নজরুলের গান লেখার প্রায় শুরুয়াত এই ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’। তার আগে তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন, উর্দু গজল গাইতেন, শৈলজানন্দের হোস্টেল বাড়িই ছিল যুদ্ধক্ষেত্র করাচি থেকে ফেরার পরে নজরুলের আড্ডার জায়গা। জমাটি আড্ডা, কবিতা আর গান। এই গান লেখা আর সুর দেওয়ার কিছুদিন আগেই তিনি লিখেছেন বিদ্রোহী কবিতাখানা। সেই জমানাতে এক মুসলমান নামধারী মানুষ লিখছেন আমি ভগবান বুকে একেঁ দেব পদচিহ্ন, ভাবা যায়! এবং সেই বিদ্রোহী কবিতা নিয়ে কী হই চই, নামই হয়ে গেল বিদ্রোহী কবি। দিন কুড়ি পরেই আবার লেখা, এবার গান, খানিকটা যুদ্ধের ব্যান্ড বাজছে এমন এক ছন্দ আর সুর নিয়ে কারার ঐ লৌহ কপাট। বিপ্লবীদের মুখে মুখে ঘুরতে শুরু করল। গানের প্রেক্ষিত নিয়ে নানা মতের একটা হল, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশকে জেলে পোরা হয়েছে, ওনার স্ত্রী বাসন্তী দেবী তাঁর পত্রিকার জন্য কবিতা চেয়ে পাঠিয়েছেন, নজরুল কারার ঐ লৌহ কপাট লিখলেন। গান কি তখনই গাওয়া হয়েছিল? না, বেশ কিছুদিন পরে নজরুল রাজরোষে পড়লেন, বই বাজেয়াপ্ত হল, তাঁকে জেলে পোরা হল। সেই জেলে বসেই এই গান গেয়েছিলেন নজরুল, এমনটাই অনেকে বলেন। ওই জেলেই ছিল হিন্দু-মুসলমান বিভাজন, তা নিয়েও নজরুল সেই তখনই লিখেছিলেন, দে গরুর গা ধুইয়ে, উলটে গেল বিধির বিধি, আচার বিচার ধর্ম জাতি, মেয়েরা সব লড়ুই করে, মদ্দ করেন চড়ুই-ভাতি! পলান পিতা টিকেট করে– খুকি তাঁহার পিকেট করে! গিন্নি কাটেন চরকা, –কাটান কর্তা সময় গাই দুইয়ে! দে গোরুর গা ধুইয়ে॥ ওই জেলেই ওনার সঙ্গেই পিকেট করে জেলে এসেছিলেন শিবরাম চক্রবর্তী। তাঁর কথাতেও জানা যায় নজরুল উদাত্ত গলায় গাইতেন কারার ঐ লৌহ কপাট, ভেঙ্গে ফেল, কর রে লোপাট, রক্ত-জমাট শিকল পূজার পাষাণ-বেদী। ওরে ও তরুণ ঈশান! বাজা তোর প্রলয় বিষাণ! ধ্বংস নিশান উড়ুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি। তো সেই গান আমাদের বাংলা বহু গানের মধ্যে অন্যতম, আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের গর্ব। সেই গানের গুষ্টির তুষ্টি করে ছেড়েছেন সুরকার মিউজিশিয়ান। এ আর রহমান, পিপ্পা নামের এক ছবিতে এই গান ব্যবহার করা হয়েছে। সে এক সাংঘাতিক জগঝম্প, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, বাউল পাঞ্চ করে এক কদর্য ব্যাপার। সেটাই আজ আমাদের বিষয় আজকে। এ আর রহমানের কারার ঐ লৌহ কপাট।
