তখন এত টিভি চ্যানেল ছিল না, খবরের কাগজ তো ছিল কিন্তু কুণাল ঘোষ ইত্যাদি হাতে গোনা কয়েকজনকে বাদ দিলে তেমন কমিটেড সাংবাদিকও ছিল না তৃণমূলের বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। কিন্তু যেদিন লালু আলমের লাঠির ঘায়ে মাথা ফাটল, তারপরের দিন রক্ত ঝরছে মমতার মাথা থেকে, এমন ছবিও ছিল, ব্যানার হেডলাইনও ছিল প্রত্যেক খবরের কাগজে। বা ধরুন ২১ জুলাই, আকাশ থেকে তো গুলিবিদ্ধ লাশেরা ছিটকে এসে মেয়ো রোড বা ধর্মতলায় পড়েনি, গুলি চলেছিল, লাশ পড়েছিল। বা ধরুন নন্দীগ্রাম, বডি কাউন্ট নিয়ে বিতর্ক বা অন্য মতামত থাকতেই পারে, গুলি তো চলেছিল, লাশ তো পড়েছিল। আর সেসব ক্ষেত্রে আন্দোলন মানুষের মধ্যে প্রভাব ফেলে বইকী। আমরা ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের কথা বললেই কেন শহীদদের কথা বলি, কেন লালা লাজপত রায়ের লাঠির ঘায়ে সেই রক্তাক্ত চেহারার কথা বলি, জালিয়ানওয়ালাবাগের সেই বডি কাউন্ট নিয়ে নানান জনের নানান মত তো আছে কিন্তু সে সংখ্যা বাড়া বা কমার ফলে কি মাইকেল ফ্রান্সিস ও ডায়ার বা জেনারেল এডোয়ার্ড হ্যারি ও ডায়ারের চেহারাতে নৃশংসতা কিছু কমে বা বাড়ে? কিন্তু আজ এই সর্বগ্রাসী ক্যামেরার সামনে আপনি আপনারই মহিলা সহকর্মীর হ্যাঁচকা টানে ধড়াম করে পড়ে গেলেন আর তারপরে সেটাকে মমতার পুলিশের অত্যাচার বলে চালানোর চেষ্টা করলে তো বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে কথা উঠবেই, তাই না সুকান্তবাবু? আপনারা বরং দেখে নিন সুকান্তবাবুর আন্দোলন এবং ধড়াম করে পড়ে যাওয়ার সেই ছবি। আজ সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, সুকান্তবাবু কীভাবে পড়ে গেলেন? তাঁকে কে ধাক্কা দিল?
আমরা ছবিতে পরিষ্কার দেখলাম সুকান্তবাবুকে ঘিরে রয়েছে তাঁর দেহরক্ষীরা, এরা সেন্ট্রাল ফোর্সের কমান্ডো। আমরা দেখলাম তাঁদের একজনকে ধাক্কা মেরে নীচে নামিয়ে দিলেন সুকান্তবাবুর দলের এক নেত্রী, যিনি নিজেও গাড়ির উপরেই ছিলেন। এবার তিনি অন্যজনকে ধাক্কা দিয়ে নীচে নামানোর চেষ্টা করলেন, সেই দেহরক্ষী সুকান্তবাবুকে ধরেই টাল সামলাতে না পেরে নীচে পড়লেন এবং সেই হ্যাঁচকা টানেই সুকান্তবাবু পপাত চ, মমার চ। তখন সেই গাড়ির চারপাশে বিজেপির কর্মী সমর্থকেরা জড়ো ছিলেন।
আরও পড়ুন: Aajke | সন্দেশখালি কি নন্দীগ্রাম হয়ে উঠছে?
