ক’দিন আগেই এক রায় এসেছে, আদালতের রায় সর আখোঁ পর, সে রায়েই সাফ বলা হয়েছে অযোগ্যদের মাইনে পাওয়া ফেরাতে হবে। আমরা সেই ছোটবেলায় মাস্টারমশাইয়ের কাছে যোগ্য শব্দের বিপরীত শব্দ জেনেছিলাম অযোগ্য। তো সেই হিসেবে মহামান্য আদালতের হাজার চার কি পাঁচ অযোগ্যদের বাদ দিলে বাকিদের তো আমরা যোগ্যই ভেবেছিলাম, কিন্তু চাকরি গেছে ২৬ হাজারের, অনশন শুরু হয়ে গেছে, অভয়া ধর্ষণ খুনের মামলাতে কিছুই করা গেল না বলে যাঁরা হতাশ ছিলেন, তাঁরা এবারে এই ইস্যুতে রাস্তায়। এই তো এই তো আর একটা ইস্যু পেয়েছি, রাস্তায় পুণ্যব্রত গুণ থেকে অনিকেত মাহাতো, আবার স্লোগান দাবি এক দফা এক মমতার পদত্যাগ। এবং ক’দিন আগেই প্রায় সপ্তাদুয়েক এই বাংলাতেই কাটিয়ে গেছেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের সরসংঘচালক, সে কি এমনি এমনি? বিজেপি আনল ওয়াকফ বিল, প্রত্যেক বিরোধী দল সংসদে অসাধারণ ঐক্য গড়ে তুলেই বিরোধিতা করেছে, সারা দেশের সংখ্যালঘু মানুষজন রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছেন, এক উত্তরপ্রদেশ ছাড়া। ওখানে প্রতিবাদ করলে জেল, জরিমানা আর বুলডোজারে ঘর ভাঙা পড়বে, তাকিয়ে দেখুন সেখানে কোনও প্রতিবাদ নেই, যেটুকু হচ্ছে তাও আনুষ্ঠানিক। কিন্তু ওই দু’ সপ্তাহ কি সরসংঘচালক এমনি এমনিই থাকলেন? একদম না, মুর্শিদাবাদ জ্বলছে, ইতিমধ্যেই বেসরকারি হিসেবে পাঁচজন মানুষ মারা গেছেন, তাঁদের কেউ শ্মশানে, কেউ কবরে। এবং কেউ যদি ভাবেন এখানেই বিষয়টা থামবে তাহলে ভুল করবেন। এ তো সবে শুরু, ২০২৬ পর্যন্ত এই অশান্তি আরও বাড়বে, আরও ছড়াবে। আর সেটাই বিষয় আজকে। আগুন জ্বালাও রাজ্য জুড়ে, বিজেপির ওয়ান পয়েন্ট প্রোগ্রাম।
আদালতের রায় থেকে ওয়াকফ বিলের প্রতিবাদেই কিন্তু ব্যাপারটা থেমে থাকবে না, এটা আজ পরিষ্কার, কারণ এই উন্মত্ত আক্রমণ আর আগুন জ্বালানোর মধ্যেও একটা গ্র্যান্ড প্ল্যান আছে। সেটা হল বাকি জমিটাকে সমান করে নেওয়া, দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে পুরোটাই দখলের এক প্ল্যান। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো সেই শুরুর দিন থেকেই দিল্লির সরকারে মানে ইউনিয়ন গভর্নমেন্টে যে দল থাকে তাদের অনুগামী হয়, অসম থেকে বিজেপিকে সরানো আপাতত প্রায় অসম্ভব। বিহারে যেটুকু সম্ভাবনা ছিল সেই সম্ভাবনাকে মারার জন্য মাঠে প্রশান্ত কিশোর কাজ করছেন, সক্রিয় ইডি, সিবিআই, আবার রাবড়ি, লালু, তেজস্বীকে জেলে যেতে হতে পারে।
আরও পড়ুন: Aajke | রাজ্যজুড়ে দাঙ্গা লাগানোর পরিকল্পনার পিছনে কারা?
