‘Politics makes strange bedfellows’, রাজনীতিতে কে যে কোনদিকে যাবে, কে যে কোন তরীতে ওঠার জন্য সর্বস্য বাজী রেখে দেবে, তা বলা খুব কঠিন। তাই এই কথাটা সেই মধ্য উনিশ দশক থেকেই বারবার ব্যবহার হয়েছে, ‘Politics makes strange bedfellows’, ভেবেছিলেন নাকি গুষ্টিশুদ্ধু তৃণমূলের এমপি, এমএলএ, মন্ত্রী, সেই শান্তিকুঞ্জ থেকে বের হবেন তৃণমূল সরকারের বিরোধী দলনেতা। আজন্ম ইস্তক যাঁরা শুনেছেন, বলতে বলতে বড় হয়েছেন, লাল-নীল-কালো সুতো কংগ্রেসকে মারো জুতো, সেই তাঁরাই কমিউনিস্ট পার্টি সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থীর জন্য হেদিয়ে মরছেন। ভেবেছিলেন নাকি, দু’চোখ ছল ছল করে উঠত, উনি আমার মা, প্রকাশ্যেই বলার পরে নীল বাত্তিওয়ালা রুদ্রনীল ঘোষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ডাইনি বলতে পারে? হ্যাঁ, রাজনীতিতে সব হয়। শিশুসুলভ বিশৃঙ্খলাই কেবল নয় সিআইএ-র দালাল চারু মজুমদারের ছবির সামনে সিপিএমএর সর্বোচ্চ নেতা, ভেবেছিলেন কখনও? হয়েছে। সেরকম এক ছবি দেখা গেল গতকাল। মেঘভাঙা বৃষ্টিতে জল জমেছিল মহানগর জুড়ে, সেই শহরে জল নামতে শুরু করেছে। ওদিকে জল শোভন, তাঁর বান্ধবী সমেত চলে গেলেন ক্যামাক স্ট্রিটে, নিশ্চয়ই যুবরাজকে পুজোর আগে শারদীয়া শুভনন্দন জানাতে যাননি। এক মহানাগরিক যখন গলা জলে, তখন প্রাক্তন মহানাগরিকের তৃণমূলের দু’নম্বর নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎকার তো এমনি এমনি নয়। আবার কি জল শোভনের প্রত্যাবর্তন? সেটাই বিষয় আজকে কলকাতায় জল জমল। জল শোভন ঘরে ফিরল?
তৃণমূল দলের মাথায় মমতা, তিনিই সব, তিনিই সিদ্ধান্ত নেন, তিনিইই শেষকথা। কিন্তু তৃণমূলে দু’জন এক্কেবারে শুরুর থেকে মমতার সঙ্গে কেবল নয়, তাঁদের বুদ্ধি দলের কাজে লেগেছে, বহু অসময় এই দুজনে পার করেছেন, আবার এনারাই বিজেপির মারের থেকে বাঁচিয়ে নিয়েছেন নিজেদেরকে। হ্যাঁ, পার্থ বা বাকিদের মতো এনাদের জেলে পচতে হয়নি। প্রথমজন হলেন মুকুল রায়, সব্বাই জানেন ওনার সারদা থেকে শুরু করে যাবতীয় অর্থ যোগানে ব্যবস্থার সঙ্গে যোগাযোগ। দ্বিতীয়জন হলেন শোভন চ্যাটার্জি, মানে জল শোভন। হ্যাঁ, এককালে বন্ধ ফ্যাক্টরির তামার তার বেচে সিনেমা দেখনেবালা শোভনের টয়লেটে জাকুজি, যাঁরা মানে জানেন না তাঁদের জানাই বাথটবে ঘুর্নি ওঠে, ঢেউয়ের মতো, গরম ঠান্ডা তো আছেই, তার নাম জাকুজি। তারপরে গ্যারাজে দেশি বিদেশি পেল্লাই পেল্লাই গাড়ি এবং অবশ্যই বিভিন্ন সূত্রে টাকা আদায়ের অভিযোগের পরেও এই দু’জনেই একবার করে টুক করে বিজেপির ছায়া মাড়িয়ে, নিজেদের নিষ্কলঙ্ক করে তারপরে ‘বনে রহো পাগলা’ বলেই বসেছিলেন। এবং এখনও যে এঁরা কোন দলে তা কিন্তু পাবলিকের জানাও নেই। কিন্তু ওনারা মাঝে মধ্যেই কালীঘাট, ক্যামাক স্ট্রিট করে দু’দিক সামাল দিয়েই রেখেছেন। এখন মুকুল রায় সত্যিই