নিজেপির এই দেশে বেড়ে ওঠার এক ঐতিহাসিক ভিত্তি তো আছেই। সেই কবেই তারা নিজেদের কংগ্রেসের বিপরীতে, নিজেদেরকে উদার, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষতার বিপরীতে দাঁড় করিয়েছে। কাজেই কংগ্রেসের সামান্যতম ভুলেরও সুযোগ নিয়েছে তারা। উদার, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির সামান্যতম বিভেদ বা বিভাজনের সুযোগ তারা নিয়েছে, আর হাতেনাতেই ফলও ফলেছে। কংগ্রেস যদি না শাহ বানো মামলা নিয়ে মুসলমান তুষ্টিকরণের পথ নিত, বা বাবরি মসজিদের তালা খুলে পাল্টা হিন্দু তুষ্টিকরণের পথ নিত, তাহলে কি বিজেপির এই বাড়বাড়ন্ত হত? হত না। আবার সময়ে সময়ে বামেদের বিরাট বিরাট ভুল তাদেরকে জনবিচ্ছিন্ন করেছে, বিজেপিকেও বাড়তে সুবিধে করে দিয়েছে। একবার নয় ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে বামেদের এই লাগাতার ভুলের কথা সব্বাই জানেন। কিন্তু এখন সেই বামেদের মধ্যে এক বড় অংশের প্রতিনিধি সিপিএমের ভুল দেখে মনে হয়, কেবল ভুল নয়, সম্ভবত তাদের সঙ্গে বিজেপির এক অলিখিত চুক্তিই আছে। ঠিক এই মুহূর্তে সারা দেশে যেখানে কেবল বাম ঐক্য নয়, জরুরি হল সমস্ত গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, বিজেপি বিরোধী শক্তির ঐক্য, সেখানে সিপিএমের মাথায় সাধারণভাবে বাম ঐক্যের প্রয়োজনীয়তাও ঢুকছে না। বিজেপি তো বাড়ছেই, তাদের ঘোষিত নীতি নিয়েই কলেবরে এবং প্রভাবে বাড়ছে, সেখানে সিপিএমের কমরেড সেলিমদের অবিমৃষ্যকারিতা তাঁদের একস্ট্রা অক্সিজেন জোগাচ্ছে। একদা বাম দুর্গে এবিভিপি সেই মধ্য নব্বই থেকেই তাদের জায়গা করার চেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছে, কখনও খানিক এগিয়েছে, খানিক পিছিয়েছে। আজ তাদের পাশে রাষ্ট্রক্ষমতা, তাদের হাতে পুলিশ প্রশাসন, আজ দরকার আরও বড় ঐক্যের, সেই সময়ে প্রায় চক্রান্ত করেই বাম ঐক্য ভেঙে সহ সম্পাদকের আসনটা দিয়ে দেওয়া হল বিজেপিকে। হ্যাঁ বিজেপির ছাত্র সংগঠন এবিভিপির বৈভব মিনা এই আসনে এআইএসএ–ডিএসএফ জোটকে ৮৫ ভোটে হারিয়ে জিতলেন, যেখানে এসএফআই, এআইএসএফ জোট তিন নম্বরে থেকে ১২৫৬ ভোট পেয়েছে। আবার সাধারণ সম্পাদক পদে এআইএসএফ–ডিএসএফ জোটের প্রার্থী মাত্র ১১৪ ভোটে জিতেছেন, যেখানে তিন নম্বরে এসএফআই–এআইএসএ জোটের ভোট ছিল হাজার খানেকের বেশি। সহসভাপতি পদে জয় এসেছে মাত্র ৩৪ ভোটে, সেখানেও তিন নম্বরে এই আগমার্কা বামপন্থীদের ভোট ছিল হাজার খানেকের মতো। তার মানে আজ সকালে উঠে আমাদের অনেকেই অবাক হয়ে শুনতে পেতেন যে জেএনইউতে বিজেপির ছাত্র সংগঠন সাধারণ সম্পাদক সহ তিনটে আসনেই জিতে গেছে। এবং যাঁরা জানেন, খবর রাখেন তাঁরা প্রত্যেকেই সিপিএমের এই নির্লজ্জ বোঝাপড়া দেখে হতবাক। সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, কমরেড সেলিম আর বিজেপির গোপন দোস্তি এখন ওপেন।
