রাজ্য বিজেপির সহ-সভাপতি প্রতাপ বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজ্য যুব মোর্চার সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ দাস এবং সহ-সভাপতি তরুণজ্যোতি তিওয়ারি দুজনেই ছিলেন কিন্তু বাকিরা কেন ছিলেন না জানি না। কিন্তু গত শুক্রবার বিজেপির তরফে ঘোষণা করা হয়েছে, ১৫ অগাস্ট সকালে রাজ্যের সমস্ত মণ্ডলে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের পরে ৭৫ জন বিজেপির যুবকর্মী জাতীয় সঙ্গীত গাইবেন। ইতিমধ্যেই সংগঠনের প্রায় ২০ হাজার কর্মী জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে নানা সামাজিক মাধ্যমে আপলোড করেছেন বলে যুব মোর্চার দাবি। আগামী ১৫, ১৬ এবং ১৭ তারিখ রাজ্য জুড়ে চলবে তেরঙা যাত্রা। কোথাও সাইকেল মিছিল, আবার কোথাও পায়ে হেঁটেই বিধানসভা পিছু কর্মীদের ৭৫ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শিলিগুড়িতে হবে টানা ৩০ কিলোমিটার সাইকেল মিছিল। তো সেই অনুযায়ী আজকে তাদের এই দেশপ্রেম কার্যক্রম শুরু হয়ে গেল। ভাবতেই রোমাঞ্চ হয়, বিজেপি বলছে দেশপ্রেমের কথা, বিজেপি বলছে তেরঙা ঝান্ডার কথা। লালমোহনবাবু বেঁচে থাকলে বলতেন এদেরকে তো কাল্টিভেট করতে হচ্ছে হে। বেড়াল হঠাৎ করে মাছ ছোঁব না, মাছ খাবো না কাশী যাব বললে, আর সেটা শুনে ফেললে যেরকম হয়, আমার খানিকটা সেইরকম মনে হচ্ছে। এই তরুণজ্যোতি তিওয়ারির জানা আছে যে স্বাধীনতার পরে ৫৩ বছর পর্যন্ত নাগপুরে আরএসএস দফতরে, যে দফতর থেকে বিজেপিকে চালানো হয়, সেখানে জাতীয় পতাকা কেবল তোলেনি নয়, তুলতে দেয়নি। একবার কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠন এনএসইউআই জোর করে ঢুকে জাতীয় পতাকা তুলতে গিয়ে বেদম ক্যালানি খেয়েছিল, মুখেচোখে পোড়া মোবিল ঢেলে দেওয়ার রেওয়াজ তখনও ছিল না, কিন্তু রাম ধোলাই দেওয়া হয়েছিল। কেন? সেই বদমাশেরা আরএসএস দফতরের উপরে জাতীয় পতাকা তুলতে এসেছিল। আজ সেই আরএসএস-এর রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি কাঁধে তেরঙা ঝান্ডা নিয়ে মিছিল করছে, করবে। সেই রোমাঞ্চকর ঘটনাই বিষয় আজকে।
দেশে একটা স্বাধীনতা দিবস তো ছিল, কিন্তু আরএসএস–বিজেপির সেটা পোষাচ্ছিল না, ওনারা দ্বিতীয় স্বাধীনতা দিবসের ঘোষণা করলেন রাম জন্মভূমিতে মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্থর পোঁতার দিনে। তো ভাইসকল, সেই দ্বিতীয় স্বাধীনতা দিবসে ক’টা জাতীয় পতাকা ছিল? যেদিন ওই মন্দির হম বনায়েঙ্গে বলে শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ভাঙতে গেলেন, সেদিনে হাতে ক’টা তেরঙা ঝান্ডা ছিল? একটাও না। কারণ ওনারা এই তেরঙা ঝান্ডাতে আস্থা রাখেননি কোনওদিন। দেশের সংবিধানের জন্য তৈরি আম্বেদকরের নেতৃত্বে গণপরিষদ নিয়েছিল এই ত্রিবর্ণ জাতীয় পতাকার সিদ্ধান্ত। কী ছিল তখন এই আরএসএস-এর ভূমিকা?
