অভিশপ্ত এম আই-১৭ ভি ৫ কপ্টারের ব্ল্যাক-বক্স পাওয়া গেছে। এই ‘দুর্ঘটনা’ নিয়ে রহস্য কিন্তু আরও ঘনীভূত হচ্ছে। দেশের প্রথম চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ,জেনারেল বিপিন রাওয়াতের মৃত্যু, সেটা কি স্রেফ দুর্ঘটনা, নাকি এর পেছনে আছে গভীর ষড়যন্ত্র? এই জল্পনা-কল্পনা থামাবে কে? বৃহস্পতিবার সেনা-সূত্রে দাবি করা হয়েছিল যে, চপারে কোনও যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল না। জেনারেল রাওয়াতকে নিয়ে ওড়ার আগে, অন্তত তিনবার পরীক্ষা করা হয়েছিল অত্যাধুনিক রুশ কপ্টারটিকে। যদি কপ্টারে যান্ত্রিক ত্রুটি না থেকে থাকে তাহলে কি কোনও নাশকতার সম্ভাবনাআছে? রাজনাথ সিংহ, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হিসেবে বলেছেন, এয়ার মার্শাল মানবেন্দ্র সিংহের নেতৃত্বে তিন বাহিনীর যৌথ তদন্ত শুরু হয়ে গেছে। নীলগিরি পর্বতের ফাঁকে, কপ্টারটি কেন আচমকা দিশেহারা হয়ে পড়ল? সেই দ্বন্দ্ব, তদন্তে কাটবে কিনা, তার উত্তর পাওয়া যাবে আগামী সময়ে।
#WATCH | Final moments of Mi-17 chopper carrying CDS Bipin Rawat and 13 others before it crashed near Coonoor, Tamil Nadu yesterday
(Video Source: Locals present near accident spot) pic.twitter.com/jzdf0lGU5L
— ANI (@ANI) December 9, 2021
দুর্ঘটনাটি কীভাবে হয়েছিল, কেন হয়েছিল— তার তদন্ত রিপোর্ট আসার আগেই জল্পনা-কল্পনা করা, গুজব উস্কে দেওয়াটাকে আমি মনে করি অন্যায়। আর সাংবাদিক হিসেবে সেটা আমার কাজ নয়। কিন্তু কতগুলো প্রশ্ন তো ওঠেই! যেমন, জেনারেল বিপিন রাওয়াতের যে মৃত্যু হল, তার জন্য কোনও না কোনও একটা মানবিক ত্রুটি তো আছে। শুধুমাত্র পাহাড় আর সবুজ জঙ্গল, তাতে ঠোক্কর খাওয়ার জন্য পাহাড় আর উদ্ভিদকেই কি শুধু দায়ী করা উচিত, নাকি কোথাও কোনও গাফিলতি ছিল? ভবিষ্যতে যাতে এই ধরনের ঘটনা এড়ানো যায়, তার জন্য বোধহয় কিছু প্রশ্ন উত্থাপিত করাটা অন্যায় নয়।
প্রয়াত বিপিন রাওয়াত খুব ঠোঁট কাটা মানুষ ছিলেন। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, সম্প্রতি চিন যখন ভারতের মধ্যে তাদের সেনাবাহিনীর অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছিল, সেইসময় জেনারেল রাওয়াত-ই নানান মন্তব্য করে বিতর্কের ঝড় তুলেছিলেন। চিন যখন ভারতের সঙ্গে মৈত্রীর ব্যাপারে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছিল, নরেন্দ্র মোদী