এবার সন্ধে থেকে ভিকটিম কার্ড খেলা শুরু হল। এটা ২০২৪, সাধারণ মানুষই ক্যামেরা এড়িয়ে কিছু করে উঠতে পারছেন না, সুকান্তবাবু তো বিজেপির বড় নেতা সাংসদ। এই একই ছবি আমরা দেখেছিলাম শুভেন্দু অধিকারীর, তিনি ক্রোধে অগ্নিবর্ণ, সুচিত্রা সেনের মতো চিৎকার করে চলেছেন ডোন্ট টাচ মি, ডোন্ট টাচ মি। যাঁকে বলছেন তিনি এক মধ্যবয়সের মহিলা, প্রাণপণে কিছু বলার চেষ্টা করছেন। সম্ভবত বলতে চাইছেন, আমরা তো আপনাকেই ঘিরে, আপনার সুরক্ষা বলয় তৈরি করেছি। কিন্তু কে কার কথা শোনে? কাঁথির খোকাবাবু তখন একই মোডে চিল চিৎকার করে চলেছেন, ডোন্ট টাচ মি। আচ্ছা মানুষ বিশ্বাস করবে যে শ’ খানেক ক্যামেরার সামনে এক মহিলা তাঁর কাছে হাজির হয়ে হঠাৎ তাঁর শ্লীলতাহানির কথা বলতে শুরু করবেন? তাহলে শুভেন্দু অধিকারী অমনটা করলেন কেন? গভীর মনস্তত্বের বিষয়, অনেক সময়ে আগের মানে পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ শিক্ষা নেয়, সেরকম ভাবেই ডিফেন্সিভ হয়ে ওঠে। ধরুন আপনার পাড়ার কোনও এক কুকুরকে আ তু তু বলে বিস্কুট খাওয়াতে গিয়েছিলেন, সে খ্যাঁক করে কামড়ে দিয়েছিল। সেই থেকে কুকুর দেখলেই আপনার অ্যা তু তু বলার ইচ্ছে আর হয় না বদলে আপনি সতর্ক হন। এটাও হতে পারে। সম্ভাবনা কি একটা? সে যাই হোক আমরা মোদ্দা বিষয়ে ফিরি, মমতা যা করতে পারেন তা নিয়ে আলোচনা করাই যায়, কিন্তু সেটা করা অসম্ভব। ধরুন কী ঘটেছে তার মধ্যে না গিয়েও বলতে পারি সন্দেশখালির মতো কোনও ঘটনা বাম আমলে সামনে এলে রাজ্য স্তব্ধ হয়ে যেত, মমতা সাতসকালে পৌঁছে যেতেন ওই সন্দেশখালিতে। সেসব ভেবেই উঠতে পারবেন না আজকের বিরোধীরা। কাজেই আন্দোলন করুন কিন্তু নকল করে নয় একটু বিশ্বাসযোগ্যতা আনুন কাজ কারবারে, আর মাথায় রাখুন আপনার চারপাশে রয়েছে অজস্র ক্যামেরা, নৌটঙ্কি করলেই ধরা পড়ে যাবেন। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এই সন্দেশখালির মতো ঘটনা বাম আমলে ঘটলে রাজ্য থেমে যেত, ট্রেন বাস বন্ধ হত, মমতা এবং তাঁর দল থাকতেন রাস্তায়। কিন্তু অন্তত খবরে, মিডিয়াতে সেরকম ঘটনার কথা বলা হলেও বিরোধীরা সেরকম দাগ কাটার মতো কিছু করতে তো পারছেনই না উল্টে বাজে নাটক করছেন। এটা কেন?
যে বামেরা একসময় টানা ৩৪ বছর ধরে সরকার চালিয়েছেন, প্রতিটা নির্বাচনে জিতেছেন, ক্ষমতা প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠেছে। সেই বামেরাই তাঁদের ভিত্তিভূমি, গরিবগুর্বো মানুষ, সংখ্যালঘু মানুষজনের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছিলেন বলেই তৃণমূল ক্ষমতায় এসেছিল, সঙ্গে ছিল সেই সময়ে ওই প্রবল ক্ষমতার বিরুদ্ধে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আন্দোলনের বিশ্বাসযোগ্যতা। সেই বিশ্বাসযোগ্যতা না থাকলে কেবল নাটকবাজি করে তৃণমূলকে ক্ষমতা থেকে সরানো যাবে না।