চরণদাসকে রাজসভায় ধরে আনা হল, ব্যাটা গান গায়, এত বড় স্পর্ধা। চরণদাস জানিয়েছিল গান আর জান তার কাছে সমার্থক, সে গান ছেড়ে তো বাঁচতে পারবে না। তো হীরকের রাজা তাকে গান গাইতে বলল, চরণদাস গান ধরল…। কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়, ও ভাই রে, কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়। রাজা আর তার পারিষদ দু’লাইন শুনেই আনন্দে ঘাড় নাড়ল, খাসা গান। কিন্তু তারপরে? গানের লাইনে কী ছিল? ক’টা সত্যি কথা। কী কথা? মনে আছে? মনে করিয়ে দিই।
দেখো ভালো জনে রইল ভাঙা ঘরে,
মন্দ যে সে সিংহাসনে চড়ে।
ও ভাই সোনার ফসল ফলায় যে তার
দুই বেলা জোটে না আহার,
সোনার ফসল ফলায় যে তার
দুই বেলা জোটে না আহার।
হীরার খনির মজুর হয়ে কানাকড়ি নাই,
ও ভাই হীরার খনির মজুর হয়ে কানাকড়ি নাই।
ও তার কানাকড়ি নাই, ওরে ভাই রে,
ওরে ভাই রে, ভাই রে
কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়।
ব্যস, কেবল গান গাওয়ার দোষে চরণদাসকে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হল জেলে। কিন্তু কেবল গান গাওয়ার জন্যই কি? না, গান গাওয়া নয়, সত্যি কথা বলার জন্যই তাকে জেলে পাঠানো হয়েছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে বার বার বহু মানুষ জেলে গিয়েছেন সত্যি কথা বলার জন্য। ১৬৩৩-র ১২ এপ্রিল ভ্যাটিকান চার্চে ডেকে পাঠানো হয়েছিল গ্যালিলিও গ্যালিলিকে, তাঁর বিচার হবে। কারণ তিনি বলেছেন পৃথিবী সূর্যের চারধারে ঘোরে। অথচ বাইবেলে লেখা আছে যে সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে। এমন কথা যে গ্যালিলিও এই প্রথম বললেন তাও নয়, তিনি ১৬১৬-তেও এমন কথা বলে ডাক পেয়েছিলেন। সেবারে খানিক বকাঝকা করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু এবার রীতিমতো বিচারসভা বসানো হল এবং বিচারের রায়ও এল, “We pronounce, judge, and declare, that you, the said Galileo… have rendered yourself vehemently suspected by this Holy Office of heresy, that is, of having believed and held the doctrine that the sun is the center of the world, and that it does not move from east to west, and that the earth does move, and is not the center of the world.” তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা হল, জেলে পাঠানো হল। ইতিহাসে সক্রেটিস থেকে গান্ধী থেকে মার্টিন লুথার কিং থেকে নেলসন ম্যান্ডেলা বার বার জেলে গিয়েছেন, শাস্তি পেয়েছেন সত্যি কথা বলার জন্য। এই কথাগুলোই বিচারকের সামনে বললেন আমাদের চ্যানেল সম্পাদক কৌস্তুভ রায়। বললেন, কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়। সেটাই বিষয় আজকে।
আরও পড়ুন: কৃষ্ণনগরের রানিমাকে মোদিজি আসলে কী বলতে চাইলেন?
