিয়ে একটা কথাও বলছেন না কেন?
আমরা বাংলায় কথা বলি, সেটাই আমাদের পরিচয়। সেটা কখনই আমাদের অপরাধ হতে পারে না। বিজেপি সরকার আদতে আগুন নিয়ে খেলছে, দক্ষিণে পেরিয়ার নিয়ে নোংরা প্রচার চালাচ্ছে, আসমে বাঙালি খেদাও অভিযান চালানো হচ্ছে। বিভিন্ন রাজ্যে বাঙালি দেখলেই তাদেরকে বাংলাদেশি বলে চিহ্নিত করে হ্যারাস করা হচ্ছে, ঘরবাড়ি ভাঙা হচ্ছে। এই কথাগুলো রাজ্যের বাঙালি মানুষজনকে জানাতে হবে। আরএসএস–বিজেপি আদতে বাঙালি বিরোধী, বাংলা বিরোধী। এই রাজনীতি বন্ধ না করলে আসছে দিনে তাঁদের জবাব দিতে হবে। যারা বাংলায় কথা বলে, তাঁদের বাংলাদেশি বলে দাগিয়ে দেওয়া মানে দেশের সংবিধানের অপমান। ভারত যদি সত্যিই গণতন্ত্র আর বহুত্বের পথে থাকতে চায়, তাহলে ভাষাভিত্তিক এই বিদ্বেষ-রাজনীতি এখনই বন্ধ হওয়া দরকার।