মমতা রুখে দাঁড়ালেন, নির্বাচন কমিশন মাথা নোয়াল। বিহারের ভোটার তালিকার সংশোধনের (স্পেশ্যাল ইন্টেনসিভ রিভিশন) বিরোধিতায় সুর চড়িয়েছিলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার কয়েক দিনের মধ্যেই সংশোধন নিয়ে নতুন বিজ্ঞপ্তি জারি করল নির্বাচন কমিশন। বিহারের ভোটার তালিকায় সার্বিক সংশোধনের জন্য বেশ কিছু নির্দেশিকা জারি করা হল। সোমবার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে, বেশ কয়েকটি শর্ত শিথিল করেছে নির্বাচন কমিশন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজ্যে শেষবারের স্পেশ্যাল ইন্টেনসিভ রিভিশনের পরে প্রকাশিত ভোটার তালিকা নির্বাচন কমিশন আপলোড করছে তাদের ওয়েবসাইটে। জানা যাচ্ছে সাধারণ ভোটার থেকে বুথ লেভেল অফিসার (বিএলও), সবাই পুরো তালিকা দেখতে পাবেন। কারও নাম ওই ভোটার তালিকায় থাকলে তাঁদের আর স্পেশ্যাল ইন্টেনসিভ রিভিশনের যাচাইয়ের সময়ে জন্মস্থান বা জন্ম তারিখ বা অন্য কোনও নথি জমা দিতে হবে না। যাঁদের নাম নেই, তাঁদের ক্ষেত্রেও কমিশন একই রকম নির্দেশ দিয়েছে। সে ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের জন্মস্থান ও জন্ম তারিখ সংক্রান্ত নথির কোনও একটাও যদি না থাকে তাহলেও সমস্যা হবে না। নিজের না থাকলেও ওই ভোটার তালিকায় বাবা-মায়ের নাম থাকলেও, তা প্রামাণ্য নথি হিসেবেই বিবেচিত হবে। এর আগে কমিশন ১৯৮৭ সালের ১ জুলাইয়ের আগে যাঁরা জন্মেছেন তাঁদের জন্ম তারিখ বা জন্মস্থানের যাচাইয়ের জন্য ১১টি নথির কোনও একটা চাওয়ার প্রস্তাব রেখেছিল। ১৯৮৭ সালের ১ জুলাই থেকে ২০০৪ সালের ২ ডিসেম্বরের মধ্যে যাঁদের জন্ম, তাঁদের জন্মতারিখ অথবা জন্মস্থানের প্রমাণস্বরূপ একটা নথি এবং তাঁদের বাবা কিংবা মায়ের জন্মতারিখ অথবা জন্মস্থানের প্রমাণ চাওয়া হয়। মমতা প্রতিবাদ করেছিলেন, সকলের পক্ষে বাবা-মায়ের জন্ম তারিখের শংসাপত্র দেওয়া সম্ভব নয়। তাই সকলের পক্ষে এই নথি পেশ করা সম্ভব নয়। এই যুক্তি মেনেই কমিশন শেষবার স্পেশ্যাল ইন্টেনসিভ রিভিশনের প্রকাশিত ভোটার তালিকা ওয়েবসাইটে আপলোড করবে। সেটাই বিষয় আজকে, আবার মমতা ম্যাজিক।
কিন্তু বিষয়টা অত সহজও নয়। কারণ নির্বাচন কমিশন শুধুমুধুই একটা নির্দেশিকা জারি করেছিল এমনও নয়। ভোটের আগেই বিহারে এক ভয়ঙ্কর খেলা শুরু হয়েছে। বহু নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার খেলা। বাইরে থেকে দেখতে নিরীহ — নির্বাচন তালিকার ‘বিশেষ ও ব্যাপক সংশোধন’ চলছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে এই কাজ আসলে এক বড় ষড়যন্ত্র।
আরও পড়ুন: Aajke | ধর্ষণ হয়েছে, তাই মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ চাই?
লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষ, হিন্দু হোক বা মুসলিম, সবাইকেই ঝুঁকির মুখে ফেলা হচ্ছে। এই সংশোধনের নামে প্রথমে লাখ লাখ মানুষকে ‘D ভোটার’ (ডাউটফুল ভোটার) ঘোষণা করা হবে। তারপর তাদের ‘বিদেশি’ বলে চিহ্নিত করা হবে, আর শেষে এনআরসি থেকে নাম কেটে দিয়ে রাষ্ট্রহীন (বেনাগরিক) করে দেওয়া হবে— ঠিক যেভাবে অসমে হয়েছিল। এটাই আসল টার্গেট। আর এর পেছনে বিজেপির খুব পরিষ্কার রাজনৈতিক পরিকল্পনা আছে— ২০২৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া। কিন্তু প্রথমে বিহারেই কেন এই খেলা? বিহারে বিজেপি এখন এককভাবে ক্ষমতায় নেই। তারা চায় যে কোনও মূল্যে ২০২৫-এর বিধানসভায় জিতে সরকার গড়তে। কারণ ঠিক এই মুহূর্তে লড়াই এক্কেবারে কাঁটে কা টক্কর বিহারের বড় একটা অংশের মানুষ — যারা গরিব, ভূমিহীন, এবং বহু কষ্টে ভোটাধিকার অর্জন করেছেন — তারা সাধারণত বিজেপিকে ভোট দেন না। বিজেপি তাই ঠিক করেছে, এদের ভোটাধিকারই কেড়ে নেবে! বিহারে প্রায় ১৮ শতাংশ মুসলিম ভোটার আছেন। তার মধ্যে ১২–১৩ শতাংশ খুব গরিব, বঞ্চিত পরিবার থেকে আসা। এদের অনেকেরই জন্মসনদ নেই, বাবা-মার স্কুল সার্টিফিকেট নেই, কাগজ নেই — তাই সহজেই বলা যাবে ‘এরা সন্দেহজনক’। শুধু মুসলিম নয়, গরিব হিন্দু, দলিত, ও পিছিয়ে পড়া শ্রেণির মানুষরাও এই ফাঁদে পড়বেন। তাদের বলা হবে — প্রমাণ নেই, তুমি বিদেশি! এইভাবে লাখ লাখ মানুষকে ভোটার তালিকা থেকে বাদ দিয়ে বিজেপি ও তাদের শরিক দল জনতা দল ইউনাইটেড, চিরাগ পাসোয়ানের লোক জনশক্তি ইত্যাদি বিহারে জিতে যাবে। আর তারপর লোকসভাতেও বিজেপির জন্য রাস্তা একদম পরিষ্কার হয়ে যাবে। এবং তারপর পশ্চিমবঙ্গের পালা, ওখানে পদ্ধতিটা টেস্ট করে নেওয়া হচ্ছে, আসল প্রয়োগ তো বাংলাতেই হবে। পশ্চিমবঙ্গেও পরিকল্পনা তৈরি। উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, মালদা, দিনাজপুর, কোচবিহার— এই সব সীমান্তবর্তী এবং সংখ্যালঘু অধ্যুষিত জেলাগুলোতে শুরু হবে ব্যাপক D ভোটার বানানোর অভিযান শুরু হবে। মুসলিমদের বলা হবে— “তোমার কাগজ নেই, তাই তুমি সন্দেহভাজন।” রাজবংশী, কামতাপুরি, নমঃশূদ্ররা, যাঁরা বহুদিনের বাসিন্দা হলেও গরিব বলে কাগজ জোগাড় করতে পারেননি, তাঁরাও D ভোটার হয়ে যাবেন। দেশভাগের সময় ছিন্নমূল হয়ে এদেশে আসা বহু হিন্দু পরিবারেরও কাগজ নেই, তাঁরাও এই ঝুঁকিতে পড়বেন। আদিবাসী ও খেটে খাওয়া গরিব মানুষ, যাঁরা আজ শহরে এসে বাস করছেন, জীবিকা খুঁজছেন, তাঁরাও কাগজহীন বলে বাদ পড়বেন। এঁরা অনেকেই রাজ্য সরকারের ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’-এর মতো প্রকল্পের সুবিধাভোগী, আর তাই এক বড় অংশ তৃণমূলের ভোটার। বিজেপি আসলে নির্বাচন কমিশনকে ব্যবহার করে তৃণমূলের ভোট ব্যাঙ্কেও কাঁচি চালাতে চাইছে। ঠিক সেইখানেই ঘা দিয়েছেন মমতা। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই মুহূর্তে ভোটার তালিকা সংশোধনের জন্য বাপ-ঠাকুরদার জন্ম বাসস্থান সংক্রান্ত কাগজ দেখানোর নামে কি দিল্লির সরকার এনআরসি লাগু করে মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নিতে চাইছে? সেই জন্যেই কি মমতা রুখে দাঁড়ালেন? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
এর আগেও ভোটার লিস্টে অসংখ্য ভুয়ো, ভুতুড়ে ভোটার ঢোকানোর চেষ্টা আটকে ছিলেন মমতা। এবারে ভোটার তালিকা সংশোধনের নামে এনআরসি চালু করে নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার চেষ্টার বিরুদ্ধে তিনিই সোচ্চার হলেন। অথচ বিরোধী দলগুলোকে দেখুন, তাঁদের চোখেও পড়ে না এই সাংঘাতিক চক্রান্ত। এটা কেবল সংখ্যালঘুদের সমস্যা নয়। এ ফাঁদে পড়বেন গরিব হিন্দু, দলিত, আদিবাসী, দেশের প্রতিটি রাজ্যের কাগজবিহীন মানুষ। এখনই একটা ঐক্যবদ্ধ নাগরিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। ধর্ম, জাত, বর্ণ, রাজনীতি — সব পার্থক্য ভুলে সবাইকে বলতে হবে: CAA 1985, 1986, 2003, 2019 বাতিল করতে হবে। নাগরিকত্ব আইন 1955 অক্ষত রাখতে হবে। তাহলেই এই নাম কাটার ফাঁদ বন্ধ হবে। না হলে লাখ লাখ মানুষ রাতারাতি পরিণত হবেন বেনাগরিকে। এটা শুধু একজন মানুষের ভোট কাটা নয়, এটা গণতন্ত্রের শ্বাসরোধ।