রাস্তাঘাটে অনেক কিছুই মালুম পড়ে না। হাঁটতে চলতে কি মালুম হয় দেশের এক চতুর্থাংশ মানুষ, চারজনের একজন দু’বেলা খেতেই পায় না? বোঝা যায়? মাত্র গতকাল নন্দনে ছবি দেখার জন্য ভিড় সামলাতে পুলিশ নেমেছিল। পার্ক স্ট্রিটে ঝলমল আলো, রেস্তরাঁতে নববর্ষের আয়োজন, চারিদিকে ঠান্ডা বাড়ছে এবং তাই কি অনাবিল আমোদের ঝর্নাধারা। বোঝা কি যায় যে বেশ কিছু মানুষ এই ঠান্ডায় নিরাশ্রয়, টুক করে মরেই যাবে। আপনার চারপাশে যে উচ্ছ্বল যৌবন ঘোরাফেরা করে, যে ঝাঁক যুবক যুবতী অনায়াসে ১৮০ টাকায় তেলাপিয়া ফ্রাই কিনে খেয়ে নেয় তাদের দেখে কি বোঝেন দেশ বেকারত্বের রেকর্ড সীমা পার করেছে। এসবই হল সেই আচমকা ভূমিকম্পের মতো যা নজর এড়িয়ে যায় বহু মানুষের। কিন্তু না, একটা জায়গায় গেলে আপনি একশো শতাংশ টের পেয়ে যাবেন, পোস্টের পর পোস্ট আছড়ে পড়বে, ভূমিকম্প হইছে, টের প্যালা? গাইজ আর্থকোয়েক, স্টে সেফ। আপনিও জেনে যান সেই সুখবর। নেপালের প্রত্যন্তে তখন মানুষ, চাপা পড়া মানুষ অক্সিজেনের জন্য লড়ছে, আপনি ফেসবুকে লেখেন আই অ্যাম সেফ। এবং বিশ্বাস করুন এ এক আশ্চর্য অ্যালগরিদমের খেলা, এক ধ্বনির প্রতিধ্বনি, এক ছোট্ট পরিসরে সে তথ্য ঘুরপাক খেতে থাকে, আপনি ভাবেন সবাই বোধহয় ভূমিকম্প নিয়ে ওয়াকিবহাল। ঠিক সেইরকম রাস্তায় ঘাটে, চা’খানায়, বাজারে, লোকাল ট্রেনের হাঁসফাঁস ভিড়ে, বাদুড়ঝোলা বাসে, চাকরিপ্রার্থী বেকারের নয়, কন্যাগ্রস্ত পিতার কাছে নয়, আনাজ জলে ডুবেছে এমন কৃষকের কাছে নয়, ফেসবুকেই রাজ্যের জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে বিতর্ক আপাতত জমে ক্ষীর। কী কাণ্ড, রবি ঠাকুরের, জানিস? জানো? জানেন? রবি ঠাকুরের গানের শব্দ পাল্টে দিয়েছে। আমার প্রতিবাদের ভাষা তো এখন ফেসবুকেই, কাজেই ফেসবুকে সে উচ্ছ্বল জলতরঙ্গ বইছে, সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু বাংলার ফল…
রাজ্য সরকার রাজ্যের এক সঙ্গীত হোক এমন এক সিদ্ধান্তের পরে শেষমেশ বাংলার বায়ু বাংলার জল গানটাকে বেছে নেয়। এবং এক শুভক্ষণে তার কিছু শব্দ বাদ দিয়ে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী এবং কিছু শিল্পীরা সমবেত কণ্ঠে সেই গান গেয়ে শুনিয়েও দেন। বাঙালির পণ, বাঙালির আশা, বাঙালির কাজ, বাঙালির ভাষা– সত্য হউক, সত্য হউক, সত্য হউক হে ভগবান॥ বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন, বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন– এক হউক, এক হউক, এক হউক হে ভগবান॥ ওই কেবল বাঙালির শব্দটা প্রাদেশিক অর্থ বহন করে? করেই তো। এ রাজ্যেই আছেন এমন লক্ষ লক্ষ অবাঙালিকে বিচ্ছিন্ন করে তাই ওই ‘বাঙালির’ শব্দের বদলে ‘বাংলার’ বসিয়ে দেওয়া হয়েছে, ঝামেলা শেষ।
আরও পড়ুন: Aajke | যাঁরা বলেছিলেন নো ভোট টু বিজেপি, তাঁরা আর সেই কথা বলছেন না কেন?