আরও পড়ুন: Aajke | শান্তি মিছিলে পোড়া মোবিল, কলকাতার লজ্জা
তাদের পত্রিকা দ্য অর্গানাইজার-এ তারা লিখেছিল, “The people who have come to power by the kick of fate may give in our hands the tricolour but it will never be respected and owned by Hindus. The word three is in itself an evil, and a flag having three colours will certainly produce a very bad psychological effect and is injurious to a country.” লিখেছিল হিন্দুরা কখনও এই ত্রিবর্ণ পতাকাকে মেনে নেবে না, তিন সংখ্যাটাই হল অশুভ, তিনটে রং দেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হবে। হ্যাঁ, এ কথা আরএসএস-এর মুখপত্রে লেখা হয়েছিল, তারা আজ জাতীয় পতাকার কথা বলছে, তারা জাতীয় পতাকার সম্মান অসম্মান নিয়ে কথা বলছে? জাতীয় পতাকা কাঁধে নিয়ে নৌটঙ্কি করছে? গোলওয়ালকর তাঁর বই বাঞ্চ অফ থটস-এর ড্রিফটিং ড্রিফটিং শিরোনামে লিখছেন, আমাদের নেতারা যে নতুন পতাকা তৈরি করলেন তা মানুষের নজর সরিয়ে দেওয়ার জন্য, আমাদের কি অন্য কোনও পতাকা ছিল না? নিশ্চয়ই ছিল। আসলে তিনি ওই ভাগওয়া ঝান্ডার কথা বলছেন। তিনি হিন্দুরাষ্ট্রের ধারণা থেকেই কথাগুলো বলছেন, এদের কাছ থেকে জাতীয় পতাকা আর দেশপ্রেমের কথা শুনতে হবে? দেশপ্রেম? আরএসএস-বিজেপির দেশপ্রেম? পাঁচ পাঁচটা চিঠিতে যাদের নেতা ফিলোজফার গাইড, সাভারকর কাকুতি মিনতি করে মুচলেকা দিয়েছে ইংরেজদের কাছে, যাতে ছত্রে ছত্রে আছে বীর সাভারকরের কাপুরুষতার কাহিনি, কীভাবে ইংরেজদের সাহায্য করার প্রস্তাব দিয়ে ছাড়া পেতে চেয়েছিলেন আন্দামানের কারাগার থেকে, তারা দেশপ্রেমিক? সরসঙ্ঘচালক গোলওয়ালকর ইংরেজদের লিখছেন, কীভাবে ৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরুদ্ধে তারা ইংরেজদের পাশে দাঁড়াতে চায়। সঙ্ঘের প্রত্যেক সদস্যের কাছে নির্দেশ যাচ্ছে এই মর্মে, নির্দেশ যাচ্ছে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগদান না করার। যারা এই নির্দেশ দিচ্ছে, তারা দেশপ্রেমী? যারা মুসলিম লিগের হাত ধরে দেশটাকে দু’ টুকরো করার আবেদন করছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কাছে, তারা দেশপ্রেমিক? তাদের কাছ থেকে আমাদের দেশপ্রেম শিখতে হবে যারা জওয়ানদের লাশের উপর দিয়ে নির্বাচনী সাফল্য আনে, আনার চেষ্টা করে? আমরা আমাদের দর্শকদের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলাম, যে সংগঠনের মাথায় বসে থাকা সাভারকর ইংরেজদের কাছে একটা নয় ৫টা চিঠি লিখে মুচলেকা দিয়ে জেল থেকে ছাড়া পেতে চেয়েছিল, যে সংগঠন ৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরোধিতা করে ইংরেজদের পাশে দাঁড়িয়েছিল, সেই আরএসএস–বিজেপির কাছে মানুষ তেরঙ্গা ঝান্ডা আর দেশপ্রেমের কথা শুনবে? স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের এই বিশ্বাসঘাতকতার কথা ভুলে যাবে? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
গেরস্ত মানুষজন যাঁরা আমিষ খান, তাঁরা ঘরের আঙিনাতে দু চারটে মুরগি পোষেন, ডিম কে ডিম, মাংস কে মাংস হয়ে যায়। আহা রে কত ভালবাসি, সম্মান করি, এসব বলে মুরগি পোষে না গেরস্ত মানুষ। বিজেপির দেশপ্রেম সেই সমগোত্রের, আপাতত অপারেশন সিঁন্দুরকে বেচতে হবে, বিহারে, বাংলাতে, তাই হঠাৎ তেনারা দেশপ্রেমিক হয়ে উঠেছেন, তাই হঠাৎ তেরঙা আর দেশপ্রেমের বাণী প্রচার করার কথা বলছেন। রাবণ সন্ন্যাসী সেজে হাজির হয়েছিল সীতাহরণের জন্য, এনারা দেশপ্রেমিক সেজে তেরঙা কাঁধে নিয়ে আসলে ভোট কুড়োতে বেরিয়েছেন।