সবাই আগ্রহ নিয়ে বসেছিলেন বৃহস্পতিবারে, ২৬ হাজার চাকরি, যোগ্য শিক্ষকদের চাকরি যেন না যায়, স্কুলের পঠনপাঠন বন্ধ হয়ে যাবে, সুপ্রিম কোর্ট কোন রায় দেয় তার জন্য আগ্রহ নিয়ে বসেছিলেন বহু মানুষ। শুধু কি আগ্রহ? অনেকে মানত করেছিলেন, চাকরিটা থাকলে সত্যনারায়ণের সিন্নি দেবেন, অনেকে দরগায় মানত করেছিলেন, স্বাভাবিক কারণেই রাজ্যের প্রশাসন উৎকণ্ঠা নিয়েই বসেছিলেন। আমার ধারণা, মানে আমি তো জ্যোতিষী বা ভগবান নই, কাজেই এক্কেবারে সঠিক কীভাবে বলব বলুন, আমার ধারণা, আরও অন্তত দু’জন বিরাট উৎকণ্ঠা নিয়েই বসেছিলেন, তাঁরা সমানে ভাবছিলেন রায় শিক্ষকদের পক্ষে যাবে না তো? শিক্ষকদের আবার স্কুলে যেতে বলবে না তো? কারণ এই দু’জন চাকরি খাওয়ার কথা বেশ কয়েকবার বলেছেন। দু’জনের একজন হলেন আমাদের বিচারক থেকে বিজেপি বনে যাওয়া গাঙ্গুলি সাহেব, এই সেদিনেই বলেছেন, ওদের চাকরি খেয়েছি, এবারে এদের চাকরিও থাকবে না। অন্যজনের কথা তো সবাই জানেন, মাত্র এই সেদিন তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, “আদালত গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়া খারিজ করে প্রত্যেককে অবিলম্বে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন। সঙ্গে বিকল্প পথ হিসাবে ওই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী প্রত্যেককে ফের পরীক্ষায় বসার সুযোগ দিতে বলেছে সুপ্রিম কোর্ট। রাজ্য সরকার যদি আদালতের সেই নির্দেশ না মেনে ঘুরপথে চাকরিচ্যুতদের কাজ চালিয়ে দেওয়ার সুযোগ দেয় তাহলে তা আদালত অবমাননা করা হবে। আমি মুখ্যমন্ত্রীসহ প্রত্যেকের বক্তব্য খতিয়ে দেখব। তার পর সুপ্রিম কোর্টে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক আদালত অবমাননার অভিযোগ দায়ের করব।” মানে ঘুরপথে যদি চাকরি পেয়ে যায়, তাহলে সেই চাকরি কেড়ে নেওয়ার জন্য মামলা করবেন আমাদের উকিল বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য। সেটাই বিষয় আজকে, মাননীয় বিকাশবাবু, মামলা করুন, চাকরি আটকান।
হ্যাঁ, দুর্নীতি হয়েছে, তার জন্যই পার্থ চ্যাটার্জি জেলে আছেন, দুর্নীতি হয়েছে তার তদন্তও চলছে। শামলা পরা উকিলেরা সেই অভিযুক্তদের পক্ষেও আছে, বিপক্ষেও আছে। কেন? কারণ আইন বলে, অভিযুক্তের কথা শুনতে হবে। আইন বলে সময় লাগুক, অপরাধের প্রতিটি প্রমাণ খুঁটিয়ে দেখেই শাস্তি দেওয়া হবে। আইনই বলে একশো জন দোষী ছাড়া পেয়ে যাক, কিন্তু একজনও নির্দোষ যেন শাস্তি না পায়। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আইনের এই সহজ পাঠ ভুলে মেরেছেন বিকাশবাবু। মনে করিয়ে দিই, ২০১৪তে ত্রিপুরায় বাম শাসনে চাকরি গিয়েছিল ১০ হাজার ছাত্রের, সেখানেও অভিযোগ ছিল দুর্নীতির, শিক্ষকদের আন্দোলনে বেধড়ক লাঠি চালানো হয়েছিল। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন আমার সরকারের অক্ষমতায় চাকরি গেছে, আমরা ওই শিক্ষকদের পাশে দাঁড়াব? মুখোমুখি ডেকে কথা বলার সাহস দেখিয়েছিলেন? দেখাননি। আজ এখানে মুখ্যমন্ত্রী বলছেন তোমরা ভয় পেও না, আমরা কিছু একটা করব। কিছু একটা মানে কী? সম্ভবত মুখ্যমন্ত্রী নিজেও জানেন না, কিন্তু ওই মুহূর্তে ওই ভেঙে পড়া মানুষগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে তিনি এই কথাগুলো বললেন।