ওদিকে গুজরাট, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ ছত্তিশগড়, দিল্লি, উত্তরাখণ্ড, ওড়িশা দখলে আছে। যে কোনওদিন ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা ভাঙা হতে পারে, তৈরি থাকুন কাজ চলছে, হিমাচল প্রদেশে কংগ্রেসের সংখ্যাগরিষ্ঠতা সুতোর ওপরে দাঁড়িয়ে আছে। দিল্লি চলে গেছে বিজেপির দখলে। পাঞ্জাবে আবার অকালি দলের সঙ্গে কথা চলছে, দক্ষিণে এআইডিএমকে-র মতো পঞ্জাবেও আবার বিজেপি অকালি জোট হতেই পারে আর তা হলে আপ কংগ্রেসের লড়াইয়ের মধ্যিখানে সেই জোটের সরকার আসতেই পারে, অন্তত সেই চেষ্টা চলছে। তাহলে এই বিশাল উত্তর ভারতে দৈর্ঘ্যে আর প্রস্থে পুরোটা দখলের অসুবিধেটা কিন্তু একমাত্র এই বাংলা। কিছুতেই তা দখলে আসছে না। জেলে পুরে হয়নি, টাকা না পাঠিয়েও হয়নি, এখানে মহিলা, প্রান্তিক গরিব মানুষ, একটা অংশের মধ্যবিত্ত আর মুসলমানদের এক ভোটব্যাঙ্ক তৃণমূলের পক্ষে থাকায় কিছুতেই এ রাজ্যকে দখল নেওয়া যাচ্ছে না, এটা বিজেপির ইন্টারনাল অ্যাসেসমেন্ট, তাই সেই ভোট ব্যাঙ্ককে ভাঙো। ১) মুসলমান ভোট ব্যাঙ্ক ভাঙার জন্য লাগাতার চেষ্টা চালাচ্ছে কংগ্রেস আর সিপিএম, সেই চেষ্টাতে ধোঁয়া দেওয়ার জন্য ওই বেল্ট জুড়ে দাঙ্গা লাগাও, রাজ্যে মুসলমানরা সুরক্ষিত নয়, মুসলমানদের বোঝাবে কংগ্রেস সিপিএম, হিন্দু খতরে মে হ্যায় বোঝাবে বিজেপি। আর মুসলমান ভোট বেশি নয়, ৫-৬ শতাংশ সরিয়ে দিতে পারলেও কেল্লা ফতে। না, সিপিএম বা কংগ্রেস একটা আসনেও জিতবে না, কিন্তু অবশ্যই বিজেপিকে জিতিয়ে দিতে সাহায্য করবে। আর একবার বিজেপি এসে গেলে? ওই মুসলমানেরা অবাক হয়ে দেখবেন, বিক্ষোভ দেখানো তো দূরস্থান, হাতে কালো ব্যাজ পরেছে বলে আদালতের সমন হাজির হচ্ছে, যা হয়েছে উত্তরপ্রদেশে। ২) রাজ্যের ৫-৬ শতাংশ মানুষ সরকারি চাকরি করেন, তারমধ্যে শতাংশের হিসেবেও আসবে না ২৬ হাজার চাকরি, কিন্তু এ রাজ্যে যে চাকরি বিক্রি হচ্ছে, চাকরি নেই, চাকরি খেয়ে নেওয়া হচ্ছে, সব চাকরি এখন বেঙ্গালুরু বা গুরগাঁওতে, চাকরি এখন হায়দরাবাদে, এই বাংলার কিছুই হবে না, হ্যাঁ এই প্রচারের দায়িত্বে আছে মেইন স্ট্রিম মিডিয়া, আছে জেলফেরত ইউটিউবার থেকে আরামবাগ চিকেন মিডিয়া, আর তাই কী অসাধারণ প্রগাঢ় জ্ঞান আর হাসিমুখ নিয়ে ব্রাত্য বসুকে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়ানোর আগে ভুলেই যান যে গত পাঁচ বছরে ওই আনন্দবাজার নামক গোষ্ঠিতে এক দিনের নোটিসে কত ছাঁটাই হয়েছে, ভুলে যান যে এক দিনের নোটিসে টাইমস গ্রুপের এই সময়ে কতজনকে ছাঁটাই করা হয়েছিল? যোগ্য অযোগ্যের প্রশ্নই নেই, যে সাংবাদিকেরা সাক্ষাৎকার নেওয়ার নামে ধ্যাষ্টামি করছিলেন, তাঁরা একবারও তাঁদের নিজেদের সহকর্মীদের মাস স্কেল ছাঁটাই নিয়ে একটা কথাও বলেছেন। বলার ধক আছে নাকি তখন যখন উইপ্রোতে, আইটি সেক্টরে আগাম নোটিস দিয়ে এক লপ্তে ১৩ হাজার মানুষের চাকরি যায়? ছেড়েই দিলাম অসংগঠিত ক্ষেত্র, সেখানকার চাকরি নিয়ে কথা বলবেন, তাদের মাইনে নিয়ে কথা বলবেন সে সংবেদনশীলতা আমাদের মেইন স্ট্রিম মিডিয়া কবেই হারিয়েছে। তাহলে এই ২৬ হাজার নিয়ে, রাজ্যের চাকরি নিয়ে এত আলোচনা কেন? কারণ মধ্যবিত্তের যে অংশ এখনও আছে, এখনও মমতাকে সমর্থন করে, তাদের ভাঙাও। তাঁদেরও কিছু মানুষ যেন ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে লেখেন ছিঃ। হ্যাঁ এটাই পরিকল্পনা, বেশি নয় ৪-৫ শতাংশ ভোট কাটতে হবে। তার জন্য নতুন নতুন ইউটিউবার গজাবে, নিরপেক্ষতার নামে আসলে এই গ্র্যান্ড প্ল্যানের অংশ নিয়েই তাঁরা কাজ করবেন, আর গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সেই বিষবার্তা, হিন্দু খতরে মে হ্যায়, মুসলমান খতরে মে হ্যায়। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, ২০২৬-এর ভোট যত কাছে আসছে, ততই বিভিন্ন ইস্যুতে উত্তাল হচ্ছে বাংলা, এটা কি একটা বড় পরিকল্পনার অঙ্গ? যে পরিকল্পনার আসল লক্ষ্য হল বাংলা জুড়ে আগুন জ্বালাও, বাংলাকে অশান্ত করে তোলো? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
সংসদীয় গণতন্ত্রে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দল, তাদের সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করবে, এটাই তো স্বাভাবিক, তাঁরা ইস্যু তুলবেন, বিক্ষোভ সমাবেশ করবেন, মিছিল মিটিং করবেন, এ তো আমরা দেখেছি। কিন্তু এই প্রথম একটা দল রাষ্ট্রের প্রতিটা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে কাজে লাগিয়ে এক চূড়ান্ত সাম্প্রদায়িক প্রচার করে দেশের দখল নিতে চায়, তারা সেই পরিকল্পনামাফিক বাংলা দখলের প্রোগ্রাম নিয়ে মাঠে নেমেছে, কাজেই আমাদের বুঝে নিতে হবে যে ২০২৬-এর নির্বাচন যত কাছে আসবে, তত বেশি করে এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামা বাড়বে, সারা রাজ্য জ্বলবে সেই আগুনে। এখন থেকে সাবধান না হলে বিপদ বাড়বে, তাই এই কথাগুলো বলে গেলাম।