কেরালার ভোট শেষ, রাজ্য জুড়ে প্রচার করেছেন সিপিএম নেতারা, কংগ্রেস যে আসলে সিএএ-এনআরসির বিরোধী নয়, একথা মানুষকে বুঝিয়েছেন, কংগ্রেস যে আসলে বিজেপিকেই শক্তিশালী হিসেবে দেখতে চায় তা বুঝিয়েছে। সম্ভবত দলের সেই মূল্যায়নের কথাও বলা হয়েছে যাতে সাফ বলা আছে কংগ্রেস হল আদতে দেশের একচেটিয়া পুঁজিপতি আর অবশিষ্ট সামন্ত্রতন্ত্রের প্রতিনিধি। এদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অংশের মেহনতি মানুষ, শ্রমিক কৃষক আর গণতান্ত্রিক মানুষজনদের নিয়ে কমরেডস, জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব হবেই। ওদিকে কংগ্রেস কি ছেড়ে কথা কইবে? কেরালার আসনে আসনে প্রচার এবারে সিপিএম বিজেপির সঙ্গে গোপনে রফা করেছে সেইজন্যই বাম জোটের চেয়ারম্যান জয়রাজন বিজেপি নেতা প্রকাশ জাভড়েকরের সঙ্গে গোপন বৈঠকও সেরে ফেলেছেন। এবং কী আশ্চর্য, এই বৈঠকের কথা সিপিএম অস্বীকারও করেনি। তো এই ঘমাসান প্রচার শেষ হওয়ার পরেই দলের পলিটব্যুরো নেতা বৃন্দা কারাত কলকাতায় এসেই কংগ্রেস নেত্রীদের সঙ্গে দক্ষিণ কলকাতার প্রার্থী সায়রা হালিমকে নিয়ে রোড শো করেছেন, হাজির ছিলেন কংগ্রেস নেত্রী কৃষ্ণা দেবনাথ। কিন্তু ক্যাচাল যাদবপুরে, সেখানকার কমরেডরা কংগ্রেসের দায় নিতে রাজি নন, ৭০-এর দশকে যাদবপুর টালিগঞ্জ জুড়ে কংগ্রেসি গুন্ডাদের অত্যাচারে পাড়াছাড়া কমরেডদের অনেকেই এখন ৬০/৭০/৮০, তাতে কি? তাঁদের ভোটও আছে, তাঁরা এখনও পার্টি অফিসে পিদিম জেলে রেখেছেন। তো তাঁদের আপত্তিতেই সম্ভবত বৃন্দা কারাত সৃজন ভট্টাচার্যকে নিয়ে জিপে চড়লেন, না, কংগ্রেসের কেউ ছিল না। কেন ছিল না? যাদবপুর কি কেরালা? সে উত্তর দেবে কে? উত্তর চাইলে প্রশ্ন করলেই তো আপনি হয় তিনি নয় চাড্ডি, বিপ্লবীরা এদের প্রশ্নের উত্তর দেবেনই বা কেন? আর তাই এটাই আমাদের বিষয় আজকে। হাত ধরিব, হাত ধরিব না, সিপিএম-এর দোলাচল চলছে চলবে।
এ কি আজকের দোলাচল? দল তৈরির পর থেকেই এই বিতর্ক কমিউনিস্ট পার্টিতে ছিল। দেশের চরম দক্ষিণপন্থী ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক শক্তির অভ্যুত্থানের কথা সফিদা বলার বহু আগেই ডাঙ্গে সাহেব বলেছিলেন, তো স্লোগান উঠেছিল আদি নব ডাঙ্গে স্থান নেই বঙ্গে, দিল্লি থেকে এল গাই, সঙ্গে বাছুর সিপিআই। এসব তো আমরা জানি। জরুরি অবস্থার সময়ে সিপিআই তো ছিল কংগ্রেসের সঙ্গে। কংগ্রেসের ক্ষমতা যেতেই ওনারা আবার বিপ্লবী হয়েছেন। ওনারা কংগ্রেসের সঙ্গ ত্যাগ করেছেন। কিন্তু কংগ্রেস প্রশ্নের সমাধান হয়েছে কি?
