একটা ব্যাপার খেয়াল করেছেন, এই রাজ্যে শুভেন্দু অধিকারী সবথেকে সফল মানুষের প্রতিটা ক্ষোভ বিক্ষোভ, দাবি দাওয়ার লড়াইকে আদালতের চৌহদ্দিতে নিয়ে যেতে। এমনি তো লোকজনেরা ঠাট্টা করে বলে যে বাংলার দক্ষিণের লোকজন মানে দোকনেদের একটা টাইম পাস হল মামলা লড়া। কাকা-ভাইপো নাকি এক বাসে করে কলকেতায় এসে মামলা ঠুকে এক বাসেই বাড়ি ফিরে যায়। কিন্তু সেসব ঠাট্টা বাদ দিলেও এটা সত্যি কথা যে শুভেন্দু অধিকারী, সাকিন মেদিনীপুর, আপাতত রাজ্যের সমস্ত দাবি দাওয়া, বিক্ষোভ, ক্ষোভ সবকিছুকে হাইকোর্ট চত্বরে নিয়ে গেছেন আর শুধু তাই নয়, তাঁর এই মহান কাজ দেখে বিপ্লবী সিপিএমও দারুণ অণুপ্রাণিত, তাঁরাও এখন কথায় কথায় আদালতের দরজায় গিয়ে হাজির হচ্ছেন এবং কে না জানে আদালতের রায়ের এক বিবর্তনের কথা, যা আমরা গত ১০/১১ বছর ধরে দেখছি। যে আদালতের সর্বোচ্চ বিচারপতি থেকে উচ্চকোটির বিচারপতিরা বিজেপিতে যাচ্ছেন, যোগ দিচ্ছেন, প্রসাদ পাচ্ছেন। গত পাঁচ বছরের ইতিহাস দেখুন, বিজেপি রাজ্যের এরকম কোনও বিষয় আছে যা নিয়ে আদালতের কাছে যায়নি? তার আগের ৩০ বছরের ইতিহাসের সঙ্গে একটা তুলনা করলে এই সত্যিটা বেরিয়ে আসবে। এবং এক্কেবারে ভাই ভাই সুধীর ভাইয়ের মতো, বিজেপির সঙ্গে সমান তালে লড়ে যাচ্ছে সিপিএম, কোথাও কোথাও তারচেয়েও বেশি কারণ ন্যাড়া বাগচীর থেকে বিকাশ ভট্টাচার্যির মেধা অনেক অনেক অনেক বেশি। সেই সিপিএম-এর তরুণ নেতা সায়ন বন্দ্যোপাধ্যায় আদালতের কাছে গিয়ে বললেন হুজুর সংসদের নির্বাচন হয়নি, ইউনিয়ন রুম দখল করে আছে তৃণমূলের গুন্ডারা, তোলাবাজি হচ্ছে, ধর্ষণ হচ্ছে। বিচারক শুনলেন, ইউনিয়ন রুমগুলোকে বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন, একলপ্তে রাজ্যের প্রায় সব ইউনিয়ন রুম বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ এই প্রথমবার কোনও আদালত থেকে এল। উল্লাস উল্লাস, না রহেগা বাঁশ, না বজেগা বাঁশুরি। সেটাই বিষয় আজকে, আদালতের রায়ে বন্ধ কলেজ ইউনিয়ন রুম, তারপর?
শুরু থেকে বলি? চিটফান্ড দুর্নীতি, যাবতীয় লড়াই আদালতেই হয়েছে, রাস্তার লড়াই ছিল অপ্রাসঙ্গিক, অর্থহীন, কারণ তা আদতে লড়া হচ্ছিল আদালতেই। ফলাফল? একটি বৃহৎ বুড়ো আঙুল। শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি, যুগান্তকারী রায় দিয়ে বিচারক এখন বিজেপির সাংসদ, যে উকিলেরা যাঁদের হয়ে লড়ছিলেন তাঁরাই এখন আর এক পক্ষে, ইন ফ্যাক্ট মানুষের মাথায় ঠিক কী হয়েছে তা ঢোকার আগেই আদালতের শত শত সওয়াল আর নির্দেশ এসেছে, মানুষ জেনেছেন, বোঝেননি। কারণ তা বোঝানোর জন্য লড়াইটা রাজপথে দরকার, সেখানে দানা বাঁধেনি। আরজি কর এক নতুন আন্দোলনের রাস্তা দেখিয়েছিল, কিন্তু না সেই আন্দোলনকে আরও বড় পরিধিতে না ছড়িয়ে বেছে নেওয়া হল সহজ পথ, আদালত আদালত, আদালত। মানুষ মনে করল তাহলে সুপ্রিম কোর্ট বসবে আর ফাঁসি দেবে সবকটাকে। হয়নি। হওয়ার কথাও নয়।
আরও পড়ুন: Aajke | বাংলার রাজনীতিতে পরিবর্তন আনতে পারবেন শমীক ভট্টাচার্য?
