মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হাততালি দিলেন আর দিঘাতে মন্দির হয়ে গেল তেমন তো নয়, সেই ২০১৯ থেকে এর পরিকল্পনা চলছিল। সে সময়ে সেই পরিকল্পনায় শামিল ছিলেন আজকে বিরোধী দলনেতা, ছিলেন সাংসদ শিশির অধিকারী। জগন্নাথ মন্দির তো এক ছোটখাটো ব্যাপার নয়, সেই পরিকল্পনার বাজেট বরাদ্দ এসব নিয়ে বিস্তর মাথা ঘামানোর ফলশ্রুতি দিঘার এই জগন্নাথ মন্দির। হ্যাঁ, নিশ্চিতভাবেই এই মন্দির দিঘার পর্যটনকে বাড়াবে, পশ্চিমবঙ্গের পর্যটনে নতুন পালক। এসব নিয়ে আলোচনা আগেও হয়েছে, সব্বাই তা জানতেন। অবশ্যই একটা বিরোধিতা তো ছিলই, সরকারের খরচে কি হিন্দু মন্দির বানানো আইনত সিদ্ধ? তো টেকনিক্যালি সেই কারণেই এক জগন্নাথ কালচারাল সেন্টারের আড়াল রেখেই কাজটা করা হয়েছে। তবুও এ নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়, বহু চর্চিত আলোচিত প্রশ্ন আর তার বিভিন্ন উত্তর। কিন্তু মজার কথা হল না বিজেপি, না সিপিএম সেই আলোচনাতে নামল, তাদের আলোচনা শেষমেশ এসে দাঁড়িয়েছে এই মন্দির কি হিন্দুদের তুষ্ট করার জন্য হল? এই মন্দির কি সত্যিই জগন্নাথ মন্দির? এই মন্দিরকে কি জগন্নাথ ধাম বলা যায়? এবং সেই প্রশ্নগুলো উসকে দিয়েছে ওড়িশা সরকার। যেন এই সবে তাঁরা জানলেন রাতারাতি এক জগন্নাথ মন্দির হল আর তার উদ্বোধন হয়ে গেল। ওড়িশার মন্ত্রী হরিচন্দ্রন পুরীর জগন্নাথ মন্দির প্রশাসনকে যে চিঠি দিয়েছেন, তাতে স্পষ্টভাবেই পুরীর মন্দির প্রশাসনকে বলা হয়েছে ‘অভ্যন্তরীণ তদন্ত’ করতে। পুরীর মন্দিরের সঙ্গে যুক্ত কারা দিঘায় এই মন্দির প্রতিষ্ঠা, মূর্তি তৈরি এবং তাতে প্রাণপ্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িত, তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে মন্ত্রীর চিঠিতে। ওড়িশা থেকে দিঘায় বা পশ্চিমবঙ্গে কেউ তদন্ত করতে আসছেন না। বাংলার বিজেপি সূত্রের দাবি, পুরীর মন্দিরে জগন্নাথের নবকলেবরের উদ্বৃত্ত কাঠ এনে যে দিঘার বিগ্রহ তৈরি হয়েছে, তা রাজেশ দয়িতাপতি নিজেই বলেছেন। তাই ওই বিষয় নিয়ে তদন্তের আর কোনও প্রয়োজন নেই। ওই দয়িতাপতি-সহ পুরীর মন্দিরের আর কারা এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, সেটাই তদন্ত করে দেখবে মন্দির প্রশাসন। যাঁরা জড়িত, তাঁদের উপযুক্ত শাস্তিও হবে বলে ওড়িশা সরকার সূত্রের খবর। সেটাই বিষয় আজকে, আর কতভাবে আটকাবেন মমতাকে?
গত কমসম করেও চার বছর ধরে রাজ্য রাজনীতির কে জানতেন না যে দিঘাতে জগন্নাথ মন্দির তৈরি হবে? প্রত্যেকে জানতেন। আচ্ছা এই তিন বছরে এঁদের কাউকে কোনও প্রশ্ন করতে দেখেছেন? ২০২৪-এর আগে, বহু আগে পুরীর ওই রাজেশ দয়িতাপতি ইত্যাদিরা এই মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপনের জন্য এসেছেন, তা বড় করে খবর হয়েছে, এমনকী ওই মন্দির যে পুরীর মন্দিরের অনুকরণেও তৈরি হচ্ছিল তাও সব্বার জানাই ছিল। ওড়িশার সরকার তখন কিছু বলেছে? নবীন পট্টনায়ক বা বিজেডি দলের কোনও নেতা?
