এমনটা নতুন নয়, মসজিদে হারামের মাংস বা মন্দিরে নিষিদ্ধ মাংস ফেলে খুব সহজেই দাঙ্গা লাগানো যায়। আমাদের ধর্ম সম্বন্ধে ধারণা এতটাই ঠুনকো যে খুব ছোট্ট গুজবে দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়, এবারে মানুষ সজাগ থাকলে, মানুষ প্রতিরোধ করলে আর প্রশাসন সক্রিয় থাকলে সেই দাঙ্গা আটকানো যায়, মানুষের সক্রিয় প্রতিরোধ ছাড়া দাঙ্গা আটকানো সম্ভবই নয়। ধর্ম তো কোনও যুক্তিবাদ নয়, তা এক বিশ্বাস, অগাধ বিশ্বাস, যে বিশ্বাস শুরুতেই বলে দেয় আপনার ধর্মই সর্বশ্রেষ্ঠ, আপনার ধর্মই মহান। ধর্ম তো এই সেদিনের কথা, তার আগেও মানুষ কাটিয়েছে লক্ষ বছর, বাসা বেঁধেছে, গান গেয়েছে, শিকার করেছে, হ্যাঁ যুদ্ধও করেছে, মেরেছে, মরেছে। সেসবই ছিল দখলদারির লড়াই, কতটা জমি, কতটা সম্পদ, কতটা ধন রত্নের দখল পাবো, আমি বা আমরা? অতএব যুদ্ধ হয়েছে। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম প্রতিষ্ঠার পরে যে কোনও সময়ে, যে কেউ যে কাউকে মেরেছে, মরেছে বিনা কারণে, বা বলা যাক ছিল এক বিশ্বাসের ভিত্তিতে, আমি শ্রেষ্ঠ, আমার ধর্ম শ্রেষ্ঠ, আর কিচ্ছু ছিল না সেই নৃশংস হত্যার প্রেক্ষাপটে। হিন্দু পুরাণ বলছে পরশুরাম ২১ বার গোটা পৃথিবীকে নিঃক্ষত্রিয় করেছিল, কারণ তাঁর পিতা ঋষি জমদগ্নিকে ক্ষত্রিয় এক রাজা হত্যা করেছিল। ব্যস। এবং তা ফলাও করে লেখা আছে পুরাণে। লেখা আছে ইতিহাসে ক্রুসেডের কথা, ১৭ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল হয় তারা মুসলমান বলে, নয় তারা হিন্দু বলে। প্রতিটা ধর্মের মানুষ কখনও না কখনও অন্য ধর্মের মানুষকে কচুকাটা করেছে, একবার নয় বারবার। কিন্তু একটা সময়ে এসে মানুষ সহনশীলতার কথা বলতে শুরু করে, বিভিন্ন ধর্মের সহাবস্থানের কথা বলা শুরু হয়, শান্তি আর সহাবস্থানের উপরেই এক আধুনিক রাষ্ট্র আর সমাজ গড়ে উঠতে পারে সে কথা মানুষ বোঝে, বলে আর মানে। কিন্তু ব্যতিক্রম কি নেই? আছে বইকী, এই বিজেপিই হল তার এক অন্যতম ব্যতিক্রম যারা সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের কথা মানে না, সহাবস্থানের কথা মানে না, তারা হিন্দু সুপ্রিমেসির জন্য এক হিন্দুরাষ্ট্রের কল্পনা করে আর সেই হিন্দুরাষ্ট্রের জন্য যে কোনও ষড়যন্ত্র পরিকল্পনা করে থাকে। দাঙ্গা আরএসএস-বিজেপির কাছে এক অক্সিজেন সিলিন্ডারের মতো, যা থাকলে তারা বেড়ে ওঠে, কলেবরে বড় হয়ে ওঠে। তো সারা উত্তর ভারতের দখলদারি শেষ, এখন বাংলার দখল নেওয়ার জন্য তাদের ওই দাঙ্গা লাগানোর কৌশল নিয়েই মাঠে নেমেছে। সেটাই আজকের বিষয় আজকে। হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার চক্রান্ত রুখে দিল মানুষ।
আমরা রামনবমী দেখলাম, মিছিল হল, হনুমান বাহিনী অস্ত্র নিয়ে লাফঝাঁপ করল, কিন্তু মানুষ সজাগ ছিল, প্রশাসনও। কাজেই খুব একটা কিছু না করতে পেরে মুর্শিদাবাদ, ওয়াকফ বিলের প্রতিবাদের পিছনেই এক দাঙ্গার ব্লু প্রিন্ট ছিল, সেটা তো জানত না ওই অঞ্চলের মানুষজন। কিন্তু কত তাড়াতাড়ি সেই আগুন জ্বলে উঠল, কত তাড়াতাড়ি কিছু হিন্দু মানুষের পলায়নের ছবি এল, ঘি ঢালতে রাজ্যপাল ছুটে গেলেন, কিন্তু তা ক’দিনের মধ্যে সামলে নিল প্রশাসন, মানে প্রশাসনের মদত মিলল না।
আরও পড়ুন: Aajke | গণশক্তি, তোমার কি কুসুম হারাইয়াছে?
