সিনিয়র সাংবাদিকদের মুখে শুনেছি প্রতিদিন নিয়ম করে তপন শিকদার যেতেন মূরলি ধর লেনে, আর তখন জনসঙঘের প্রতীক প্রদীপ, সেটা আক্ষরিক অর্থেই জ্বেলে বসে থাকতেন। দু’চারজন কর্মী কখনও সখনও সাংবাদিকদের সঙ্গে গল্পগুজব করতেন, রাতে তিনিই শেষ মানুষ যিনি ঐ বাড়ি থেকে বের হতেন। ঐ সিনিয়র সাংবাদিকরাই বলতেন সেন্ট্রাল এভিনিউয়ের উপরে বিষ্ণুকান্ত শাস্ত্রী, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দি বিভাগের অধ্যাপক, তাঁর এক অত্যন্ত সরল জীবন যাপনের জন্য সবার কাছ থেকেই এক ধরণের সমীহ আদায় করে নিতেন। সময়টাই এমন ছিল, এধারে প্রফুল্ল সেন বা অতুল্য ঘোষ, ওদিকে প্রমোদ দাসগুপ্ত, প্রভাস রায়, এদিকে বিষ্ণুকান্ত শাস্ত্রী, তপন শিকদার। আজ তাঁদের নিজেদের দলেই তাঁরা দেওয়ালে টাঙানো ছবির বেশি কিছু নন। ক’জনের মনে আছে তপন শিকদার মারা গিয়েছিলেন ২ রা জুন ২০১৪? মোদিজির এই সব গিলে ফেলা রাজনীতিতে এভাবেই মুছে যাবে বিজেপির ইতিহাস, অবলিভিয়নে চলে গেছে অটল আদবানি যুগের নেতারা, বাংলাতেও তার ব্যতিক্রম তো দেখছিনা।
এমনিতে বাংলার মাটিতে বিজেপির চাষবাস বেশ কঠিন, তার উপর ইদানিং বিজেপির ধারকরা নেতা নিয়ে বেড়ে ওঠার যে ফরমুলা তা বাংলাতে আপাতত ব্যুমেরাং। সেই জামানার তপন শিকদারের পরে যদি কেউ বঙ্গ বিজেপির শিরা ধমনীতে সিঁদুর না হলেও রক্ত বইয়েছিলেন, তিনি দিলীপ ঘোষ। বিজেপির কোর ফিলোজফি, মূল দর্শনটা তিনিই বোঝেন, জানেন, প্রাকটিস করেন। সঙ্গে নতুন হলেও উত্তরবঙ্গের মুখ হিসেবে ঢুকেছিলেন সুকান্ত মজুমদার। হ্যাঁ। ২০১৯-এর উথ্বান সেই কথাই বলে। কিন্তু বিজেপির বর্তমান নেতৃত্বের তো রোজ ‘সোনার ডিম’ হলে চলবে না, তাই সোনার ডিম পাড়া হাঁসের পেট কেটে ডিম বার করার জন্য শুভেন্দু অধিকারীকে আনা হল। কংগ্রেস, তৃনমূল, মাওবাদী, হরিনাম সংকীর্তন মিলিয়ে এক জগা খিচুড়ি। কিন্তু দুইয়ের থেকে তিন ভালো। দিলীপ–শুভেন্দু–সুকান্ত ট্রায়ো মিলে হাল ধরলেন বঙ্গ বিজেপির। হারাধনের সেই তিন সন্তানের মধ্যে একজন খসেছে, নিশ্চিত ভাবেই তিনি অদূর ভবিষ্যতে আর বিজেপির মুখ নন, আর তাতে অনেকটা স্বস্তিতে তৃণমূল। সেটাই বিষয় আজকে, দিলীপ ঘোষ বিজেপি থেকে বিচ্ছিন্ন, এটা তৃণমূলের বড় লাভ।
আরও পড়ুন: Aajke | মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পাক উগ্রপন্থীদের পক্ষে: অমিত শাহ
বিজেপির এই নতুন ধার করে নেতা আনা শুরু হয়েছিল ২০১৬-২০১৭ থেকে। আর খেয়াল করে দেখুন সেই সময় থেকেই শুরু হয়েছিল ইডি, সিবিআই-এর কড়া নাড়া। কাজেই অত্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্থ সেই তাঁরা, যাঁরা ইডি, সিবিআই-এর হাত থেকে বাঁচতেই বিজেপিতে যোগ দিলেন, তাঁদের একজনও কিন্তু বিজেপির আদর্শের সঙ্গে সামান্যতম পরিচিতও ছিলেন