আরও পড়ুন: Aajke | রাজ্যপাল, রামছাগল, বাংলায় রাষ্ট্রপতি শাসন
অমন যে অমন শুভেন্দু অধিকারী, দিলু ঘোষ, তাঁরা জানতেন না? কিছু বলেছিলেন? মহম্মদ সেলিম জানতেন না যে মন্দির তৈরি হচ্ছে সরকারের টাকায়, কিছু বলেছিলেন? না একটা কথাও বলেননি। কিন্তু এক চমকে দেওয়ার মতো উদ্বোধনের পরে এই সব্বার মনে হয়েছে এই রে, এই জগন্নাথ মন্দির তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সামনের নির্বাচনে বিরাট মাইলেজ দেবে। অমনি সব্বাই মাঠে। সবচেয়ে বড় নোংরামিটা শুরু হয়েছে ওড়িশা থেকে, অবশ্যই এ রাজ্যের বিজেপি নেতাদের ইন্ধন ছিল, তা না হলে এতদিন যে সরকার, যে পুরীর মন্দিরের পাণ্ডারা একটা কথাও বলেননি, তাঁরা হঠাৎ হই হই করে মাঠে নেমে পড়লেন কেন? প্রথম প্রশ্ন কেন অনুকরণ হবে? কেন এই প্রশ্ন? এই মূর্খদের জন্য জানাই দিল্লি, হায়দরাবাদ, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, আহমেদাবাদ, রায়গড়া, গুন্টুর রাঁচিতে ওই জগন্নাথ মন্দিরের নকশা থেকে অনুপ্রাণিত জগন্নাথদেবের মন্দির তৈরি হয়েছে, এমনকী ওড়িশাতেই কোরাপুটে ওই রকম এক জগন্নাথের মন্দির আছে। দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দিরের অনুকরণে হংসেশ্বরী মন্দির শুধু নয় হায়দরাবাদে শামশাবাদে বড় মন্দির আছে। তাছাড়া দ্রাবিড় শৈলীর সব মন্দিরই তো প্রায় একইরকম। বিজেপি আসলে বিরোধিতার ইস্যু পাচ্ছে না তাই কেন পুরীর মন্দিরের অনুকরণে মন্দির তৈরি হবে এই বিতর্ক তুলে বিরোধী রাজনৈতিক পরিসরে জায়গা পেতে চাইছে। তারপরে বিতর্ক কী নিয়ে? কেন জগন্নাথ ধাম বলা হবে? চলে যান রামকৃষ্ণ মিশন পুরুলিয়াতে, ছাত্রদের প্রতিটা হস্টেলের নাম ধাম, কোনটা শিবানন্দ ধাম, কোনটা সারদানন্দ ধাম, কোনটা অভেদানন্দধাম। ধাম মানে একসঙ্গে থাকার জায়গা। জগন্নাথদেবের সঙ্গে সেই শব্দটা আরও জুড়ে আছে কারণ এই মন্দিরে জগন্নাথ, সুভদ্রা আর বলভদ্রের মূর্তি একসঙ্গে থাকে। এক্কেবারে আনপড়ের মতো যুক্তি দিয়ে কি রাজনীতি করা যায়? এবারে আসুন দারুব্রহ্মের ব্যাপারে, যে কাঠে পোকাও বাসা বাঁধে না, তাই দারুব্রহ্ম। ওসব নিমকাঠ ভেসে আসা ইত্যাদি মিথ, গল্প। আসল কথা হল নিমকাঠ দিয়ে সেই মূর্তি তৈরি হয়, এখানেও হয়েছে, যে কাঠটি আনুষ্ঠানিকভাবে হাতে তুলে দেওয়া হয়, সেটি অনুষ্ঠানের অঙ্গ, তা দিয়ে মূর্তি তৈরি সম্ভব নয়। বাকি বিতর্কের জবাব কলকাতা পুলিশ দিয়ে দিয়েছে, আমার কিছু বলার নেই। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, এক জগন্নাথদেব মূর্তি নিয়ে নাস্তিকদের প্রশ্ন থাকতেই পারে, কিন্তু ভগবানে বিশ্বাসী বলে পরিচিত কিছু মানুষ দিঘার জগন্নাথ মন্দির নিয়ে যে বিতর্ক তুলছেন, তা কি এক্কেবারেই রাজনীতি? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
যাঁরা চিরটাকাল মন্দির-মসজিদ, মন্দির-মসজিদ করে বেড়ান, তাঁরা হঠাৎ কেবল মন্দিরের উদ্বোধনে বেশ প্যাঁচে পড়েছেন বুঝতেই পারা যাচ্ছে। সেই ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দের মতো বঙ্গ বিজেপি এখন ধাম নিয়ে, ওড়িশার আইনমন্ত্রী পৃথ্বীরাজ হরিচন্দন রীতিমতো হুমকি দিয়েছেন দিঘা মন্দিরের নাম জগন্নাথ ধাম রাখা যাবে না। ভালোই হল, এক বিজেপি নেতার হুমকি এই বাংলার মানুষকে কারা মানতে বাধ্য করে, কারা তার বিরুদ্ধে লড়ে যায়, সেটাই মানুষ দেখুক। বঙ্গ বিজেপি বুঝতেই পারছে না যে এই বিতর্ক শেষমেশ বাঙালি–ওড়িয়া নয়, বিজেপি-তৃণমূল হয়ে উঠবে, বাঙালিরা সমর্থন করবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে।