সেদিন আনন্দবাজার লিখেছিল বাম বিদায়. আজকাল, তখনও প্রবল সিপিএম-পন্থী তারা লিখেছিল ক্ষমতায় মমতা। একদিন-এর হেডলাইন ছিল মমতার বাম বধ। বর্তমান লিখেছিল, বাংলা মমতার আর প্রতিদিন লিখেছিল, বাংলা মমতারই। হ্যাঁ, সেই ২০০৯-এর পরে দেওয়ালে দেওয়ালে অদৃশ্য বর্ণমালায় বাংলার ভবিষ্যৎ লেখা হয়ে গিয়েছিল, কিছু এগিয়ে থাকা অবোধ আর সিপিএম কর্মী ছাড়া কারও কোনও সন্দেহ ছিল কি? ছিল না। আমরাই এই কলকাতা টিভিতে ১২ মে জানিয়েছিলাম তৃণমূল জোট ২২৫ পার করবে অনায়াসে, তৃণমূল জোট পেয়েছিল ২২৭। আমরাই জোর গলায় বলেছিলাম যাদবপুরে বুদ্ধ ভট্টাচার্য হারবেন, হেরেছিলেন প্রায় ১৬ হাজার ভোটে। এক নিরবচ্ছিন্ন ৩৪ বছরের বাম শাসনের পরে অনেকের কাছে, বিশেষ করে সিপিএম নেতা কর্মীদের কাছে এ ছিল এক বিস্ময়। আমার পরিচিত একজন সিনিয়র সাংবাদিক বলেছিলেন, আগের দিনে এক নামকরা ছাত্র নেতা বলেছিলেন বামফ্রন্ট একটা হলেও বেশি আসন পাবে। গৌতম দেব, সিপিএম-এর প্রাগম্যাটিক নেতা বলে শোনা যায়, তিনি বলেছিলেন ক্ষমতায় আমরাই আসছি, দু’ চারটে আসন কম হতে পারে। মানব মুখার্জি বলেছিলেন, বাংলার মানুষের রাজনৈতিক চেতনার স্তর এখনও ততখানি নিম্নমানের নয়, যাতে করে মমতা ব্যানার্জি ক্ষমতায় আসতে পারেন। নির্বাচনের পরে ফলাফল আসার আগে গণশক্তি লিখেছিল মানুষের চেতনা আনবে অষ্টম বাম সরকারকে। তারপর আজকের দিনটা এল, ১৩ মে ফলাফল বের হওয়ার পরে জানা গিয়েছিল ২৭ জন মন্ত্রী হেরেছেন, সাধের সিঙ্গুর খোয়া গেছে। সেটাই বিষয় আজকে, ১৩ মে, ২০১১, মমতা-ঝড় দেখেছিল বাংলা।
কেন এই স্মৃতি রোমন্থন? দুটো জিনিস আলোচনার করার জন্য ওই সময়ের ইতিহাসে যাওয়াটা বড্ড জরুরি। প্রথম হল সেদিন বামফ্রন্ট, সিপিএম-এর এই বিরাট পরাজয় কেন হয়েছিল? আর স্বাভাবিক প্রশ্ন তৃণমূলের জয়ের পিছনে কারণগুলোই বা কী? সেটা আলোচনা করলে বোঝা যাবে যে সেদিনের জয়ের পর আজ পর্যন্ত কেন সিপিএম-এর রক্তক্ষরণ থামছেই না আর কেন মমতা তৃণমূলের ভোট ধরে কেবল রেখেছেন তাই নয়, কিছুটা হলেও বাড়িয়েছেন।
আরও পড়ুন: Aajke | যুদ্ধ শেষ, এবার পাকিস্তানে বন্দি বাংলার ছেলেকে ঘরে ফেরান
২০১১ সাল থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের ভোট শতাংশ ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ৩৮.৯৩ শতাংশ থেকে ২০২১ সালে ৪৮.০২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। লোকসভা নির্বাচনে ২০১৪ সালে ৩৯.৮ শতাংশ থেকে ২০২৪ সালে ৪৫.৭৬ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। অন্যদিকে সিপিএমের ভোট শতাংশ ক্রমশ কমেছে। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ৩০.০৮ শতাংশ থেকে ২০২১ সালে ৪.৭৩ শতাংশে নেমে এসেছে। লোকসভা নির্বাচনে ২০১৪ সালে ২৩.০ শতাংশ থেকে ২০২৪ সালে ৫.