রাজ্য বিজেপি নেতারা পয়লা বৈশাখে রাস্তায়, দিলু ঘোষ সম্ভবত জীবনে এই প্রথম। পরিষ্কার করে বাংলাই বলতে পারেন না আর খুব সাফ জানিয়ে দেন হিন্দুদের কিছু রক্ত ঝরুক, লাশ পড়ুক, তারপরেই হিন্দু উত্থান সম্ভব। ওদিকে মেদিনীপুরের খোকাবাবু, বাঙালি বলতেই হিন্দুই বোঝেন, সাফ জানিয়েই দিয়েছেন যে ওনার মুসলমান ভোটের দরকারই নেই, রাজ্যের প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষের সমর্থন ছাড়াই উনি মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার খোয়াব দেখেন। ওদিকে আছেন রুদ্রনীল ঘোষ, যাঁরা বাংলাতে কনট্রিবিউশন বলতে ঢিলের সঙ্গে কিল, আমের সঙ্গে জাম মার্কা কিছু নিম্নমানের ছড়া। সেই তাঁরা পয়লা বৈশাখ উদযাপন করে বাঙালি হওয়ার চেষ্টা করছেন। কেন? সেই ব্যাখ্যায় পরে আসব কিন্তু চেষ্টা যে করছেন তার উদাহরণ তো আমাদের সামনেই পরিষ্কার, হাত ধরাধরি করে হেঁটেছেন, শুভ একলা বৈশাখ বলেছেন তাঁদের সমাজ মাধ্যমে। তাঁদের একজনেরও জানাই নেই যে মোগল আমলে ইসলামিক হিজরি বর্ষপঞ্জি অনুসারে বাঙালিদের থেকে খাজনা আদায় করা হত। সেই বর্ষপঞ্জি ছিল একটি চান্দ্র বর্ষপঞ্জি, আর তাই সৌর কৃষিচক্রের সঙ্গে সেই বর্ষপঞ্জির কোনও সমন্বয় ছিল না। কোনও কোনও মতে, খাজনা দেওয়ার সময়ে উৎসবের আয়োজন করার রীতি মোগল সম্রাট আকবরেরই তৈরি, আর তখন থেকেই বাংলা বছরকে বঙ্গাব্দ বলা শুরু হয়। আকবর রাজজ্যোতিষী ফতুল্লাহ শিরজিকে চান্দ্র ইসলামিক বর্ষপঞ্জি এবং সৌর হিন্দু বর্ষপঞ্জির সমন্বয় ঘটিয়ে এক বর্ষপঞ্জি তৈরি করতে বলেন। ঐতিহাসিকের মতে, এখান থেকেই বাংলা বর্ষপঞ্জির সূচনা। কে বলছেন এই কথাগুলো? বলছেন অমর্ত্য সেন, বলছেন বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও বিড়লা প্ল্যানেটেরিয়ামের প্রাক্তন কিউরেটর ডঃ রমাতোষ সরকার। এসব অবশ্য বিজেপি মানে না। না, ওরা ইতিহাসের ধার ধারে না, ওরা যুক্তির ধার ধারে না, আমাদের ছোটবেলায় পোড়ারমুখো হনুমান ওদের উপাস্য দেবতা, আমাদের উৎসবে আনন্দে মাছ, মাংস, হাঁসের ডিমের ডেভিল, ওদের নবরাত্রিতে মাছের দোকান বন্ধ রাখার ফতোয়া, দিল্লি থেকে নেতারা এলে চাপাটি দিয়ে আলু পোস্ত খাওয়ানো। সেটাই আমাদের বিষয় আজকে রেখেছ ‘বিজেপি’ করে মাগো, বাঙালি করোনি।
হঠাৎ কাকের সাধ হল ময়ূর সাজিবার, তো ময়ূরের পালক খুঁজে এনে পিছনে গুঁজে সে খানিক ময়ূর ময়ূর হল বটে কিন্তু মুখ খুললেই কা কা। বঙ্গ বিজেপির হাল এক্কেবারে তাই। গোবলয়ে বিজেপির কোনও চাপ নেই, প্রতিবাদী মুসলমান ব্যাপারটা এখন ওই জাভেদ আখতার বা উমর খালিদ ইত্যাদির মধ্যেই আপাতত সীমাবদ্ধ। কেবল কালো ব্যাজ পরেছেন বলেই আদালতে ডেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, কাজেই প্রতিবাদ আপাতত গুমরে ওঠা কান্না। কাজেই গোবলয়ে বিজেপি আমিষ দোকান রেস্তরাঁ, মাছের বাজার ভাঙতে পারে, অনায়াসে তাঁদের হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্থানের স্লোগান দিতেই পারে। কিন্তু এই বাংলাতে তাঁদের অস্বস্তি থেকেই যাবে, ঐতিহাসিক কারণেই। তাঁরা না পারছেন ফুল ফ্লেজেড বিজেপি হতে, না পারছেন বাঙালি হতে।
আরও পড়ুন: Aajke | আগুন জ্বালাও রাজ্য জুড়ে, বিজেপির ওয়ান পয়েন্ট প্রোগ্রাম