এবং চিনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক কথাবার্তা শুরু হয়ে গিয়েছিল, সেইসময় জেনারেল রাওয়াত বলেছিলেন, চিনের মতলব ভালো নয়। চিন ভারতের মধ্যে ঢুকে পড়ে এক ধরনের ‘সালামি অপারেশন’ করছে। আর তার বদলা নিতে আমাদের দ্বৈত যুদ্ধ করতে হবে। একদিকে আমাদের যেমন পাকিস্তান সীমান্তে প্রস্তুত থাকতে হবে, আর এক দিকে চিন সীমান্তেও প্রস্তুত থাকতে হবে। কেননা, এবার লড়াইটা শুধু পাকিস্তানের সঙ্গে নয়, শুধু চিনের সীমান্তে নয়। এবারে চিন এবং পাকিস্তান একত্রিত হয়ে ভারতের বিরুদ্ধে লড়বে। –এই মন্তব্য করে জেনারেল রাওয়াত রীতিমতো সরকারিভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।
ভারতের প্রতিরক্ষা বাহিনীর এই শীর্ষতম ব্যক্তির আকস্মিক মৃত্যুর ঘটনা গোটা দেশের জন্যই একটা বড়সড় ধাক্কা। জেনারেল বিপিন রাওয়াত তো শুধুমাত্র সর্বোচ্চ পদেই অধিষ্ঠিত ছিলেন না, তিনি ছিলেন দেশের প্রথম চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ, যাকে বলা হয় সিডিএস। তার মানে, তিনি দেশের সামরিক বিভাগের দায়িত্ব বহন করতেন এবং প্রধান উপদেষ্টার ভূমিকাও তিনি পালন করতেন।
হেলিকপ্টার ভেঙে পড়ে এবং আরও এগারো জনের সঙ্গে তাঁর সস্ত্রীক মৃত্যু হয়। এক অভাবনীয় দুর্ঘটনার মধ্যে পড়েছিল তাঁদের বায়ুযানটি। দুর্ঘটনা কেন ঘটলো, কীভাবে ঘটলো— এ সমস্ত এখনও সাধারণ মানুষের সামনে আসেনি। সরকারের পক্ষ থেকে শুধু এইটুকু জানানো হয়েছে যে, তদন্ত শুরু হয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী, নিরাপত্তা-বিষয়ক ক্যাবিনেট কমিটির বৈঠক ডেকে পরিস্থিতিটা জানার চেষ্টা করেছেন।
Final journey of Brave Hearts…
WATCH NOW – CDS #BipinRawat‘s final journey on https://t.co/Bp14I4GRlV pic.twitter.com/toXMRgMSvy
— Doordarshan National दूरदर्शन नेशनल (@DDNational) December 10, 2021
এই ঘটনায় গোটা দেশের মানুষ সাংঘাতিক সংশয়ের মধ্যে রয়েছেন। প্রথমত, এটা দুর্ঘটনা, নাকি অন্য কোনও গভীরতর ষড়যন্ত্র— এসব নিয়ে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে গেছে চারিদিকে। সাংবাদিক হিসেবে আমার মনে হয়, সেনাবাহিনীর নিরাপত্তা নিয়ে এইরকম জল্পনা, গুঞ্জন একেবারেই কাম্য নয়। আবার সরকারের পক্ষ থেকেও তো একটা দায়িত্ব নেওয়া উচিত, যাতে এই ঘটনার অস্পষ্টতা যত দ্রুত নিরসন সম্ভব হয়। কেননা, সাধারণ মানুষ জানতে চাইছে, আসলে ব্যাপারটা কী হয়েছে?