কিন্তু এখানেই কি থেমে থাকবে? চন্দন মালাকার আর প্রজ্ঞাজিৎ মণ্ডল, নামেই পরিষ্কার যে তাঁরা দুজনেই হিন্দু সন্তান, পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন। কেন? কারণ তারা বনগাঁর একটি অঞ্চলে পাকিস্তানি পতাকা টাঙিয়ে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ, হিন্দুস্তান মুর্দাবাদ’ লিখে একটা দাঙ্গা বাঁধানোর প্রায় নিখুঁত এক পরিকল্পনা প্রয়োগ করার আগেই ধরা পড়ে গেছেন। এলাকার মানুষ ধরেছে। এরা নিজেরাই জানিয়েছে যে দুজনেই বিজেপির সদস্য, হ্যাঁ, সেই বিজেপি যারা নাকি প্রবল জাতীয়তাবাদী, হিন্দুরাষ্ট্রের দাবি করে, তারাই রাষ্ট্র ব্যবস্থার মাথায়, সেই তাদের দুজন পাকিস্তান জিন্দাবাদ, ভারত মুর্দাবাদ লিখে দিয়ে আসবেন দেওয়ালে, তারমধ্যে কয়েকটা দেওয়াল মুসলমানদের হবে, ব্যস, তারপর দাঙ্গা ঠেকায় কে? এই কলকাতায় বসে সেই দাঙ্গার ছবি দেখে ঘাড় নাড়িয়ে সুজন-শতরূপেরা বলবে সরকার না চাইলে তো দাঙ্গা হয় না, এই দাঙ্গা তো সরকার চেয়েছে, তাই হচ্ছে। কিন্তু আসলে দেশের মাথায় বসে থাকা সরকারি দল দাঙ্গা লাগাতে চাইছে, তাদেরও পিছনে আছে এক সঙ্ঘ, যারা এভাবে দাঙ্গা বাধাতে মদত দেয়। লক্ষ করে দেখুন সীমান্ত অঞ্চল বনগাঁ। একদা হিন্দু উদ্বাস্তুদের নিবিড় বসবাসের জায়গা। বেছে বেছে এগুলো করা হয়। অঞ্চল বেছে, বসবাসকারী লোকজন দেখে, সাজানো হয় এমন ঘটনা। মন্দিরে গোমাংস ফেলা থেকে মিছিলে ঢিল ছোড়া সবই এদের দাঙ্গা বাধানোর ফন্দি। যত দাঙ্গা যত সাম্প্রদায়িক বিভেদ তত ভোট, তত ক্ষমতায় আসার পথ পরিষ্কার। এবারে আটকানো গেছে, হয়তো ১০০টাতে ৯৮টাই আটকানো যাবে, দু’খানা যাবে না আর সেই দু’খানাই অক্সিজেন দেবে বিজেপিকে। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, বনগাঁয়ে দুজন বিজেপি কর্মী পাকিস্তানি ফ্লাগ নিয়ে পাকিস্তান জিন্দাবাদ লিখে দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টা চালাচ্ছিল, মানুষ ধরে ফেলেছে। এর আগেও এরকম অভিযোগ বারবার এসেছে, আসলে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা লাগিয়ে বিজেপি তার ভোটব্যাঙ্ক বাড়াতে চায়। এই বিষয়ে আপনাদের মতামত কী? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
এই যে দুজন ধরা পড়েছে তাদের হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজও পাওয়া গেছে, তাতে খুব পরিষ্কার যে রাজ্যজুড়েই বিজেপি এই দাঙ্গার আগুন ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েই মাঠে নেমেছে, এটাই ২০২৬ এর আগে বিজেপির স্ট্র্যাটেজি। তাদের লক্ষ্য এ রাজ্যের ৭০ শতাংশ হিন্দু ভোটের ৭০ শতাংশ পাওয়া, মানে সেই ৪৯ শতাংশ ভোট পেয়েই এক বিপুল আর স্থায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তারা রাজ্যের ক্ষমতায় আসতে চায়। সমস্যা দুটো, ১) কোনওভাবেই হিন্দুদের ৫০-৫৫ শতাংশের বেশি ভোট তারা পাবে না, কারণ এ রাজ্যে হিন্দুদের এক বড় অংশই বিজেপির ওই উগ্র হিন্দুত্ববাদে বিশ্বাসই করে না। ২) রাজ্যের প্রায় ৩২-৩৩ শতাংশ মুসলমান মানুষজনকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার এই প্রচেষ্টা আগামী দিনে এক বিরাট সমস্যার দিকে রাজ্যকে ঠেলে দেবে যা রাজ্য বিজেপি নেতৃত্বের মাথায় ঢুকছে না।