না, এইখানেই ঝামেলার শুরু। রবি ঠাকুরের নামের শেষে ঠাকুর আছে, খোদার ওপর খোদকারি করিবে কে? সামান্য প্রিলিউড ইন্টারলিউড বসানোর দায়ে, কিছু যতিচিহ্নের ইচ্ছে অনুযায়ী প্রয়োগের দায়ে রবি ঠাকুরের সাম্রাজ্য থেকে নির্বাসিত হতে হয়েছিল দেবব্রত বিশ্বাসকে। আক্ষেপ শুনেছিলাম তাঁর মুখে, গাইতাম পারলাম না, গাইতাম পারলাম না সেই গান। আর এ তো কালীঘাটের এক নন এলিট মহিলা এবং তাঁর সরকার, যিনি কবিতা লেখেন এপাং ওপাং ঝপাং, শুনে বাচ্চারা হাসে মন খুলে আর বড়রা হাসেন দাঁত কেলিয়ে। এত বড় স্পর্ধা, রবি ঠাকুরের শব্দ বদল? প্যারডি গানও লিখে ফেললেন এক সাহিত্যিক। ফেসবুক দেখে মনে হচ্ছে এই ইস্যুতে সরকার না পড়ে যায়, মনে হচ্ছে চুলোর দোরে গেছে অন্য সব চিন্তা, অনুব্রতের দুর্নীতি বা পার্থ প্রেমের কাহিনি, আপাতত এক হি ইস্যু, ঠাকুরের কবিতার শব্দ বদল। তাকিয়ে দেখুন প্রতিবাদের লিস্টিতে তাঁরাই আছেন যাঁরা এই সরকারের আরও বহু সিদ্ধান্তের লাগাতার বিরোধিতা করেই যাচ্ছেন। এই বিরোধিতাও কি স্বাভাবিক ছিল না? ছিলই তো। কিন্তু অস্বাভাবিকতাটা তাহলে কী? এই বদলের পক্ষে সরকারপন্থী বুদ্ধিজীবীদের হীরণ্ময় নীরবতা, তুমি নীরব কেন কবি? গায়ক? চিত্র পরিচালক? অভিনেতা? শিল্পী? তাঁরা এবং মঞ্চে মঞ্চে হাজির ঝিঙ্কু মামণিরা চুপ। আসুন, মাঠে নামুন, পক্ষে বিপক্ষে যুক্তি আসুক, কেবল ফেসবুকে কেন? নন্দন চত্বরে উঠুক কথা, হোক কলরব। পক্ষের যুক্তি শুনি, বিপক্ষের যুক্তিও শুনব। যদিও তা রাজ্যের অর্থনীতি বা সমাজনীতিতে সামান্য দাগও কাটতে অক্ষম তবুও এই ইস্যুতে তাবড় সরকারপন্থী বুদ্ধিজীবীদের নীরবতা সত্যিই চোখে পড়ে। যে গায়ক রহমানের বিরুদ্ধে ফেসবুক লাইভ করে ফেললেন, তিনি আজ এই বিতর্কের সময় ঘরে একমনে কালোয়াতি ভাঁজছেন, এটা সত্যিই দৃষ্টিকটু। এবং শুনে নিই জনতা জনার্দন এই ইস্যুতে কী বলছেন? মানুষজন কী বলছেন? আমরা জিজ্ঞেস করেছিলাম, রাজ্য সঙ্গীত তৈরি করতে গিয়ে রবি ঠাকুরের যে শব্দ বদল হল তার খবর কি আপনাদের কাছে আছে? তা নিয়ে আপনাদের বক্তব্য কী? শুনুন তাঁদের জবাব।
বন্দেমাতরমের প্রথম দুই স্তবকের পর বাকিটা বাদ দিয়েই তা গ্রহণের সিদ্ধান্ত মূলত রবি ঠাকুরের মতামত নিয়েই করা হয়েছিল। এরপরে বঙ্গসমাজে বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা সম্পাদনা করার জন্য রবি ঠাকুরকেও কম কথা শুনতে হয়নি। ১৬ নভেম্বর ১৯৩৭-এ আনন্দবাজার কী লিখেছিল শুনুন, “রবীন্দ্রনাথ বন্দেমাতরম্ সঙ্গীতের ব্যবচ্ছেদের সম্মতি দিলেও বাংলার অন্যান্য প্রবীণ সাহিত্যিক স্বর্গগত বঙ্গিমচন্দ্রের অমর রচনার প্রতি এই অসম্মানের প্রতিকারার্থে সমবেত হইয়াছেন ইহা আশার কথা। বঙ্কিমচন্দ্রের রচনায় হস্তক্ষেপ অনুমোদন করিয়া রবীন্দ্রনাথ যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করিয়াছেন, তাহার কুফল যে শেষ পর্যন্ত তাহার উপরে আসিয়াও বর্তাইতে পারে ইহা সম্ভবত তিনি ভাবিয়া দেখেন নাই। টেক্সটবুক কমিটি হইতে তাহার রচনার অংশবিশেষ পরিবর্তন ও পরিবর্জনের জন্য প্রস্তাব করিলে তিনি যে যুক্তি দেখাইয়া প্রবল প্রতিবাদ জানাইয়াছিলেন, বঙ্কিমচন্দ্রের রচনায় হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধেও সেই যুক্তি এবং সেইরূপ প্রতিবাদই তিনি করিবেন আশা করিয়াছিলাম। কিন্তু তিনি না করিলেও বাংলার অন্যান্য বিশিষ্ট সাহিত্যিকেরা সাহিত্যগুরুর সম্মানরক্ষায় সচেষ্ট হইলেও সে চেষ্টা সার্থক হইবে বলিয়া আমরা বিশ্বাস করি।” আজ সেই সুরেই রবি ঠাকুরের কবিতার সম্পাদনা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু সে আলোচনা সাধারণ মানুষের বোধের ঊর্ধ্বে, তাঁদের কিছুই এসে যায় না।