গব্বর কে তাপ সে তুমহে এক হি আদমি বঁচা সকতা হ্যায়, এক হি আদমি, ওহ হ্যায় খুদ গব্বর। শোলে সিনেমার ভিলেন গব্বর সিংয়ের সেই অসাধারণ ডায়ালগ, গব্বরের হাত থেকে তোমাদের বাঁচাতে পারবে একজন, কেবল একজন, সেটা হল গব্বর নিজে। গব্বর সিং দেখেননি বা শোলে দেখেননি যাঁরা তাঁদের জন্য অন্য উদাহরণও আছে। শতপুত্র হারিয়ে গান্ধারী অভিশাপ দিয়েছিলেন কৃষ্ণকে, গান্ধারীর সেই শাপ- ‘স্বজন শ্মশানে কৃষ্ণ তুমি মরবে, তোমাকে মরতে হবেই একেবারে একা, অতি হীন মৃত্যু। আর তোমার অজেয় যাদবকুল ধ্বংস হবে গৃহ কলহে। অমন যে দ্বারকা, অমন যে বিশাল শক্তিশালী সাম্রাজ্য, তা ধ্বংস হল সেই আত্মকলহে, পুরাণ বলছে, দ্বারকায় নৈসর্গিক উৎপাত শুরু হল, আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেল,বজ্রবিদ্যুৎ সহ উল্কাপাত, সমুদ্র ফুলে উঠে আছড়ে পড়তে লাগল দ্বারকার সমুদ্রতটে। স্বর্গে,মর্ত্যে সর্বত্রই যেন মৃত্যুর সংকেত। শ্রীকৃষ্ণ যাদব প্রধানদের ডেকে বললেন, দ্বারকায় থাকা নিরাপদ নয়,তাই মহিলা,শিশু ও বৃদ্ধরা যেন শঙ্খদ্বার এখন যাকে বেট দ্বারকা বলা হয়, সেখানে চলে যান। বাকি যাদবকুলকে নিয়ে চললেন প্রভাস তীর্থ মানে সোমনাথে। সেখানে এক বিশাল পূজা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই উৎসবমুখর দ্বারকাপুরী হয়ে গেল জনমানবশূন্য নিস্তব্ধ নগরী। সমুদ্র ক্রমশ উপরে উঠে ধীরে ধীরে গ্রাস করতে শুরু করেছে জনপদ। ওদিকে প্রভাস তীর্থ উৎসব মুখর হয়ে উঠেছে। যজ্ঞ,পূজা,দান-ধ্যান,ভোজন ইত্যাদী শেষ। শুরু হল যদু যুবাদের আকণ্ঠ মদ্যপান করে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে উন্মত্ত উল্লাস। প্রভাসতীর্থের পরম পবিত্রতা ভুলেই গেল তারা। মাতালরা যুগে যুগে বোধহয় একই আচরণ করে। প্রথমে সমুদ্রে স্নানরত অবস্থায় ঠাট্টা,মজা। এরপর ঝগড়া শুরু,অতঃপরই হাতের সামনে পাওয়া ‘একরা’ ঘাস ছিঁড়ে গদা বানিয়ে আঘাত করা শুরু হল। ফলে দেহ ক্ষতবিক্ষত হতে শুরু করল। যাদবকুলের অহংকার-জন্মাবধি সে জেনে এসেছে রক্তের বদলে রক্ত নিতে হয়। শুরু হল দাঙ্গা,বেরোল আরও ধারালো অস্ত্র। মদ্যপ উন্মত্ত যাদবরা একে অপরকে হত্যা করতে লাগল। ভাইয়ে ভাইয়ে,পিতাপুত্রে,মামা ভাগ্নে সবাই কি একটা ঘোরের মধ্যে একে অপরকে হত্যার খেলায় মেতে উঠল। পবিত্র পূজা অনুষ্ঠানে পিপে পিপে মদ-নাম তার ‘মৈরেয়’ সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন তারা, এত তাদের আসক্তি। দাবানলের মতো শেষ করে দিল যদুবংশ। হ্যাঁ আত্মকলহ এমনই এক বস্তু, অনেকটা সেই ভাবেই বলা যায়, আত্মঘাতী কাজকারবার, মানে সেমসাইড গোল ছাড়া এই বাংলায় আপাতত তৃণমূলকে হারানো যাবে না, সেটাই বিষয় আজকে, এই মুহূর্তে তৃণমূলকে কেবল তৃণমূলই হারাতে পারে।
এই যে আরজি কর আন্দোলন, এই যে ২৬ হাজার শিক্ষক অশিক্ষক কর্মচারীর চাকরি যাওয়া, বা তাকে ঘিরে এক পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি, যেখানে টাকা নেওয়া হয়েছে, এবং তা তো দলের মুখপাত্রই সংবাদমাধ্যমের কাছে বলেছেন, কাজেই এসব তো লুকোনোর নয়, বিষয়টা হল এসব কি নির্বাচনে তৃণমূলের জনভিত্তি কেড়ে নিতে পারে? এক কথায় উত্তর হল না, পারে না। কেন? মানুষ চোখের সামনে দেখছে ২৬ হাজার শিক্ষকের চাকরি গেছে, চোখের সামনে দেখছে একজন ডাক্তার তাঁর কর্মস্থলে ধর্ষিতা ও খুন হলেন, এসব কি মানুষ দেখছেন না?
