হ্যাঁ, দেওয়ালের লিখন খুব পরিষ্কার, শুভেন্দু অধিকারীর মুখ্যমন্ত্রী হওয়া হচ্ছে না, অষ্টম বামফ্রন্ট সরকার হচ্ছে না, অনেকের মনোকষ্ট থাকলেও সেই হাওয়াই চটি ফটর ফটর, সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আবার নীলবাড়িতে, আবার তিনিই মুখ্যমন্ত্রী। আমরা এই গত ১৩ জুন আমাদের আজকে অনুষ্ঠানে খুব স্পষ্টভাবে কোনও কিন্তু যদি হয়তো ইত্যাদি বাদ রেখেই বলেছিলাম ১) তৃণমূল কংগ্রেস ৫০ হাজারের বেশি ব্যবধানে জিতবে, জিতেছেন ৫০০৪৯ ভোটে। ২) আমরা বলেছিলাম বিজেপি ৩০ শতাংশের মতো ভোট পাবে, পেয়েছে ২৮.২৯ শতাংশ। ৩) আমরা বলেছিলাম এবারে বাম-কংগ্রেস জোট কিন্তু জামানত ধরে রাখবে, মানে তাদের ভোট বাড়বে। হ্যাঁ, বেড়েছে, পেয়েছে ২৮২৬২ মানে ১৫.২১ শতাংশ, হ্যাঁ আর এক শতাংশ ভোট এলে তারা জামানত বাঁচাতে পারত। আমরা বলেছিলাম, এটা উপনির্বাচন, বিজেপি ৩০ শতাংশ ধরে রাখতে পারলেই অনেক। সব মিলিয়ে ২২-২৩ শতাংশ ভোটের ফারাক তৈরি হয়ে যাবে। শেষ গণনার পরে তৃণমূল আর বিজেপির ভোটের ফারাক ২৭ শতাংশ। আর এসব বোঝার জন্য কোনও সমীক্ষার দরকার হয় না, কোনও স্যাম্পল সার্ভে আমরা করিনি, বা জ্যোতিষকে দিয়ে গণনাও করাইনি, আসলে জমির সঙ্গে সামান্য যোগাযোগ থাকলে এই ছবি সবার সামনেই স্পষ্ট হয়ে যাবে আর এই মুহূর্তে সেই জমির সঙ্গে যোগাযোগ তৃণমূলের আছে, আছে বলেই তারা অপ্রতিহত। এবং নিশ্চিত জেনে রাখুন আগামী ২০২৬-এর নির্বাচন এক্কেবারে এই ফরমুলাতেই চলবে। ২০২১ নির্বাচনে বাম-কংগ্রেস জোট পেয়েছিল ১১.৯৮ শতাংশ ভোট, এবারে সেটা ১৫.২৪ শতাংশ, মানে সাড়ে তিন শতাংশের বৃদ্ধি। দক্ষিণবঙ্গে এই বৃদ্ধি ৫ শতাংশ ছোঁবে। আর সেটা হলে তা আসবে সরাসরি বিজেপির ভোট বাক্স থেকে, সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, কালীগঞ্জ বলে দিল ২০২৬ এ আবার মমতা।
বিজেপি এই রাজ্যে ঐতিহাসিকভাবেই তার সমর্থনভূমি কোনওদিনও পায়নি। তাদের ভোট শতাংশ তখন ৪-৫-৬-এর বেশি ওঠেনি। কিন্তু তা খুব কম হলেও ক্রমশ বাড়ছিল, আধ শতাংশ, এক শতাংশ বাড়ছিল, আর সেগুলো ছিল জনসঙ্ঘ, পরে বিজেপির এক আদর্শভিত্তির সমর্থন। কেন গড়ে ওঠেনি সেই সমর্থনের জায়গাটা? কারণ উত্তর ভারতের কড়া ডোজের হিন্দুত্ব এই মাটিতে প্রত্যাখ্যান হয়েছে সেই স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় থেকেই। খানিকটা কড়া ধাঁচের হিন্দুত্ব ছিল বইকী সশস্ত্র বিপ্লবীদের মধ্যে, মা কালীর প্রতিমার সামনে আঙুল চিরে রক্ত দিয়ে বন্দেমাতরম ইত্যাদি ছিল, কিন্তু মুসলমান ঘৃণা নয়, তাদের তীব্র ব্রিটিশ বিরোধিতাই হিন্দু মহাসভা, আরএসএস-এর থেকে তাদেরকে আলাদা করেছিল। এবং এই বাংলার রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ছিল কংগ্রেসেরই মধ্যপন্থী আর বামপন্থী শিবিরের হাতে, যার উত্তরসূরি নেতাজি সুভাষ বসু।
আরও পড়ুন: Aajke | ক্ষুদিরাম সিং? দেশদ্রোহী সাভারকরের বাচ্চাদের বাঙালিকে অপমান
কাজেই শ্যামাপ্রসাদের হিন্দুয়ানা তিনি একা হাতেই সামলে নিয়েছিলেন। আবার স্বাধীনতার পরে বামেদের ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠা জনসঙ্ঘ আরএসএসকে বাড়তে দেয়নি, কিন্তু তাদের ওই ৫-৬ শতাংশ ভোট শুকিয়েও যায়নি, বরং ০.৫ শতাংশ হলেও বেড়েছে। ২০১৯, বিরাট অগ্রগতি ৪০.২৫ শতাংশ ভোট আর ১৮টা আসন, বাকি ২০টা আসনে দু’ নম্বর জায়গাতে ছিল, দলের সভাপতি দিলীপ ঘোষ। ২০২৪-এ সেই দল ৩৯.