এ আর রহমান বাংলা জানেন? জানেন না। পরিচালক রাজা মেননও সম্ভবত জানেন না। কিন্তু কেউ তো জানেন, কোনও এক বাংলা জানা মাথা থেকেই তো এই গান ব্যবহার করার কথা বেরিয়েছিল। কেউ তো একজন এই গান নিয়ে হাজির করেছিলেন এ আর রহমানের সামনে। এবং যাঁরা গেয়েছেন? তাঁরা তো বাঙালি। কী আশ্চর্য, তাঁদের একজনেরও শিরদাঁড়া নেই, কেউ একজনও রহমানকে বলতে পারলেন না যে আপনি এই গানটার গুষ্টির কাঁথায় আগুন দিচ্ছেন কেন? কেউ বুঝিয়ে বললেন না গানটার মানে।
কেউ বললেন না বাঙালিরা লাথি মারে কী ভাবে, দেখিয়ে দিলেন না একটা সজোরে লাথি মেরে। অন্তত বোঝানো যেত কতটা জোর লাগে লাথি মার ভাঙ রে তালা বলতে। রহমানের কেন অধিকাংশ অবাঙালি মিউজিশিয়ান, মুম্বই কালচারে বড় হওয়া বাঙালি মিউজিশিয়ানের মাথায় বাংলা গান, সুর মানেই ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, বাউল, ঝিঙ্কি ঝিনাক ঝিঙ্কি ঝিনাক, কিম্বা ট্যাটাং ট্যাটাং, রহমান আলাদা হতে যাবেন কেন? কাজেই তিনি সুর দিয়ে ফেললেন। পয়সা পেয়েছেন, সুর দিয়েছেন বাংলার মানুষেরা শুনে বমি করছে, ওনার তাতে কীই বা এসে যায়। এমনও নয় যে আগে কেউ সুর দিয়েছেন বলেই আবার সুর দেওয়া যাবে না, এরকম বলার মতো অসুর আমি নই। কিন্তু সুর দেওয়ার আগে মানেটা বুঝতে হবে তো। গানে কী বলা আছে না জানলে ওই ট্যাটাং ট্যাটাংই হবে, হয়েছে। গান ভাইরাল, সিনেমার নাম ভাইরাল, রহমান আবার বাঙালিদের মুখে মুখে, নেগেটিভ পাবলিসিটি ইজ অলসো এ পাবলিসিটি। আমরা আমাদের দর্শকদের প্রশ্ন করেছিলাম, কারার ঐ লৌহ কপাটের মতো এক গানকে যে বিকৃত সুরে গাওয়া হয়েছে তা নিয়ে আপনার মতামত কী? এই মুহূর্তে বাংলার প্রত্যেক সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সংগঠনের কাজটা কী এই অসম্ভব বাজে কুৎসিত এক প্রয়াসের বিরুদ্ধে কথা বলা নয়? এই মুহূর্তেই রাজ্যের প্রতিটি বুদ্ধিজীবীর এই জঘন্য প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে সরব হওয়াটাই কি প্রথম কাজ নয়? শুনুন তাঁরা কী বলেছেন।
পৃথিবীর বহু গান বহু মানুষ আবার নতুন করে সাজিয়েছেন, নতুন সুর দিয়েছেন, এই রহমানই যখন নতুন করে বন্দে মাতরম সুর দিলেন তখন তা অনেকের পছন্দ নাই হতে পারে, এই কুৎসিত ব্যাপার তো হয়নি। বহু হিন্দি গান রি-মেক হচ্ছে। হেমাঙ্গ বিশ্বাস ‘নাম তার ছিল জন হেনরি’ গেয়েছিলেন, তার বহু পরে কবির সুমন ওই জন হেনরিকে নিয়ে গান লেখেন শঙ্কর মুদি ছবির জন্য। প্রথমটা খুব ভালো, দ্বিতীয়টাও পাল্লা দিয়েই ভালো। গানে সুর দেওয়ার প্রথম শর্ত গানের কথার মানে বোঝা, সেটা কি এ আর রহমানের মতো মিউজিশিয়ান ভুলে গেছেন? নাকি এ এক জেনেশুনে প্রচারের লক্ষ্যে এক বাজে পরিকল্পনা? যাই হোক, এর প্রতিবাদ হওয়াটা বড্ড জরুরি।