সেই কবে থেকেই জেএনইউতে বামপন্থীদের বিরাট শক্তি, প্রায় এক দুর্গের মতো তারা ধরে রেখেছে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে। কিন্তু সেই মধ্য নব্বই থেকে সারা দেশে আরএসএস-বিজেপির উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে জেএনইউতেও তাদের শক্তি বাড়তে থাকে, ২০০০ সালে বিদ্যার্থী পরিষদ প্রথমবার চারটে মূল পদের মধ্যে সভাপতির পদ জিতে নেয়, মাত্র এক ভোটে, সেবারে এসএফআই-এর মধ্যে ফাটল ছিল, তাদের আগেরবারের সভাপতি নাসির হুসেনকে তারা আবার মনোনয়ন দেননি, তিনি বিরুদ্ধে প্রচার করেছিলেন, সেই নাসির হুসেন আবার এখন কংগ্রেসের বড় নেতা।
আরও পড়ুন: Aajke | স্যালুট ঝন্টু আলি শেখ, স্যালুট সইদ আদিল হুসেন শাহ
আবার সেই বছরে এআইএসএ, সিপিআইএমএল লিবারেশনের ছাত্র সংগঠনও আলাদা লড়েছিল। এরপর আবার ২০১৫তে যেবারে কানহাইয়া কুমার সভাপতি হন, সেবারেও সহ সম্পাদকের পদ পেয়েছিল এবিভিপি, সেবারেও নকশালপন্থীদের সংগঠন আলাদা লড়েছিল। ২০১৬ থেকে মূলত কানাহাইয়া কুমারের চেষ্টায় বাকি সমস্ত বাম ছাত্র সংগঠনগুলোকে নিয়ে বাম ঐক্য গড়ে ওঠে। তারপর থেকে এমনকী গতবছরেও এই বাম জোট সবকটা আসনে জিতেছে। এবারে প্রায় একতরফাভাবেই মূলত সিপিএমের নেতা ছাত্র সংগঠন ওই বাম ঐক্য ভেঙে তাঁদের জোট নিয়েই লড়তে নামেন, সবকটা আসনে হেরেছেন, কিন্তু জিতিয়ে দিয়েছেন বিজেপিকে, অন্তত একটা আসনে। জানা যাচ্ছে ৪২টা কাউন্সিলর আসনের ২৩টা নাকি এবিভিপি জিতেছে। অদ্ভুত ব্যাপার হল সায়েন্স আর ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রায় সবটাই ঝেঁটিয়ে জিতেছে এবিভিপি, আর বাম জোট থাকলে একটা আসনেও এবিভিপি জিতত না। আসলে আমাদের কমরেড সেলিম যখন তৃণমূলকে নিয়ে ওই বিজেমূল তত্ত্বটাকে হাজির করেন, তখন ভুলেই যান যে ওনাদের দুর্গ কেরালাতে বিজেপির ভোট ওনাদের সময়েই বেড়েছে ১০ শতাংশের বেশি, ওনাদের ত্রিপুরা গেছে বিজেপির হাতে, ওনাদের কেরালাতে সবথেকে বেশি আরএসএস-এর বৃদ্ধি, ওনাদের ভোটেই পুষ্ট বাংলার বিজেপি। আজ আবার সেই গোপন বোঝাপড়ার চেহারাটা বের হয়ে এল। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম যে সিপিএম নেতৃত্বের সরাসরি অপদার্থতার জন্যই জেএনইউতে এবিভিপি পেয়ে গেল সহ সম্পাদকের পোস্ট আর ৪২টার মধ্যে ২৩টা কাউন্সিলর আসন। আপনাদের কি মনে হয় এটা এক ধরনের অপদার্থ বোধ নাকি বিজেপির সঙ্গে এক গোপন বোঝাপড়া? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
আমরা জানি নীলোৎপল বসুর মতো লোকজনদের সঙ্গে আলোচনায় বসা হয়েছিল, আমরা জানি যে বাম ঐক্য শেষমেশ না ভাঙার জন্য বহু আবেদন করা হয়েছিল সিপিএম শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে। তারপরেও কেবল মাত্র বাম ঐক্য না হওয়ার ফলেই বিজেপি ছাত্র সংগঠনের এই বাড়বাড়ন্ত আমরা দেখলাম। কমরেড মহম্মদ সেলিম মাঝেমধ্যেই প্রশ্ন করেন, বক্তৃতায় বলেন, এই রাজ্যে বিজেপির বৃদ্ধির পিছনে আছে তৃণমূল আর বিজেপির এক গোপন বোঝাপড়া। তো আমরা এই ফলাফলের পরে ওই সূত্র ধরেই কি বলতে পারি যে জেএনইউতে বিজেপির এই বৃদ্ধির কারণ হল এসএফআই আর এবিভিপির এক গোপন বোঝাপড়া?