অসুস্থ, কিন্তু জল শোভন ফিট অ্যান্ড ফাইন, ‘সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে’, দেখে নিতে পারেন ইন্টারনেটে অ্যাভেলেবল। সেই জল শোভন এবং বৈশাখী ক্যামাক স্ট্রিটে, কাজেই মুখে মুখে গুজব। কাম ব্যাক অফ জল শোভন। বৈশাখি তো উপগ্রহ, উনি সেই অর্থে উপগ্রহের উপগ্রহ। কাজেই ওনাকে নিয়ে কিছু বলার মানেই হয় না, কিন্তু জল শোভন? একটা দলে থেকে সেই দল ছেড়ে, দিল্লিতে গিয়ে অমিত শাহের হাত ধরে বিজেপিতে জয়েন করে, ফিরে এসে কিছুদিন বসে থেকেই দলে ফিরে আসবেন? এবং এমন তো নয় যে উনি দলে ফিরে এসে পোস্টার লাগাবেন? উনি তো নেতা, নেতাই হবেন। সেও খুব নকড়া ছকড়া হয়ে থাকার শর্তে তো নয়, উনি ফিরলে হোমড়া চোমড়া হয়েই ফিরবেন।
আরও পড়ুন: Aajke | মমতা–৩০০০, অমিত শাহ–০৩
বিভিন্ন জেলার প্রান্তিক অঞ্চলে বসে থাকা কর্মীদের কাছে কোন মেসেজটা যাবে? যদি উনি ফিরেই আসেন, তাহলে সেটা কি তলার সারির লড়ে যাওয়া, জান বাজি রেখে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়া ক্যাডারদের কাছে খুব অনুপ্রেরনাদায়ক কিছু হবে? দুর্নীতির সমস্ত অভিযোগ সারা দেহে মাখানো তো আছেই, সামাজিক বিভিন্ন প্রশ্নেও খুব উঁচু মানের তো নয়, তেমন একজনকে দলে ফিরিয়ে কোন দৃষ্টান্ত তৈরি করতে চান তৃণমূল সেকেন্ড ইন কমান্ড? যারা ৩৬৫ দিন জমির সঙ্গে নিজেকে জুড়ে লড়ছে, মার খাচ্ছে, মারছে, প্রতিদিন লড়ছে, সেই তৃণমূল স্তরের কর্মীদের একজনও কি এই প্রত্যাবর্তন মেনে নেবেন? কোনও সমীক্ষার দরকার নেই, একজনও মেনে নেবেন না। প্রশ্ন থেকেই যাবে কেন ফিরছেন উনি? কেন ফিরলেন উনি? আমরা আমাদের দর্শকদের প্রশ্ন করেছিলাম, তৃণমূল স্তরের কর্মীরা যখন দেখেন দলবদলু নেতারা, সারা গায়ে দুর্নীতির পাঁক মাখা নেতারা, নৈতিকভাবে অধঃপতিত নেতারা আবার সগৌরবে দলে ফিরে আসেন, তখন তাঁদের কেমন মনে হয়? তাঁরা কি হতাশ হয়ে পড়েন না?
এমনিতে ভারতীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের, সর্বোচ্চ নেতাদের নৈতিক অধঃপতন, আর্থিক দুর্নীতি ইত্যাদি নিয়ে নতুন করে কিছু বলার মানেই হয় না। কারণ এখন তো মানুষজন ধীরে ধীরে এটাই বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন যে, নেতারা তো ওরকমই হবেন, নেতারা তো দুর্নীতি করবেন। সিএসডিএস-এর এক সমীক্ষায় বলা হয়েছিল যে গরিষ্ঠাংশ মানুষ, প্রায় ৭৪ শতাংশ মানুষ দুর্নীতিকে বড় ইস্যু বলেই মনে করেন না। তার কারণ কিন্তু রাজনৈতিক দলের মধ্যে সেই সমস্ত মানুষজনদের ক্রমশ বাড়তে থাকা ভীড়। সারা দেশের চেহারার সঙ্গে খাপ খাইয়েই রাজ্যের রাজনৈতি ছবিও আলাদা কিছু নয়, কাজেই বলতেই হবে, ভাই? এ ভাই… কী ভাই? শুনেছিস, জমা জল নেমে গেল, হ্যাঁ কিন্তু তাতে কি এল গেল? না কিচ্ছু না, জল সরতেই দ্যাখনা রে ভাই জল শোভন ফিরে এল। এরপরেই মিউজিকটা আপনারাই বাজান বা ঐ অনির্বাণকে বাজাতে বলুন।