নরেন্দ্র মোদী সরকার যে এই ঘটনার তদন্তে এত বিলম্ব করছে বা গাফিলতি করবে, এমন আশঙ্কা কখনোই প্রকাশ করব না। কিন্তু গোটা দেশের নাগরিক সমাজের একটা দাবি হচ্ছে, যতটা সম্ভব সতর্কতা এবং সক্রিয়তার সঙ্গে তথ্যটা মানুষের কাছে তুলে ধরা হোক। গণতন্ত্রে সেটাও কিন্তু একটা অত্যন্ত আবশ্যিক এবং প্রয়োজনীয় শর্ত।
আমি মানছি, জাতীয় নিরাপত্তার যুক্তিতে সেনা-সংক্রান্ত তথ্য সবসময় প্রকাশ করা যায় না, যেটা সরকার বারবার বলে থাকে। কিন্তু জেনারেল রাওয়াতের প্রাণহানি তো খুব সাধারণ ঘটনা নয়, এটা একটা ব্যতিক্রমী ঘটনা। কাজেই দেশের সাধারণ মানুষের কাছে এই ঘটনার সমস্ত তথ্যটা তুলে ধরা প্রয়োজন।
একতরফা অভিযোগ করা হয় যে, আমরা সাধারণ মানুষ সবসময় ষড়যন্ত্রের তত্ত্বে বিশ্বাস করি। আমরা সমস্ত তথ্য না জেনেই নানা রকমের ধারনার বশবর্তী হই। এগুলো হল এক ধরনের কু-সংস্কার। কখনো কখনো সেগুলোকে বলা হয় মিথ। আবার এটাও তো সত্য যে, সমস্ত তথ্য যদি রাজার কাছে থাকে এবং সেই তথ্য যদি প্রজাদেরকে জানানো না হয় তাহলে নেতাজীর অন্তর্ধান রহস্য নিয়েও তো জল্পনা-কল্পনা থেকে যায়! সুতরাং, আজ ৭০ বছর পরেও কেন নেতাজীর আর্কাইভ থেকে সমস্ত তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে না বা হল না, সে প্রশ্নও কিন্তু সাধারণ মানুষ তুলতেই পারেন।
এইরকম অনেক দৃষ্টান্ত আছে। তবে জেনারেল রাওয়াতের এই দুর্ঘটনা কিন্তু প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের ক্ষেত্রেও কতগুলো প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। যে প্রশ্ন গুলোর জবাব সরকার বাহাদুরকে দিতে হবে। আমি এক্ষেত্রে কংগ্রেস বা বিজেপি, অর্থাৎ কোনও রাজনৈতিক দলের প্রিজমে বিষয়টা দেখতে চাই না। তার কারণ, গত পাঁচ বছরে এ ধরনের দুর্ঘটনা ছ’বার হয়েছে। রাশিয়া থেকে কেনা হয়েছে বিশ্বের অন্যতম অত্যাধুনিক ট্রান্সপোর্ট কেরিয়ার MI-17v-5 চপার, অথচ একের পর এক ক্রাশ হয় কেন? আর ভারতের ‘চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ’ যখন এই চপারে নিহত হন তখন প্রশ্ন ওঠে যে, এটা কি নিছক দুর্ঘটনা নাকি কোনও যান্ত্রিক ত্রুটি? এটা কি আবহাওয়ার সমস্যা, কমিউনিকেশন ফেলিওর, নাকি ন্যাভিগেশন এরর? সবুজে ঢাকা নীলগিরি পার্বত্য জোনে ঠিক কী হয়েছিল, তা নিয়ে তদন্ত শুরু হলেও সেই তদন্তের রিপোর্ট যতদিন না আসবে ততদিন চূড়ান্ত কোনও মন্তব্য করা যাবে না। আমাদের এটা মনে রাখতে হবে যে, এই চপারেই কিন্তু পাহাড়ি এলাকা সফর করেন দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এই চপারেই কিন্তু সফর করেন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। সুতরাং নিরাপত্তার জন্য এখনই অনেক বেশি সতর্ক এবং যথোচিত ব্যবস্থা গ্রহণ করাটা আমাদের কর্তব্য।
মাত্র পঁচিশ দিন আগে ল্যান্ডিংয়ের সময় অরুণাচলে দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিল এমনই একটা MI-17। নেপথ্য কারণ জানতে গঠিত ‘কোর্ট অফ ইনকয়ারি’ সবেমাত্র তদন্ত শুরু করেছে। তার মধ্যেই আবার আর একটা ঘটনা। একবার MI-17v5 রহস্যজনক-ভাবে ভেঙে পড়েছিল জম্মু-কাশ্মীরের বদগাঁও-তে। সেটা এমন একটা সময়ে হয়েছিল, যখন সীমান্তে চলছিল ভারত-পাক বায়ুসেনার তুমুল লড়াই। শত্রু পক্ষের ড্রোন ভেবে কি ভুল হয়েছে? কিন্তু বিশেষ কপ্টার এয়ার ফোর্সের অন্যতম আইকন MI-17 চিনতে তো ভুল হবার কথা নয়! তাহলে সেদিন এমন ভুল হয়েছিল কেন, সেটাও একটা রহস্য থেকে গেছে! কাশ্মীরে পুলওয়ামা আধা সামরিক বাহিনীর কনভয়ে হামলা চালিয়ে ৪২ জন জওয়ানকে হত্যা করেছিল লস্কর। ভারতীয় সেনা এবং বিমান বাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল প্রত্যাঘাতের। সেই প্রত্যাঘাত-ই ছিল নিয়ন্ত্রণ রেখা পেরিয়ে পাক অধিকৃত কাশ্মীরে গিয়ে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক। সেদিনই বেস থেকে টেক-অফের কিছুক্ষণের মধ্যেই ভেঙে পড়েছিল MI-17v5।
এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, রাশিয়ার কাছ থেকে কেনা এই চপার আমাদের দেশের সংবিধানে সবথেকে সর্বোচ্চ পদাধিকারীদের ব্যবহার করতে হচ্ছে কেন? ভারত তার নিজস্ব চপারে, ভারতের নিজের প্রধানমন্ত্রীকে সফর করাতে পারে না কেন? আমরা যে স্বয়ংসম্পূর্ণ ভারতের কথা বলি, আমরা যে স্বাধীন ভারতের স্বদেশী দ্রব্যের কথা বলছি, তাহলে এখনও কেন প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে এত বিদেশী রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল?
