বিজেপি সাংসদ, মন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর বলেই চলেছেন যে মার্চের মধ্যে মতুয়াদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। এই কথাটা বলার মানে হল মতুয়ারা দেশের নাগরিক নয়, এবার তাঁদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। যে লক্ষ লক্ষ মতুয়া আমাদের বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে, নদিয়া, উত্তর ২৪ পরগণাতে বসবাস করেন, তাঁরা দেশের নাগরিক নন? এবং মজার কথা হল যিনি এই কথা বলছেন তিনিও একজন মতুয়া, এই নির্লজ্জ মিথ্যেটা বলতে তাঁর কোনও সমস্যাই হচ্ছে না। যে মানুষজন সেই কবে থেকে এই রাজ্যের বিভিন্ন অংশে ঘর বেঁধেছেন, এইখানেই তাঁদের সন্তানেরা পড়াশুনো করেছেন এই মাটিতেই তাদের বিয়ে হয়েছে, তাদেরও সন্তান সন্ততি হয়েছে, তাঁরা নাগরিক নন দেশের? আজ ৫২ সাল থেকে আর গত ২০২১ পর্যন্ত যাঁরা রাজ্য আর দেশের সাধারণ আর রাজ্যের নির্বাচনে লাইন দিয়ে ভোট দিলেন সরকার বানালেন, সরকার ফেললেন, তাঁরা নাগরিক নন? কে নাগরিক? যিনি তাঁদের নাগরিকত্ব দেবেন বলছেন তিনি নাগরিক? তাঁর দলের সেই সর্বোচ্চ নেতা দেশের নাগরিক যাঁর জন্মের প্রমাণপত্র নেই, শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রমাণপত্র নেই, তিনি নাগরিক? মতুয়া সমাজ থেকে এই প্রশ্ন উঠছে না কেন? এই ফোরটোয়েন্টি মার্কা কথাবার্তার মানেই বা কী? কবে সিএএ বিল পাশ হয়েছিল? ১১ ডিসেম্বর ২০১৯। কী বলেছিলেন আমাদের ছোটা মোটাভাই, একদা তড়িপার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ? ক্রোনোলজি সমঝিয়ে, প্রথমে সিটিজেনশিপ বিল আসবে, বিল পাশ হয়ে সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট সিএএ তৈরি হবে, প্রত্যেক শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে, তারপর এনআরসি হবে। তো বিল পাশ হয়েছে ১১ ডিসেম্বর ২০১৯, সরকার কার? বিজেপির। বিল পাশ করেছে কে? বিজেপি। সেই বিল লাগু হচ্ছে না কেন? কারণ তাঁরা বিল আনার সময়েই বুঝে গেছেন বিল লাগু করলে সারা দেশে যে বিরোধিতা শুরু হবে তা সামলানোর ধক তাঁদের নেই। এদিকে মতুয়া মানুষজনদের বোঝানো হয়েছে আপনাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে, সেই প্রচারে শান্তনু ঠাকুর সাংসদ হয়ে গেছেন, সেই সিএএ আসেনি। আবার ভোট এসে গেছে, কাজেই শান্তনু ঠাকুর বলতে শুরু করেছেন মার্চেই, মানে ভোটের আগেই মতুয়াদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। সেটাই বিষয় আজকে, মতুয়া ভোট আর বিজেপির মিথ্যাচার।
কারা শরণার্থী? কীভাবে চিহ্নিত হবে শরণার্থী? তাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রক্রিয়াটা কী হবে? ধরে নিলাম নির্মল ঠাকুর একজন মতুয়া এবং তিনি শরণার্থী। মানে বাংলাদেশ ছেড়ে ১৯৭১-এ এই বাংলাতে চলে এসেছেন। তো সিএএ অনুযায়ী তাঁকে একটা ফর্মে লিখিতভাবে জানাতে হবে যে তিনি এই দেশের নাগরিক নন, বাংলাদেশের নাগরিক। কিন্তু এটা বললেই তাঁকে এদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না, তাঁকে বলতে হবে যে রিলিজিয়াস পার্সিকিউশন, মানে ধর্মাচরণের জন্য তাঁর উপরে অত্যাচার হয়েছে, মানে মারধর হয়েছে, বাড়ি ভাঙা হয়েছে, এবং বললেই হবে না, তার প্রমাণ দিতে হবে। কী প্রমাণ? কেন? বাংলাদেশের যেখানে তিনি থাকতেন সেখানে থানায় জমা করা অভিযোগপত্র ইত্যাদি। কার কাছে সেই অভিযোগ পত্র থাকবে? আছে? নেই? তাহলে নিয়ে আসুন, খুলনা জেলার অমুক শহরে গিয়ে থানাতে বলতে হবে একটা অভিযোগপত্র বানিয়ে দিন। কে দেবে? ধরুন দিল, এবার সে সব এনে জমা দিতে হবে। সরকারি ব্যাপার, সময় তো লাগবে। আর নির্মল ঠাকুর তো একলা নন, বহু মানুষ আছে, সবার আবেদনপত্র বিবেচনা করে নাগরিকত্ব দিতে হবে।