৭৩ শতাংশে নেমে এসেছে। সিপিএম রাজ্যের গরিব মানুষ, প্রান্তিক চাষি, সংখ্যালঘু মানুষজনের এক বিপুল সমর্থন চিরটাকাল পেয়ে এসেছে। ইন ফ্যাক্ট সিপিএম-এর কর্মসূচিতে বলাই আছে যে তারা একটা রাজ্যের নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসতে চায় আর তার একমাত্র উদ্দেশ্য হল রাজ্যের গরিবস্য গরিব মানুষের ন্যূনতম রিলিফ দেওয়ার মাধ্যমে এক রক সলিড কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলা, যারা আগামী দিনে এই মডেলকে সামনে রেখেই সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে এবং রাষ্ট্রক্ষমতার দখল নেবে। কাজেই হাজার একটা আন্দোলনেও তাদের এই গরিব প্রান্তিক মানুষ, সংখ্যালঘু গরিব মানুষের ভোট তাদের পাশেই থেকেছে, তারাও ক্ষমতা ধরে রেখেছিল। কিন্তু হঠাৎ সিপিএম খুব দ্রুত এক মধ্যবিত্তদের পার্টি হয়ে উঠছিল, মধ্যবিত্ত মানুষজনের দাবিগুলো তাদের সামনে উঠে আসছিল, তারা শিল্পায়ন, চাকরি ইত্যাদির প্রচলিত মডেলকেই আঁকড়ে ধরলেন আর তারপরেই সেই সিঙ্গুরের জমি অধিগ্রহণ, নন্দীগ্রামের জমি অধিগ্রহণের প্রাথমিক প্রস্তাব, এসবের ফলে দরিদ্র কৃষকেরা মনে করলেন তাঁদের জমি চলে যাবে, সংখ্যালঘু মানুষজন ভাবলেন তাঁদের জমি কেড়ে নেবে সরকার। এই ধারণাই ছিল মূল কারণ যার ফলে সিপিএম-এর ভোট হু হু করে কমে, তারা হারে। আর তারপরে নরেন্দ্র মোদির সরকার আসে ২০১৪-তে। মমতা ব্যানার্জি খুব দ্রুত তাঁর আগের ঘোষিত শত্রু সিপিএম-এর থেকেও বিজেপিকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেন। বিজেপি হিন্দু ভোটের এক অংশ আর মমতা বিরোধী ভোটের দখল নেয়, অন্যদিকে তৃণমূল হিন্দু ভোটের উদার অংশ, বিজেপি বিরোধী ভোটের বিরাট অংশ আর প্রায় সমস্ত সংখ্যালঘু ভোটের সমর্থন পেতে থাকে। ইন ফ্যাক্ট সিপিএম-এর ভোটের জমিটাই হারিয়ে গেছে, তাদের তীব্র মমতা বিরোধিতার যাবতীয় ফসল উঠছে বিজেপির ঘরে, আর বিজেপির যাবতীয় বিরোধিতার ফসল যাচ্ছে তৃণমূলের গোলায়। এক বাইনারি তৈরি হয়ে গেছে এই বাংলায়, হয় বিজেপি নয় তৃণমূল। এই বাইনারির মধ্যে নাকানি চোবানি খেতে খেতে বামেরা আপাতত শূন্য। সেই শূন্যের যাত্রা শুরু হয়েছিল আজ ১৩ মে, ২০১১-তে, তার থেকে মুক্তি খুব সহজে মিলবে বলে মনে হয় না। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, সেই ২০১১ থেকে তৃণমূল দল কোন ম্যাজিকে, কোন অঙ্কে এখনও তাদের ভোট শতাংশ কেবল ধরে রাখেনি, বাড়িয়েছে? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
কমিউনিস্টরা কি জানেন? গীতায় শ্রীকৃষ্ণ ৩য় অধ্যায়ের ৩৫শ শ্লোকে বলছেন,
শ্রেয়ান্ স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ।
স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ॥
স্বধর্মে মৃত্যুও শ্রেয়, নিজের ধর্মে থেকে মারা যাওয়াটাও ভালো। সেদিন তথাকথিত কমিউনিস্টরা গরিব, তস্য গরিব নয়, সারা দুনিয়ার চলতি পুঁজিবাদী মডেলে উন্নয়ন আর বিকাশের চক্করে পড়ে সব হারিয়েছেন, মানুষের বিশ্বাস হারিয়েছেন। গরিবদের পাশে থেকে মারা গেলেও এমন নিশ্চিহ্ন হতে হত না, আর সেই কথাটাই মমতা বুঝেছেন, তিনি যেভাবে হোক সমাজের সবচেয়ে গরিব অংশের কাছে যতটা সম্ভব সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন আর সেটাই তাঁর সমর্থন বৃত্তকে রোজ আরও মজবুত করেছে।