আরও পড়ুন: Aajke | রেখেছ ‘বিজেপি’ করে মাগো, বাঙালি করোনি
শোনার পরেই আমাদের মার্কসিস্ট উকিলবাবু বলছেন, অন্য উপায়ে চাকরি দিলেই মামলা করব! এতটা অসংবেদনশীল? আইনি যুক্তি দিচ্ছেন? এই আপনিই, হ্যাঁ আপনিই বলেছিলেন সিঙ্গুরের জমি কোনওভাবেই ফেরত দেওয়া যায় না, আদালতের রায়েই তা আবার রাজ্য সরকারের কাছেই এসেছে। এবারেও হবে, হবে কারণ মুখ্যমন্ত্রী আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছেন, শিক্ষকদের একটা বড় অংশ সেটা জানেন, বোঝেন। আপনি তখনও আবার মামলা করে চাকরি খাওয়ার চেষ্টা করবেন, আর মিলে সুর মেরা তুমহারা, হামারা, আপনার সঙ্গে সুর বারবার মিলে যাবে বিচারপতি গাঙ্গুলির। হোক না তিনি বিজেপি আর আপনি বাম, আদতে আপনাদের দুজনের আসল শত্রু তো ওই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সেটা আমরা জানি। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, অভিজিৎগাঙ্গুলি, প্রাক্তন বিচারক, এখন বিজেপি সাংসদ, প্রকাশ্যেই শিক্ষকদের চাকরি খাওয়ার কথা বলছেন, বিকাশ ভট্টাচার্য সিপিএম সাংসদ জানিয়ে দিয়েছেন ঘুরপথেও যদি শিক্ষকদের চাকরি দেওয়া হয় তাহলে তিনি মামলা করবেন। এই কথাগুলো কি তাঁরা তাঁদের মমতা-বিরোধী রাজনীতি করার জন্যই বলছেন? নাকি এর পিছনে যথেষ্ট যুক্তি আছে? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
আচ্ছা মেনে নিলাম তৃণমূল চোর। তৃণমূল অপদার্থ। গত চোদ্দ বছরে শিক্ষা ব্যবস্থার সাড়ে সর্বনাশ করে ছেড়েছে, চাকরির পরীক্ষাগুলোতে ব্যাপক দুর্নীতি, সমাজজীবনে সর্বত্র দুর্নীতি, যার ফলে আরজি করের মতো ঘটনা ঘটেছে। লাগাতার অপশাসন প্রত্যক্ষ করেছে রাজ্যবাসী। তা সত্ত্বেও তারা ভোট পাচ্ছে কেন? বামপন্থীরা পাচ্ছে না কেন? কোনও আত্মসমীক্ষা আছে? কোনও রিভিউ? বামপন্থীদের মধ্যে সিপিএম বড় পার্টি। এবারে রাজ্য সম্মেলনে তাদের নেতারা কী বলছেন এ বিষয়ে? নির্বাচিত অংশ প্রকাশিত হবে কি? মানুষ বিপদে পড়ে কেন? কারণ, বুর্জোয়া শ্রেণির অন্তহীন লোভ, দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলির জনবিরোধী রাজনীতি আর সরকারের বিভিন্ন স্তরের দুর্নীতির জন্যে। শুনেছি মানুষ বিপদে পড়লে কমিউনিস্টদের প্রথম কর্তব্য হল বিপদগ্রস্ত মানুষের হাত ধরে তাকে টেনে একটা আপাত স্বস্তির জায়গায় আনার চেষ্টা করা, আপাত হলেও বিপদ থেকে বাঁচানো। এরকমটা বাবা-কাকাদের কাছ থেকে শুনেছি। তারপর তার সঙ্গেই স্থায়ী সমাধানের জন্য লড়াই নিয়ে কথা বলা। দীর্ঘমেয়াদি সংগ্রামের দিকে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা। কিন্তু মানুষের দুঃখে যার চোখ ভেজে না, হৃদয় দুমড়ে যায় না, সে কমিউনিস্ট নয়। মানুষের বিপদকে যে নিজের রাজনৈতিক স্বার্থের হাতিয়ার ভাবে সে কমিউনিস্ট নয়। জনগণের স্বার্থই পার্টির স্বার্থ। আজকের তথাকথিত কমিউনিস্ট কর্মীরা পুরনো কমিউনিস্টদের জীবন ও কাজগুলো দেখে শিখতে পারেন। ও বিকাশবাবু শুনতে পেলেন? অভিজিৎবাবু নিজের বসন ছেড়ে আসল রূপেই মাঠে আছেন, আপনি যখন নিজেকে কমিউনিস্ট বলেন তখন অনেকে হাসে, আমার বমি পায়।