সবকিছুরই তো একটা সীমা থাকে, ভিতরে বাইরে, সব জায়গায় এক অসম্ভব বাঙালি বিদ্বেষ, অসম্ভব বাংলা বিদ্বেষ, এই বাংলার মানুষ কতদিন সহ্য করবে? আমার ভাষা নিয়ে ফাজলামি হচ্ছে, আমার সাহিত্য কবিতা নিয়ে ফাজলামি হচ্ছে, আমার খাবার নিয়ে নোংরামি হচ্ছে, এবং তা হচ্ছে এক নির্দিষ্ট সংস্কৃতিকে চাপিয়ে দেওয়ার জন্যই। তাদের এক নির্দিষ্ট পরিকল্পনা আছে, এক ঘৃণ্য রাজনীতি আছে যা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সর্বত্র। আগে যা কেবল হিন্দি ছবিতে দু’ চারটে ভাঁড়ামির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত, এখন তা সংগঠিত আক্রমণ হয়ে নেমে আসছে। বেশিদিন নয়, মাসপাঁচেক আগে এক উত্তর ভারতের বালখিল্য মহারাজের কাছে একজন প্রশ্ন করলেন, মাছ মাংস খাওয়া কি খারাপ? ধর্মে মানা আছে? মাথায় রাখবেন এসব জায়গাতে প্রশ্ন এবং সম্ভাব্য উত্তর সবটাই স্ক্রিপ্টেড, আগে থেকেই ঠিক করা থেকে। তো সেই অর্বাচীন মহারাজ বললেন মাছ মাংস তো রাক্ষসদের খাবার, মানুষ তা খাবে কেন? জয় হো, জয় হো ধ্বনি উঠল। সঙ্গে সঙ্গেই পরের প্রশ্ন, স্বামী বিবেকানন্দও নাকি মাছ মাংস খেতেন? মহারাজের উত্তর, ওনার জানা ছিল না, উনি পাপ করেছেন, পাপের ফলও পেয়েছেন, আমাদের ঋষি মুনিদের আয়ু ২০০-৩০০-৪০০ বছর উনি ৪০ বছরও বাঁচেননি। বঙ্গালি লোগ ওইসা হি হোতা হ্যায়। আবার জয় হো, জয় হো। সব্বাইকে কচ্ছপের আয়ু দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মহারাজ হাসলেন, তাঁর ভক্তরা জানল বিবেকানন্দ মাছ মাংস খেতেন তাই ৩৯ বছর বয়সে মারা গিয়েছিলেন। কেবল বলাই নয়, পেটানো হচ্ছে, বাংলা বললেই বাংলাদেশি বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এবং আমরা চুপ করে বসে আছি। সেটাই বিষয় আজকে, বাঙালি আর কতদিন চুপ করে সবকিছু সহ্য করবে?
কিছুদিন আগে মেট্রো রেলের স্টেশনে, এই কলকাতায়, এক অবাঙালি মেট্রো রেল কর্মচারী বললেন, অত বাঙালি বাঙালি করবেন না, বাংলাদেশ হয়ে যাবে। হাওড়ার রামেশ্বর হালদার নামে একজন বাঙালি প্যাসেঞ্জারের সঙ্গে তিনি হিন্দিতেই কথা বলছিলেন, এবং এই রামেশ্বরবাবু বলেন তিনি হিন্দি বোঝেন না, তখন জবাব এল অত বাংলা বাংলা করবেন না।
আরও পড়ুন: Aajke | কমরেড সেলিম আর বিজেপির গোপন দোস্তি এখন ওপেন
আচ্ছা এই কথাটা এই মানুষটি মহারাষ্ট্রে তামিলনাড়ুতে এমনকী বিহারেও বলতে পারতেন? সেইখানেই মার খেয়ে হাসপাতালে যেতে হত। কিন্তু এখানে? এসব অনায়াসে বলাই যায়। এর আগেও মেট্রোতে এক মহিলা যাত্রীকে হেনস্থা করা হয়েছিল, আর একজন যাত্রীকে বলা হয়েছিল, হিন্দিমে বাত করো। এই কলকাতাতেই অনলাইন পেমেন্ট অ্যাপে বাংলা অপশন চালু রাখার জন্য এক বাঙালি ছোট ব্যবসায়ীকে বেধড়ক মারধরের অভিযোগের কথা আমরা জানি। নোবেল লরিয়েট অমর্ত্য সেন বলেছিলেন, বিজেপি বাঙালিদের একটি সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখে এবং তাদের হিন্দি হিন্দু সংস্কৃতি বাঙালিদের উপরে চাপিয়ে দিতে চায়। এবার সেটাই আরও