আরও পড়ুন: Aajke | বাংলার ২ কোটি মানুষের পকেটমারি, শুভেন্দুর মুখে তালা
নিশ্চয়ই দেখছেন, কিন্তু ফিল করছেন না। যেমন করে আপনি গাজা স্ট্রিপের ধ্বংসলীলার ছবি দেখেন, তার প্রতিটা তথ্য আপনার মাথায় ঢুকছে, কিন্তু আপনি সেইভাবে ফিল করতে পারছেন কি? পারলে তো মুখে ভাত তোলারও ক্ষমতা থাকত না। দেখা এক জিনিস, তথ্য জানা এক জিনিস আর পারসেপশন, যে পারসেপশন আপনার মস্তিষ্কে এক ধরনের অনুভূতির জন্ম দেবে, সেটা আলাদা। আচ্ছা বলুন তো গোটা দেশে প্রতি ন’ মিনিটে একটা করে ধর্ষণ হয়, হিসেব না জানলেও গ্রাম শহরের প্রতিটা মহিলা তার আঁচ পান, কিন্তু তাকে যদি হঠাৎ একটা বিশেষ ধর্ষণ আর হত্যা নিয়ে চাগিয়ে তুলতে হয়, তাহলে সেই ধর্ষণের বা খুনের চেয়েও কিছু বেশি এক অনুভূতির জন্ম দিতে হবে, সেই অনুভূতি হল নারী অবমাননা, লিঙ্গসাম্যের অধিকার, আমার সন্তানও তো কাল ডাক্তার হতে পারে, কাল এক গবেষক হতেই পারে, সে তার কর্মস্থলে এইভাবে ধর্ষিতা হবে? খুন হবে? হ্যাঁ এই অনুভূতিই এক বিরাট নাগরিক সমাজকে সেই পারসেপশনের ভিত্তিতেই আলোড়িত করেছিল, কিন্তু সেই ঢেউ মফস্সল পার করতে পারেনি, কারণ মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্ত নাগরিক বাস্তবতার সঙ্গে সেই বিশাল গ্রামবাংলার মানুষের কোনও সম্পর্কই নেই। মেয়েটা কলেজে পড়লে কন্যাশ্রীর পরের টাকাটা পাবে, এই বাস্তবতা সেই মানুষজনের ধারণা তৈরি করে। আচ্ছা বলুন তো কত মানুষের সরকারি চাকরি আছে? মোদি সরকার আর মমতা সরকারে চাকরি করা মানুষজনের সংখ্যা এই রাজ্যের জনসংখ্যার খুব বেশি হলে ৪-৫ শতাংশ, বাকিদের এই চাকরি আছে তো সেই নেই, বাকিদের চাকরিই নেই, দাদুর দাদুর আমল থেকে শুনে এসেছে হয় ধরা করা, না হয় চাঁদির জুতোর বদলেই চাকরি মেলে। যে মানুষটা প্রতিদিন সকালে বের হয় চাকরি বাঁচাতে, বিকেলে ফেরে এই ভেবে যে যাক বাবা চাকরিটা আছে, সেই সংখ্যাই তো সংখ্যাগরিষ্ঠ, কাজেই তাদের মাথায় এই ২৬ হাজারের দুর্ভোগ বা তাকে ঘিরে দুর্নীতির অভিযোগ কতটা কাজ করবে? কাজেই এই আরজি কর বা ২৬ হাজারের চাকরি বা দুর্নীতির ইস্যু তুলে মমতা সরকারের গায়ে আঁচড়ও কাটা যাবে না। একটু মনে করে দেখুন, বুদ্ধবাবুর সরকার অমন সাধের সপ্তম বাম সরকার পড়ে গিয়েছিল কেন? বুদ্ধবাবু শিল্পায়ন করতে চেয়েছিলেন, তাই? ঘণ্টা, করলেও কিছু হত না, না করলেও কিছু হত না। কাল হল ওই কৃষকের জমি নিয়ে শিল্পায়নের ঘোষণায় বা উদ্যোগে। হ্যাঁ এটাই সেই গ্রাম বাংলার অগণিত মানুষ, দরিদ্র চাষা, খেতমজুরের মাথায় ঢুকেছিল, জমি কেড়ে নেবে সরকার, সেই ধারণাই ওই মানুষদের সরিয়ে নিয়ে এসেছিল বাম শিবির