খবরে প্রকাশ আমাদের কাঁথির খোকাবাবু বর্গভীমার মন্দিরে গিয়েছিলেন, হাল খাতা দিতে নয় বাংলার হাল ফেরাতে, সেই তিনিও নিশ্চিত দেখে এসেছেন মন্দিরের প্রসাদে শোলমাছ, সেই প্রসাদের কথা দলের মাথার লোকেদের বলতে পারবেন? পারবেন না। ওনাদের পোস্টের নাম হল মণ্ডল প্রভারী, সরসংঘচালক, বরিষ্ঠ কারিয়াকর্তা, ক্ষেত্রীয় প্রভারী, পন্না প্রভারী ইত্যাদি ইত্যাদি। ওনাদের সভায় বক্তাদের ডাকা হয় যেভাবে তা শুনলে হাসিই পাবে, এবারে মঞ্চে উপস্থিত হবেন যশস্বী নেতা হিন্দু হৃদয় সম্রাট যশস্বী নেতা বিরোধী পক্ষ শ্রী শুভেন্দু অধিকারী মহাশয়। প্রত্যেকটা শব্দ, বাক্য গঠন দিল্লিতে বসে শেখানো। এখনও বিজেপি দফতরে কোনও খুশির খবর এলে, মানে এ রাজ্য থেকে তো আসে না, অন্য রাজ্যে জয়ের খবর এলে লাড্ডু বিতরণ হয়। সম্মেলনে শুদ্ধ শাকাহারী ভোজনের ব্যবস্থা আছে বলে জানানো হয়। সেই দল হঠাৎ বাঙালি হওয়ার চেষ্টা করছে, কাজেই একটু বেশি চাপ পড়েছে দলের সাংস্কৃতিক শাখার উপরে যে শাখার দায়িত্বে আছেন চোখে আঙুল দাদা রুদ্রনীল ঘোষ। তো সেই তিনি বলেছেন যে বিজেপি তো আদতে বাঙালিই, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি থেকে মোটামুটি ঢিলছোড়া দূরত্বে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি। অর্থাৎ, তৃণমূলনেত্রীর ভবানীপুরের মাটি থেকেই জনসঙ্ঘের ভাবনার উৎপত্তি। যে জনসঙ্ঘ পরে বিজেপি হয়েছে।’’ বার চার পাঁচেক দল বদল করা এই রুদ্রনীল জানেন না, জানার কথাও নয় যে আমাদের জাতীয় নায়ক নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ঐ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন তাঁদেরওই ওই ত্রিশূল নিয়ে রাজনীতি তিনি বরদাস্ত করবেন না, তাঁদের সাম্প্রদায়িক বজ্জাতি মেনে নেবেন না, তিনিই সার্কুলার দিয়ে জানিয়েছিলেন কংগ্রেস করলে আরএসএস বা মুসলিম লিগের সদস্য হওয়া যাবে না এবং তাঁরই নির্দেশে ওই শ্যামাপ্রসাদের সাম্প্রদায়িক অশান্তি পাকানোর সভা ভন্ডুল করা হয়েছিল আর শ্যামাপ্রসাদের মাথা ফেটেছিল। হ্যাঁ এটাই বাংলা। সেই বাংলায় বাঙালি হওয়ার প্রথম শর্ত নেতাজিকে সম্মান জানানো, শর্ত রামকৃষ্ণদেবের যত মত তত পথের শরিক হওয়া, বিবেকানন্দের সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথা বলা, রবি ঠাকুর, নজরুলের উদার মানবিকতাবাদের পথে চলা এবং হ্যাঁ বাঙালি হওয়া, হয়ে ওঠা। যা বিজেপির পক্ষে আজ নয়, কোনওদিনও হয়ে ওঠা সম্ভব নয়। আমরা আমাদের দর্শকদের প্রশ্ন করেছিলাম, এই বাংলায় বিজেপি এখনও পুরোপুরি বাঙালি হয়ে উঠতে পারল না, বরং তাদের বহু কাজ কারবার সাফ বলে দেয় তাঁরা বাঙালি বিরোধী। সেই কারণেই কি এই বাংলাতে বিজেপি পিছিয়ে পড়ছে? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
একদিকে সারা রাজ্যে এক ধরনের বাংলা, বাঙালি হাওয়া ক্রমশ প্রবল হয়ে উঠছে, বাঙালি কোথাও তার নিজের সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস আর তার উদার ধর্মনিরপেক্ষ দর্শন নিয়ে আলোচনা করছে, সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিজেপির প্রবল কেন্দ্রীয় আধিপত্যবাদের পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবেই যে আঞ্চলিকতাবাদের জন্ম হয়েছে, তা এই বাংলাতেও ছড়াচ্ছে। মহারাষ্ট্রে মারাঠা না বললে যদি থাপ্পড় মারা হয়, তাহলে এই রাজ্যের মেট্রো রেলের কর্মী কেন বাঙালিদের অপমান করার সাহস পায়? এ ধরনের কথাবার্তা সমাজমাধ্যমে ছড়াচ্ছে। এসব কি চোখে পড়েনি বিজেপির এই নেতাদের? পড়েছে বইকী, আর তাই তাঁরা ওই ময়ুরের পালক পিছনে গুঁজে ময়ূর হওয়ার চেষ্টা করছেন, সে চেষ্টা হাস্যকর হয়ে উঠছে প্রতিদিন, কারণ বিজেপি গলা ছাড়লেই কা কা কা কা বের হচ্ছে, আসল রং রূপ ধরা পড়ে যাচ্ছে, বিজেপি বাঙালি বিরোধী, তাদের পক্ষে বাঙালি হওয়াটা সম্ভব নয়।