আরও পড়ুন: Aajke | দিলু ঘোষ আর কুণাল ঘোষের গল্প
মানে এই দীর্ঘ সময়ে, কম করে ছয় কি আট মাস আপনি দেশের নাগরিক নন। কেবল তাই নয়, আপনার পুত্র বা কন্যা, তাঁরাও নাগরিক নন, যদি তাঁরা সরকারি চাকরি পেয়ে থাকেন তাহলে তা বেআইনি, সেগুলো বাতিল হবে। কারণ দেশের নিয়ম অনুযায়ী একজন যিনি নাগরিকই নন, তিনি সরকারি চাকরি করতে পারবেন না। এবং এইসব বিচার করেই দেশের মানুষ বলেছিল, যাঁরা শেষ নির্বাচনে ভোটার তালিকাতে আছেন, তাঁরা সবাই নাগরিক, যাঁদের কাছে আধার বা পাসপোর্ট আছেন তাঁরা নাগরিক, যাঁদের রেশন কার্ড আছে তাঁরাও নাগরিক। আর আমাদের কাছে নাগরিকত্বের প্রমাণ চাইলে, যারা আমরা এই মাটিতেই দীর্ঘদিন বসবাস করেছি, পড়াশুনো করেছি, এই মাটিতেই আমাদের উত্তরপুরুষেরা জন্ম নিয়েছে, পূর্বপুরুষেরা কেউ শ্মশানে, কেউ কবরে, তারা আমরা, কাগজ দেখাব না। অমিত শাহ মোদিজি থমকে গিয়েছিলেন। আজ শান্তনু ঠাকুর আবার নির্বাচনের আগে সেই মিথ্যাচারে নেমেছেন। আমরা আমাদের দর্শকদের প্রশ্ন করেছিলাম, সেই কবে থেকে এই বাংলাতেই বসবাসকারী মতুয়া মানুষজন কি আমাদের দেশের নাগরিক নন? তাঁদের আবার নতুন করে নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলে বিজেপি কি আসলে এক নোংরা রাজনীতিই করতে চাইছে না? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
CAA নিয়ে দেশের আর আমাদের রাজ্যের রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান ভারি গোলমেলে। কংগ্রেস চিরটাকাল ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি করেছে। তাদের দখলে ছিল মুসলমান, তফসিলি জাতি উপজাতিদের ভোট, আদিবাসীদের ভোট। তারা এই ভোটকে তাদের বাপের সম্পত্তির মতন ব্যবহার করেছে। উদ্বাস্তুদের লড়াইয়ের পাশে ছিল বামপন্থীরা, সিপিএম সিপিআই তারা এই ভোট পেত। অনুপ্রবেশ তাদের কাছে ভোট ব্যাঙ্ক বাড়ানোর উপায় ছিল, তারা এ নিয়ে খুব একটা উচ্চবাচ্য করেনি। নৈতিকভাবেও ওপার বাংলার মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কথা বাম বুদ্ধিজীবীরা বহুকাল ধরেই বলে এসেছে। সিপিএম মতুয়া, নমশূদ্রদের ভোট পাওয়ার জন্য, নাগরিকত্ব বিলে সংশোধনী আনার জন্য পার্টির কোঝিকোড় কংগ্রেসে প্রস্তাবও নিয়েছিল। সেইসময়ের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাত চিঠি লিখেছিলেন প্রধানমন্ত্রীকে যার সারমর্ম আজকের নাগরিকত্ব আইনের সঙ্গে মিলে যায়। তৃণমূল প্রথমে এই অনুপ্রবেশকারী ভোট, উদ্বাস্তু ভোটের কথা বুঝতে পারে, তখন এই ভোটারদের ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লোকসভায় স্পিকারের মুখে কাগজ ছুড়ে মারেন। আপাতত তাঁরা সিএএ-এর বিরোধী। এ রাজ্যের কংগ্রেসও এই প্রশ্ন বহুবার তুলেছে। কিন্তু সে সবের উপরে উঠে এক আজগুবি আইন এনে মতুয়াদের ভোট পাওয়ার জন্য এক নোংরা রাজনীতিতে নেমেছে বিজেপি, আজ আবার তা পরিষ্কার।