থেকে তৃণমূল শিবিরে, জমি গেলে খাব কী? করব কী? রাজ্যের গরিব চাষিদের, খেতমজুরের এক বিরাট অংশ মুসলমান, তাঁরাও হুউউস করে সরে এলেন, অষ্টম বাম সরকার গড়া হল না বুদ্ধবাবুর, আর একবার ক্ষমতা থেকে যাওয়ার পরেই ৩৪ বছরের নানান হিসেব নিকেশ সামনে এসেছে। কিন্তু আদত কারণটা ছিল ওই ধারণার জন্ম, আমার ভিটে কেড়ে নেবে, আমার জমি কেড়ে নেবে। আজ সেই জায়গাতে কোনও সমস্যা নেই, গ্রাম শহরের গরিব মানুষেরা দিদিমণির নানান প্রকল্পের সুবিধে পাচ্ছেন, পাচ্ছেন লক্ষ্মীর ভাণ্ডার থেকে কন্যাশ্রী, রূপশ্রী থেকে যুবশ্রী, আছে স্বাস্থ্যসাথী। বিজেপির উত্থান তৃণমূলের দিকে আরও সংহত করেছে সংখ্যালঘু ভোট। বাম আপাতত শূন্য, কংগ্রেস সারা দেশের বাস্তবতা মাথায় রেখেই একলা চলো রে, বিজেপি এ রাজ্যে তার আকর্ষণ হারাচ্ছে, আসলে বিজেপির গায়ে হেরো দলের ছাপ লেগেছে সর্বাঙ্গে। কাজেই এখনই ভোট হলে নিশ্চিন্তে জিতবে তৃণমূল, আগের থেকে দু’ দশটা বেশি আসন পেতেই পারে। কিন্তু তাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল সেমসাইড গোল, এক আত্মঘাতী লড়াই, যা প্রতিদিন বিভিন্ন স্তরে দেখা যাচ্ছে, এখন তো সেটা এক্কেবারে মাথায় চড়ে বসেছে। এক সাংসদ অন্য সাংসদকে বলছেন জেলে পুরে দেব, সেই সাংসদ বলেছে এসব তো চোর, কাজিয়াতে জড়িয়ে হেবো পাঁচু নয়, কল্যাণ ব্যানার্জি, সৌগত রায়, মহুয়া মৈত্র, কীর্তি আজাদের মতো সাংসদেরা। এবং শুধু ঝগড়াই করছেন না, সেসব ঝগড়ার ছবি হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ চলে গেছে সংবাদমাধ্যমে। ন্যাশন্যাল মিডিয়াতে খবর, এসব তো থেমে থাকবে না, এর ফল জমিতেও দেখা যাবে, কাউন্সিলর সমর্থকেরা বোমা মারছে, যা খুশি মুখে আসছে বলে দিচ্ছেন বিধায়কেরা, হ্যাঁ এক আত্মঘাতী কলহ দেখতে পাচ্ছি তৃণমূলের মধ্যে আর সেখানেই রয়েছে আসল বিপদের বীজ। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, তৃণমূল দলের মধ্যেই যে ঝগড়া, আত্মঘাতী কলহ দেখা যাচ্ছে, তা তৃণমূল দলের পক্ষে কতটা ক্ষতিকারক? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
হ্যাঁ, গরিষ্ঠাংশ মানুষের এক প্রবল ধারণা ছাড়া আমাদের রাজ্যে হুট বলতে ঝুট সরকার বদল হয় না, ৩৪ বছর বাম শাসনের পরে পরিবর্তন এসেছে। কাজেই আজ হঠাৎ করে সরকার বিপন্ন বা দুম করে আর একটা পরিবর্তন এসে যাবে, তা হবে না। কিন্তু যে আত্মঘাতী লড়াই আমরা দেখছি তৃণমূল দলের মধ্যেই, তা অবশ্যই আগামী বিপদের ইঙ্গিত বয়ে আনছে, বিশেষ করে সেই লড়াই যদি দলের একেবারে ওপরেই প্রকাশ্যেই হতে থাকে তাহলে তৃণমূল দলই তৃণমূলের পতনের কারণ হতেই পারে।