বড় করে উঠে আসছে। পহলগামের ঘটনার পরেই গুজরাতে অবৈধভাবে বসবাসকারী ১,০২৪ জন বাংলাদেশি নাগরিককে আটক করেছিল রাজ্য পুলিশ। তারপর তাদেরকে নিয়ে রাস্তায় হাঁটানো হয়েছে, তাঁরা তাঁদের বৈধ পরিচয়পত্র আনার কথা বলেছেন, আনতে দেওয়া হয়নি। তাঁদেরকে স্থানীয় সাংবাদিকদের ক্যামেরার সামনে বাংলাদেশি বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে, মাত্র জনা ১৫ মানুষের কাছে পরিচয়পত্র নেই, কিন্তু তারাও যে বাংলাদেশি তাও প্রমাণিত নয়। অথচ তাঁদের ঘিরে ধরে বিক্ষোভ হল, রাস্তায় হাঁটানো হল, রোদে বসিয়ে রাখা হল। ওড়িশায় বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের ‘মারধর’ করার অভিযোগ উঠেছে, একটা ভাইরাল ভিডিও ক্লিপে আমরা দেখেছি একজন সাইকেল ভ্যানে করে কিছু বিক্রি করতে এসেছেন, তিনি কার্ড না দেখাতে পারায় মারধর করা হচ্ছে এবং বাংলাদেশি সন্দেহে হেনস্থা করা হচ্ছে। পরে জানা গেল তিনি একজন এই বাংলা থেকে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিক। ত্রিপুরায় বিজেপি-নেতৃত্বাধীন সরকার ব্রু আদিবাসী শরণার্থীদের পুনর্বাসনের জন্য জমি দিল, কোত্থেকে এল সেই জমি? বাঙালি মানুষজন যাঁরা বছরের পর বছর সেই জমিতে বসবাস করছেন, সেই জমি কেড়ে নেওয়া হল। ৩০০০-এর বেশি বাঙালি তাদের জমি হারিয়েছে। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব তো বলেইছিলেন যে যারা হিন্দি বলে না তারা তাদের দেশকে ভালোবাসে না। খুব সোজা অর্থ যারা বাংলাতে কথা বলে তারা দেশপ্রেমী নন। হ্যাঁ এটাই চলছে দেশজুড়ে। এক প্রবল বাংলাদেশি বিরোধী প্রচারের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে বাংলা ভাষাকে, বাংলা বললেই তুমি বাংলাদেশি, অ্যারেস্ট করো, মারধর করো। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, কয়েক বছর ধরে দেশের বিভিন্ন অংশে এমনকী এই কলকাতায়, এই রাজ্যেও বাঙালি মানূষের উপরে আক্রমণ নেমে আসছে, তার ভাষাকে আক্রমণ করা হচ্ছে, তার খাদ্যাভ্যাসকে আক্রমণ করা হচ্ছে, বাংলা বললেই ধরে নেওয়া হচ্ছে সে বাংলাদেশি। এবং বিজেপি শাসিত রাজ্যে এটা এখন প্রায় নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিজেপির এই চূড়ান্ত বাংলা, বাঙালি বিরোধী মনোভাব কি মোদি জমানাতেই বেশি আশকারা পাচ্ছে? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
এই বাংলায় এক মূর্খ সাংবাদিক নজরুলের কবিতা নিয়ে ব্যঙ্গ করে, কেবল করে না, তার সমর্থনে কথা বলার লোকজনও পেয়ে যায়। এই বাংলায় বসে কাজি নজরুল ইসলামকে অপমান করার মতো ক্ষমতা কোথা থেকে পায় কেউ? আসলে আরএসএস-বিজেপির ছত্রছায়ায় এক হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্থানের গ্র্যান্ড প্ল্যানের অংশ হল অন্য সমস্ত রিজিওনাল আঞ্চলিক ভাষাগুলোকে শেষ করে এক হিন্দি হিন্দু সাম্রাজ্য তুলে ধরা। তাদের প্রতিদিনের প্রার্থনাতেই আছে সেই হিন্দুভূমির কথা, সেই তারাই সাহস জোগাচ্ছে। আমরা কি চুপ করে বসে দেখব?