০৮ শতাংশ ভোট আর ১২টা আসন পেল, ৬টা আসন কমল, দলের সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। মানে যে গ্রাফ চড়চড় করে উঠছিল তা নামতে শুরু করেছে, যারা ২০১১-র বিধানসভাতে ৫.১৯ শতাংশ, ২০১৬-তে ১০.১৬ শতাংশ সেখান থেকে আজ বেড়ে ২০২১-এ ৩৮.১৩ শতাংশ হয়েছে বটে কিন্তু তা এক ইনঅর্গানিক গ্রোথ। মানে আপনার অ্যাকাউন্টে অন্য কারও টাকা হুশ করে ঢুকে গেলে, মনে হতেই পারে যে আপনি বিরাট বড়লোক, কিন্তু আসলে তা অন্য কারও টাকা। ঠিক সেরকম সিপিএম-এর বিরাট ভোট বিজেপির অ্যাকাউন্টে ঢুকে তাকে এক বিরাট চেহারা দিয়েছে বটে কিন্তু তার সঙ্গেই জন্ম দিয়েছে বিস্তর গন্ডগোলের। জন্ম নিয়েছে প্রবলেমস অফ গ্রোথ। ১) নেতৃত্বের লড়াই, ক্ষমতার লড়াই। অন্তত তিনটে, আর খতিয়ে দেখলে আপাতত বাংলা বিজেপিতে প্যারালাল চারটে শিবির কাজ করছে, শুভেন্দু, সুকান্ত, দিলীপ আর শমীক এই চার মাথার বিভাজন, চারজনের মধ্যে জায়গা বুঝে হাত ধরা আর ছাড়া, মানুষকে, মানে যে মানুষ মনেপ্রাণে তাদের নয়, কেবল পিঠ বাঁচাতে, বৃষ্টির জলের ঝাপট থেকে বাঁচতে ছাতার তলায় এসেছে, তাদেরকে বিভ্রান্ত করছে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত যে ন্যারেটিভটা সেট হয়েছিল যে বিজেপিই পারবে তৃণমূলকে হারাতে, সেখানে মানুষের আপাতত প্রগাঢ় বিশ্বাস, বিজেপি আর যাই হোক তৃণমূলকে হারাতে পারবে না, বা বিজেপি তৃণমূলকে হারাতে চায়ও না। ২) উপর থেকে তলার সারির কর্মী নেতারা এই চার শিবিরে স্পষ্টভাবে না হলেও তিন শিবিরে বিভক্ত। যাদের একসঙ্গে এনে দাঁড় করানোর মতো নেতা নেই। ৩) বিজেপির বহু নেতা যাঁরা অন্য দল থেকে এসেছিলেন তাঁরা হতাশ, তাঁদের এক বিরাট অংশ তৃণমূলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। ৪) কেন্দ্রীয় সরকার, মানে মোদিজির সরকার এখনও এমন কোনও কাজ করেনি যা ভোটারদের বড় অংশকে বিজেপিকে ভোট দিতে অনুপ্রাণিত করবে। ৫) মোদিজির আকর্ষণ কমছে, হু হু করেই কমছে, অপারেশন সিঁদুর যে প্রত্যাশা তৈরি করেছিল, আচমকা যুদ্ধবিরতি, ট্রাম্পের ভূমিকা মানুষকে অন্যভাবে ভাবতে বাধ্য করছে। ৬) দিলীপ ঘোষ বনাম শুভেন্দুর দ্বন্দ্ব আত্মঘাতী হতে বাধ্য। সারা বাংলায় তাদের ভোট এই হারেই কমবে, এই কালীগঞ্জ কেন্দ্রেই ২০২১-এ ৩০.৯১ শতাংশ ভোট পাওয়া এক দল ২০২৫-এ পাচ্ছে ২৮ শতাংশ ভোট, মানে ২ শতাংশ ভোট কমে যাওয়া। এবং এটা আরও অনেক কমবে যত দক্ষিণে নামবেন, মানে যত কলকাতার দিকে যাবেন, তত আসনগুলোতে বাম কংগ্রেসের ভোট বাড়বে, বিজেপির ভোট কমবে। সবমিলিয়ে ২০২৬-এর নির্বাচনে বিজেপি ৩২-৩৩ শতাংশের বেশি ভোট পাবে না। আমরা আমাদের দর্শকদের প্রশ্ন করেছিলাম, কালীগঞ্জ বিধানসভাতে বিজেপি হারল প্রায় ৫০ হাজার ভোটে। আগামী ২০২৬-এর বিধানসভা নির্বাচনে কি এই ফলাফলই থাকবে? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
অতএব ২০২৬-এ কাঁথির খোকাবাবুর মুখ্যমন্ত্রী হওয়া হল না। এবং ২০২৬-এ না হলে যে তারপরে আর কোনও সম্ভাবনা থেকে যাবে তাও নয়। কারণ তারপরের নির্বাচনগুলোতে বিজেপি আবার তাদের প্রাচীন ভোট শতাংশে ফিরে যাবে, ৮/৯/১০শতাংশ ভোট পেয়ে এক জাতীয় দল, যার এই বঙ্গে কোনও সম্ভাবনাই নেই। তাহলে কি বাম-কংগ্রেস দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসবে? হ্যাঁ, সেটা সম্ভব, যদি বাম-কংগ্রেস এক সঙ্গে থাকে। আমার কাছে যা খবর তাতে এই ২০২৬-এর নির্বাচনেই সম্ভবত বাম-কংগ্রেস জোট হবে না। দেখা যাক ভবিষ্যৎ আমাদের জন্য কী লুকিয়ে রেখেছে।