হঠাৎ ঠ্যালায় পড়ে দলবদল করে কিংবা পাকেচক্রে সব খুইয়ে যাঁরা মমতাপন্থী হয়েছেন, তাঁদের অনেকে ওনার মধ্যে লেনিন, মার্কস খুঁজে পান, উনিই আদত বামপন্থী এমন একটা ন্যারেটিভ সাজিয়ে হাস্যকরভাবেই তোষামোদ করেন, আমার ধারণা সেটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বেশ বোঝেন, সম্ভবত উপভোগও করেন। হ্যাঁ, একদা যাঁরা যাঁরা এই নেত্রীর নামে যত কটু কথা বলেছিলেন, সেই তাঁদেরকে তিনি অনায়াসে দলে নিয়েছেন, অনেকের চোখ কপালে উঠেছে, সে তিনি সুব্রত মুখার্জি, সোমেন মিত্র বা সৌগত রায় বা যেই হোক না কেন। সে সব দেখে বহু মানুষের চোখ কপালে উঠেছে, কিন্তু এটাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, বিরুদ্ধে যাঁরা সবল, তাঁদের দুর্বল মুহূর্তে দলে নিয়ে আরও দুর্বল করে দেওয়ার পদ্ধতিটা শেখার মতো। এবারে সেই বিরাট বিরোধীকে মমতার নেতৃত্ব মেনেই ওই দলেই থেকে যেতে হবে, আর যদি বা আবার বিরোধী হয়ে ওঠেনও তাহলেও সে বিরোধিতা কারও কাছে পাত্তাও পাবে না। সোমেন মিত্রের শেষ ক’টা দিন দেখে নিন বুঝে যাবেন। তো যাই হোক আজ আমি দলবদলের ইতিহাস লিখতে বসিনি, যা বলার তা হল ডান বাম বা মধ্যের ঊর্ধ্বে এক অসম্ভব প্রাগম্যাটিক, বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন নেত্রী বলতে যা বোঝায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আসলে তাই। যুদ্ধ শুরু হল, দক্ষিণপন্থীরা যুদ্ধে চলো, সিঁদুর মাখো গোছের উন্মাদনায় ফুটছেন, অন্যদিকে বামেরা হ্যাঁ, উহুঁ, কিন্তু আসলে ইত্যাদি প্রভৃতি বলে যুদ্ধ বিরোধিতা আবার দেশের যুদ্ধকে সমর্থন, এই দুই অবস্থানে পেন্ডুলামের মতো টিকটক করছেন। সেই সময়ে মমতা বন্দ্যোপধ্যায় সাফ জানালেন, কেন্দ্র সরকার, মানে মোদিজির সরকার যে সিদ্ধান্ত নেবে আমরা সেই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করব। অন্য কোনও কথা ছিল না। এবারে যুদ্ধ শেষ। ট্রাম্পের কথাবার্তা, সারা পৃথিবীতে ভারতের সমর্থনে ভাটা এসবের প্রেক্ষিতে এবারে বিরোধীদের হয়ে প্রথম কথাটা বলে দিলেন মমতা ব্যানার্জি, মোদিজি, সংসদের অধিবেশন ডাকুন, কী হয়েছে বলুন। সেটাই বিষয় আজকে, বিড়ালের গলায় ঘণ্টাটা বেঁধে দিলেন মমতা।
যুদ্ধ বিরতি হওয়ার খবর তো মোদিজি দেননি, দিয়েছেন ট্রাম্প সাহেব, একবার নয় বার ছয়েক তিনি খুব পরিষ্কার বলেছেন তাঁর কথা মেনেই যুদ্ধবিরতি হয়েছে। পাকিস্তানও বলছে, হ্যাঁ, ট্রাম্প সাহেবকে ধন্যবাদ, ট্রাম্প সাহেব বলছেন এক অনিবার্য পরমাণু যুদ্ধ এড়ানো গেল। কিন্তু এসবে মধ্যে মোদিজির মুখে কোনও কথা নেই। ওদিকে ৮৬০০ কোটি টাকার প্লেনে চেপে এদেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ানোর পরে এক সংকট মুহূর্তে ভারতের পাশে একটা দেশও এসে দাঁড়ায়নি, পাকিস্তানে পাশে চীন, আজারবাইজান, কাজাকিস্তান, তুরস্ক। সব মিলিয়ে মোদিজির বিশ্বগুরুর ছবিতে টন টন গ্যামাক্সিন। তারমধ্যে পোস্টার ছাপা হয়ে গেছে মোদিজির যুদ্ধে যাওয়ার ছবি।