যে মানুষেরা এসেছিলেন তাঁরা ধ্যাৎ সব্বাই চোর বলে ঘরে চলে গেছেন, কসবা ধর্ষণের পরে এমনকী তাঁদের এক ছোট অংশকেও ফেরত আনা গেল না রাস্তায়। কসবা আন্দোলনকে রাস্তায় নিয়ে গিয়ে সারা রাজ্যের কলেজে কলেজে ছড়িয়ে দেওয়া যেত, সায়ন ব্যানার্জি আদালতে গেলেন, আদালতের নির্দেশে সব ইউনিয়ন রুমে চাবি পড়ল, হ্যাঁ আদালতের নির্দেশ দিয়েই ছাত্র সংসদের ঘরে তালা লাগানো যায়, সেই পথটা দেখিয়ে দিলেন তিনি, আগামী দিনে তাঁর অন্য চেহারা আমরা নিশ্চয়ই দেখব। ২০১১ থেকে আজ অবধি মমতা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে কম, মামলা হয়েছে বেশি, গত চার পাঁচ বছরে তা এক চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে। প্রতিটা দাবির জন্য, প্রতিটা বিক্ষোভের জবাবে মামলা। তেভাগার লড়াইতে ক’টা মামলা হয়েছিল? বাম আমলে জুনিয়র ডক্টরস মুভমেন্টে ক’টা মামলা হয়েছিল? নকশালবাড়ির জমি দখলে ক’টা মামলা করতে হয়েছিল? খাদ্য আন্দোলনে ক’টা মামলা লড়েছিলেন কমরেডরা? ট্রাম বাস ভাড়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন কোথায় হয়েছিল? হাইকোর্টে না রাস্তায়? জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে মানুষ কোথায় গিয়েছিলেন? আদালতে? না দিল্লির রামলীলা ময়দানে? পাটনার রাজপথে? সিঙ্গুরের আন্দোলন মমতা হাইকোর্টে করেছিলেন? নন্দীগ্রামের আন্দোলন কোন হাইকোর্টে কোন উকিল লড়েছিল? মামলা লড়েই রাজ্যের ক্ষমতায় আসতে চাইলে একটা উকিলদের সংগঠন করলেই হয়, শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, যুব এসব ভাট বকে লাভ কী? এরপরে কারখানার ইউনিয়ন রুম বন্ধ হবে, রাজ্য কর্মচারীদের দফতরের ইউনিয়ন রুম বন্ধ হবে। ত্রিপুরার বিজেপি নেতা গিয়ে প্রমাণ করে দেবে সিপিএম দফতরে বোমা বাঁধা হয়, সেগুলোও বন্ধ হবে। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম যে সিপিএম নেতার আবেদনে সায় দিয়ে আদালত ছাত্র ইউনিয়ন রুমগুলোকে বন্ধ রাখার নির্দেশ দিল, ছাত্রছাত্রীরা এই রায় কে কেমনভাবে নেবে? রাস্তায় আন্দোলন না করে কেবল আদালতের ওপরে নির্ভরশীল সিপিএম, বিজেপি আসলে কি তৃণমূলের সুবিধেই করে দিচ্ছে? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
কসবা ঘটনার পরেই অনেকেই বুঝেছেন কলেজ সংসদের নির্বাচন চাই, সেই নির্বাচনে বহু ইস্যু সামনে আসত, রাজ্যজুড়ে সেই নির্বাচন এক বড় আন্দোলন হয়ে উঠতে পারত। কিন্তু আজ দুপুরে জলঙ্গী, লাভপুর, করিমগঞ্জ, কোচবিহার, শিলিগুড়ির কোনও ছাত্র বা ছাত্রী গিয়ে দেখবে তাদের কলেজের ইউনিয়ন রুমটা বন্ধ, সিপিএম এক নেতার আবেদনে আদালতের রায়ে বন্ধ। সারা রাজ্য জুড়ে কোন প্রতিক্রিয়ার সামনে দাঁড়াবেন বাম ছাত্র নেতৃত্ব? তাঁরা শুভেন্দুকে এক্কেবারে কপিবুক স্টাইলে ফলো করে গোটা লড়াই, বিক্ষোভ আন্দোলনটাকে আসলে পাঠিয়ে দিলেন হাইকোর্ট চত্বরে, যেখানে বাদী আর বিবাদী পক্ষের উকিলেরা এক দোকানে চা খেয়ে আদালতে গিয়ে সওয়াল করে এক দোকানেই লাঞ্চ সেরে ফেলেন, আরও বড়রা চেম্বারে টিফিন ভাগ করে খান, লাঞ্চও, খবর নিন, সেখানে কোনও লড়াইই নেই।