আরও পড়ুন: Aajke | কাঞ্চন কল্যাণ কথামৃত ও সেমসাইড গোলের আখ্যান
কিছুদিনের মধ্যেই আবার সেই একই প্রশ্ন নিয়ে হাজির সৈফুদ্দিন চৌধুরি, সমীর পুততুণ্ডরা, আলাদা দল তৈরি হয়ে গেল। দল থেকে বহিষ্কার করা হল আপসকামীদের, কংগ্রেস বিজেপির থেকে সমদূরত্বের লাইন। তারপর সমদূরত্ব ঘুচিল। সরকারে গেলেন না কিন্তু বাইরে থেকে সমর্থন, বৈপ্লবিক সমর্থন। উঠতে বললে উঠবে, বসতে বললে বসবে। তো কংগ্রেস দেশ বেচে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল, যার তার কাছে নয়, আমেরিকার কাছে, অতএব সরকার ফেলে দেব, সমর্থন তুলে নিলেন প্রকাশ কারাত অ্যান্ড কোম্পানি। ব্যস, হাউস অফ কার্ডস, ঝুপ করে পড়ে গেল বাম সরকার, উন্নততর বাম সরকারের বদলে তৃণমূল সরকার। দিশেহারা সিপিএম এই বাংলায়, ওধারে কংগ্রেসের সঙ্গে লাগাতার লড়ে কেরালাতে টিকে আছে সিপিএম। ১০ বছরের মধ্যে কত ধরনের কথা, কংগ্রেসের সঙ্গে স্থানিক বোঝাপড়া, আসন বোঝাপড়া, আসন সমঝোতা, জোট, জোট নয় মঞ্চ, এসব হতে থাকল এই বাংলায়, দেওয়ালে টাঙানো ডাঙ্গে আর সফিদা হেসেই যাচ্ছেন। অতঃপর ২০২১-এ আব্বাসকে খুঁজে পেলেন কমরেড সেলিম। চণ্ডীতলা বিধানসভায় জেতার চাবিকাঠি, সে কী জড়াজড়ি। তারপর শূন্যতায় মৌনতা। এবার অধীর-সেলিম পদযাত্রা, অধীর-সেলিম যৌথ বৈঠক। অধীর-সেলিম সমঝোতা, সিপিএম-কংগ্রেস নয়। তা হলে তো রাজ্যের সর্বত্র এটা হত। এখানে দুই লুজারের ঐক্য, অধীর জানেন সিপিএম-এর ভোটটা এলে তবুও জেতার চান্স আছে, সেলিম জানেন কংগ্রেসের ভোট না পেলে জামানত যাবে। অতএব তাঁদের জোট, যে জোটকে রাজ্যে কং-বাম জোট বলে চালানো হচ্ছে, ভোটের পরে আবার নতুন সমীকরণের জন্য বসে থাকুন। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম যে কেরালাতে একে অন্যকে বিজেপির বি টিম বলার পরে এ রাজ্যে কংগ্রেস বাম নির্বাচনী সমঝোতা কি হাস্যকর হয়ে উঠছে? এমনকী রাজ্যেরও সব জায়গাতে হাত কাস্তের জোট হচ্ছে কি? শুনুন দর্শকরা কী বলেছেন।
বহু আগে কমিউনিস্ট পার্টিকে কৌশল পার্টি বলে ডাকত অনেকে। কমিউনিস্ট পার্টির বিভিন্ন কৌশলী নীতির জন্যই কি? জানি না, কিন্তু এটা বেশ চালু ছিল। কিন্তু এক আদর্শ মেনে চলা, ক্যাডারভিত্তিক দল বলেও পরিচিতি ছিল, সেই দল মূলত এই কংগ্রেসকে সমর্থন করব কি করব না এই প্রশ্নের সমাধান করে উঠতে পারেনি। কংগ্রেসেরর শ্রেণি চরিত্রের মূল্যায়নেও কোথাও ভুল তো থেকেই গেছে নিশ্চয়ই। যখন গোটা পৃথিবী দেশের নেহরু ইন্দিরা সরকারকে রুশ ঘেঁষা সোশ্যালিস্ট সরকার বলছে, তখন কমিউনিস্টরা ঠিক করে উঠতে পারছেন না তাঁরা কী বলবেন। সেই দোলাচল আজও কাটলো না। এই ভোট তো পার হবে একদিন, সেই অবসরে আগে এই দোলাচল কাটান কমরেডস, তারপর আবার নতুন দম নিয়ে রাস্তায় নামুন। না হলে যাদবপুরে হাত ছেড়ে দক্ষিণ কলকাতায় হাত ধরে, মুর্শিদাবাদে গলা জড়াজড়ি করে কোচবিহারে বিরোধিতা করতে হবে, কেরালার কথা তো বাদই দিলাম। আর এত স্ববিরোধিতা নিয়ে রাজনীতি করা যায় নাকি?