না, বরং তাঁদের সেই সময়ের রাজনৈতিক ভাষণ ইত্যাদি যদি খুঁজে বের করে আনা হয় তাহলে সেখানে বিজেপি যে কত খারাপ একটা নোংরা সাম্প্রদায়িক দল সেই কথা বলা ভিডিওগুলো হুড়হুড় করে বেরিয়ে আসবে। শুভেন্দু অধিকারী, হিমন্ত বিশ্বশর্মা, জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া ইত্যাদিদের অমন ভিডিও অনেক অনেক পাবেন। আর তার উপর এই বাংলাতে শুভেন্দু অধিকারী ছিলেন তৃণমূলের এরিয়া এক্সপ্যানশন, এলাকার দখলদারি বাড়ানোর মূল হাতিয়ার। পুলিশকে ব্যবহার করে, প্রশাসনকে ব্যবহার করে রীতিমত পিটিয়েছেন বিজেপি, সিপিএম ক্যাডারদের, কর্মীদের। কিন্তু তিনিই আজ বিজেপির আদত মুখ, তিনিই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন দলের মধ্যে গোষ্ঠিবাজীর পুরনো ঐতিহ্য, যা প্রথমে কংগ্রেস পরে তৃণমূলের শিরায় শিরায় আছে। এবং দলে এসেই শুভেন্দু বুঝেছিলেন, এই দলে তাঁকে বেড়ে উঠতে হলে, শীর্ষে উঠতে হলে ঐ অস্ত্রকে ব্যবহার করতে হবে। সুচারুভাবেই সেটা তিনি করেছেন। হ্যাঁ তিনটে ঘোড়ার একটা কিন্তু মাঠের বাইরে, হারাধনের তিনটি ছেলের মধ্যে একটিকে বাঘে নয়, সিম্পল কাঠিবাজিতেই সরিয়ে দেওয়া গিয়েছে। সুকান্ত যদি পুরোপুরি সারেন্ডার না করেন, তাঁর অবস্থাও সেটাই হবে। এবং দেখুন শুভেন্দুর সফলতা, অমিত শাহ কলকাতায় আসছেন, সেই সভাতে দিলীপ ঘোষ নেই, এবং সেই সভাতেই শুভেন্দু অধিকারীকে অমিত শাহ বাংলার আগামী নির্বাচনের মুখ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলেন। হ্যাঁ, হারাধনের তিনটি ছেলের বাদ পড়ল এক। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, দিলীপ-শুভেন্দু-সুকান্ত, এই তিনমুখের দিলীপ ঘোষ খসে গেছে, আপাতত দু’জন রইলেন। কিন্তু দিলীপ ঘোষ ছাড়াই বঙ্গ বিজেপি ২০২১ এর ৭৭ বিধায়ক সংখ্যার উপরেও কি উঠতে পারবে?
আরএসএস-এর দর্শন আত্মস্থ করা দিলীপ ঘোষ অনেক বেশি বিপজ্জনক ছিলেন তৃণমূল বা বামপন্থীদের কাছে, কারণ তিনি এ রাজ্যে আরএসএস-এর প্রচার আর প্রসারের জন্য এক লম্বা রেসের ঘোড়া হিসেবেই নেমেছিলেন, বা তাঁকে নামানো হয়েছিল। খেয়াল করে দেখুন আসন নয়, এমএলএ নয়, এমপি নয়, দিলীপ ঘোষের কাছে তৃনমূল নেত্রী যে আরএসএস–বিজেপির দর্শন অনুযায়ীই জগন্নাথ মন্দির তৈরি করে হিন্দুত্বের সমর্থনে কাজ করেছেন। এই ন্যারেটিভটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একমাত্র উনিই সেই ন্যারেটিভটা সেট করার দিকে এগোচ্ছিলেন। শুভেন্দু অধিকারী উল্টোপথে জগন্নাথ মন্দিরের বিরোধিতা করতে গিয়ে নিজের জেলাতেই সমর্থন হারাচ্ছেন, হারাবেন। সেই দিক থেকে দেখতে গেলে তৃণমূলের এক নিশ্চিত বিপদ দূর হয়েছে। দিলীপ ঘোষ তৃণমূলে যোগ দেবেন না, কিন্তু যতটা বঙ্গ বিজেপির থেকে দূরে থাকবেন ততই তৃণমূলের সুবিধে।