আরও পড়ুন: Bipin Rawat: বিপিন রাওয়াতকে শেষ শ্রদ্ধা জানালেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি
অরুণ জেটলি যখন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হয়েছিলেন এবং নরেন্দ্র মোদী তখন সবে প্রধানমন্ত্রী হলেন। অরুণ জেটলি একবার বলেছিলেন, আমাদের প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের যে প্রায় আট-দশটা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা আছে সেগুলো এমনভাবে ধুঁকছে এবং তার অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি এত খারাপ যে, অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার মতো সেগুলোকেও বিলগ্নিকরণ করে দিয়ে বেচে দেওয়াই ভালো। তার জন্য বেসরকারিকরণ করা প্রয়োজন। তখন সেই প্রস্তাবে নানা পক্ষ থেকে সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। এখন যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, সেই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক গা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারেনি, কিন্তু বহুক্ষেত্রে বেসরকারিকরণ হয়েছে। এখনও পর্যন্ত মূলত একটা বন্দুকও আমরা ঠিকমতো করে তৈরি করতে পারি না। সেক্ষেত্রে রাশিয়া, ইজরায়েল, ফ্রান্স, আমেরিকা— সবার কাছ থেকে যুদ্ধাস্ত্র কিনেই চলেছি। কেনা-বেচার ক্ষেত্রে নিন্দুকেরা বলে যে, অনেক রকমের প্রতিরক্ষা-দুর্নীতি আছে, ডিল হয়। অবশ্য কোনও প্রমাণ ছাড়া সেসব কথা আমাদের পক্ষে বলা সাজে না।
Watch LIVE on https://t.co/Bp14I4GRlV https://t.co/8IOPZxmfcp
— Doordarshan National दूरदर्शन नेशनल (@DDNational) December 10, 2021
কিন্তু এইটুকু তো বলতে পারি যে, স্বাধীনতার ৭০ বছর পরেও আমরা এখনও পর্যন্ত সামরিক ক্ষেত্রে নিজেদের অস্ত্র নিজেরা যে তৈরি করব এবং অন্যদের ওপর নির্ভরশীলতা থাকব না, সেরকম একটা পরিস্থিতিই তো তৈরি করতে পারিনি। বিপিন রাওয়াতের এইরকম আকস্মিক দুর্ঘটনা, যার সত্যতা এখনও সবটা জানা যায়নি। কাজেই এইটুকু বলা যায়, এইরকম একজন শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তির ক্ষেত্রে যখন এই ধরনের ঘটনা ঘটে তখন সেই পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে এখনই আমাদের প্রতিরক্ষা মন্ত্রককে আরও সাজিয়ে তোলার একটা প্রশ্ন ওঠে। রিপোর্ট সম্পূর্ণ প্রকাশ যদি নাও হয়, অন্তত অনেকটা প্রকাশিত হবে— এমনটা আমরা আশা করব। আর আশা করব, আগামী দিনে যাতে এইরকম মৃত্যু সংবাদ আমাদের আর শুনতে না হয়।
(ছবি সৌজন্য: Twitter)