সত্যিই তো এ এক রগড় চলছে, ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে নির্লজ্জের মতো তোলাবাজি করছে দেশের সরকার, দেশের প্রধানমন্ত্রী। ব্যবসায়ী, শিল্পপতিদের ঘরে ইডি পাঠিয়ে, সিবিআই পাঠিয়ে ভয় দেখিয়ে তোলা আদায় চলছে, তার অকাট্য প্রমাণ এখন দেশের সামনে। দেশ নয় সারা পৃথিবী এই জালিয়াতির কথা জেনে ফেলেছে, তারপরেও লোক জুটিয়ে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিকে বলছেন এই সত্যকে ঢেকে রাখতে। একজন ব্যবসায়ীর ঘরে ইডি গেল, ক’দিনের মধ্যেই সে বিজেপির নির্বাচনী ফান্ডে কোটি কোটি টাকা দিয়ে দিল। একজন ব্যবসায়ীর হাতে দেশের ডজন ডজন কয়লার খনি, বিমান বন্দর, জাহাজ বন্দর, রেল, জল জঙ্গল তুলে দেওয়া হচ্ছে, সেই কোম্পানি চার পাঁচটা করে মিডিয়া কিনে নিয়ে তাতে জয় হো জয় হো বলে প্রচার চালাচ্ছে, সবক’টা চ্যানেলে আয়েগা তো মোদি হি বলে স্লোগান উঠছে। দেশের নটোরিয়াস লটারি টিকিট বেচনেওয়ালার ঘরে রেড করছে ইডি, যাচ্ছে সিবিআই, প্রপার্টি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সিজ করছে অথচ তিনি টাকা দিচ্ছেন দুই আঞ্চলিক দলকে, যাঁদের হাতে না আছে ইডি, না আছে সিবিআই। সত্যিই কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়। কোন নির্বোধ সিবিআই-ইডির ক্লান্তিহীন রেডের মুখে বিরোধী দলকে নির্বাচনী চাঁদা জোগাবে? এসব বিশ্বাস করতে হবে। বিশ্বাস করতে হবে যে একইভাবে বিভিন্ন অপরাধীদের বিভিন্ন অপরাধের জন্য গ্রেফতার করার পরে তাদের বিবৃতির ভিত্তিতে একজন নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেফতার করা হচ্ছে? নাকি স্রেফ নির্বাচনের আগে বিরোধীদের জেলে ঢুকিয়ে রাখার চক্রান্ত চলছে। একই ঘটনা ঘটেছে আমাদের সঙ্গেও। অভিযুক্ত নয়, শাস্তিপ্রাপ্ত এক অপরাধীর ভুয়ো বয়ান, যাতে খালি চোখেই অসংখ্য গরমিল ধরা পড়বে তার ভিত্তিতে আমাদের চ্যানেল সম্পাদক কৌস্তুভ রায়কে গ্রেফতার করা হয়েছে, তিনি জেলে। তিনি কাল বিচারককে নিজেই সেই ভুয়ো অভিযোগের কহানি শুনিয়েছেন। বিচারক ডেকে পাঠিয়েছেন ইডির তদন্তকারী অফিসারদের, আমরা বিচারের প্রক্রিয়ার দিকে নজর রাখব, কিন্তু আমাদের প্রশ্ন নির্বাচনী বন্ডের এই ধাপ্পাবাজি, এই জোচ্চুরি ধরা পড়ার পরে কেন দেশের প্রধানমন্ত্রী, দেশের অর্থমন্ত্রী, দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জেলে পাঠানো হচ্ছে না? কেন তার বদলে প্রতিবাদীরা জেলে? আমাদের এই প্রশ্নের জবাবে আমাদের দর্শকেরা কী বলেছেন শুনুন।
হ্যাঁ, ভালো লোকে জেলে পচে মরে আর মন্দ লোকে সিংহাসনে চড়ে, নিজের গানের কথা বদলে এটাই গাইতেন চরণ দাস। অনেক হয়েছে, এবার সময় দড়ি ধরে টান দেওয়ার, রাজাকে খান খান করার। গতকাল আমাদের সম্পাদক বিচারকের সামনে হাজির ছিলেন, হাজির ছিলেন দিল্লির নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী, তিনি সার কথাটা বলে ফেলেছেন, বলেছেন কে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে? ইডি অফিসারদের তথ্য অনুযায়ী একজন বিচারাধীন আসামী আমার বিরুদ্ধে বয়ান দিয়েছে, তার ভিত্তিতে যদি আমাকে গ্রেফতার করা যায়, তাহলে আমি এখনই বয়ান দেব, আমার বয়ানের ভিত্তিতে কি নরেন্দ্র মোদিকে গ্রেফতার করা হবে? সারা আদালতে ছিল পিন ড্রপ সাইলেন্স। মাথায় রাখুন ঝড়ের আগে সব থেমে যায়, নিস্তব্ধতা নেমে আসে, তারপর আসে ঝড়, সব ওলটপালট করে দেয়।