আরও পড়ুন: Aajke | সিঁদুর নিয়ে দু’ চার কথা, যা মোদিজি জানেন না
এদিকে বিশ্ব জনমত তৈরি করতে সবদল থেকে নেতাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দেশে-বিদেশে। সেই প্রতিনিধি দলে জনা দশেক সংখ্যালঘু মুসলমান, দুজন খ্রিস্টান। ওদিকে মোদিজির মন্ত্রিসভার কথা বাদই দিলাম, একজন সংখ্যালঘু সাংসদও নেই। শেষমেশ তাঁর রক্তগরম করা ভাষণে চাকা ঘোরানোর চেষ্টা, মোদিজি জানালেন তাঁর রগ রগ মে, শিরায় শিরায় বইছে সিঁদুর, আবার বিপাকে। এবং ঠিক এই সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দুটো কাজ করেছেন, ১) তৃণমূলের এক সংসদীয় দলকে পাঠালেন পুঞ্চ ইত্যাদি এলাকাতে, যেখানে কামানের, মর্টারের গোলায় ভেঙেছে বাড়িঘরদোর, যেখানে নিহতদের ১০০ শতাংশ সংখ্যালঘু মুসলমান, সেই অঞ্চলে গিয়ে তাঁরা কথা বললেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রাহুল গান্ধী গেলেন পুঞ্চে। না, বাংলার বিজেপি সাংসদদের দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গোল খাওয়া ছাড়া আর কিছুই উপায়ও ছিল না। আর তার পরেই মমতা তাঁর ব্রহ্মাস্ত্রটা বার করলেন। মোদিজি, সংসদের অধিবেশন ডাকুন, মানুষকে জানান কী হয়েছিল? জানান সত্যিটা কী? হ্যাঁ, বিড়ালের গলায় ঘণ্টাটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বেঁধে দিলেন আর আমি নিশ্চিত আগামী ক’ মাস সেই ঘণ্টা বাজবে, ল্যাজেগোবরে হবেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন যুদ্ধ হল? যুদ্ধে কী হল আর যুদ্ধবিরতিই বা কেন হল সেই কথাগুলো মোদি সরকার সংসদের সামনে রাখছেন না কেন? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই দাবি তুললেন, সেটা কতটা যুক্তিযুক্ত? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
মোদি সরকার আগের অনেকবারের মতো এক উগ্রপন্থার ঘটনাকে নিয়ে দেশপ্রেমের জোয়ার বইয়ে সেই জোয়ারে নিজেদের উচ্চতা বাড়ানোর কাজে নেমেছিলেন। কিন্তু সেই খেলাতে কয়েকটা গন্ডগোল হয়েছে। ১) বিশ্ব রাজনীতিতে এতদিন ধরে বুক চাপড়ানো বিশ্বগুরু যে এক্কেবারে একলা হয়ে গেছে সেটা এখন বিশ্বের সামনে পরিষ্কার। ২) ট্রাম্প সাহেব হাটের মাঝে হাঁড়ি ভেঙে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তিনি অনায়াসে দখলদারি করার ক্ষমতা রাখেন। ৩) যে কোনও কারণেই হোক, মোদি সরকার ট্রাম্প সাহেবের সত্যি বা মিথ্যে কথার দায় নিয়ে অক্ষম। আর সেটা বুঝেই মাস্টারস্ট্রোক মমতা ব্যানার্জির, সংসদের অধিবেশন ডাকুন, সবটা পরিষ্কার করুন, দেখা যাক এবারে ক’টা গোল হজম করতে হয় আমাদের নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদিজিকে।