২৫ বছর। কি বলা যায়, কোয়ার্টার সেঞ্চুরি? ক্রিকেটে সেঞ্চুরি এক বিরল সম্মান। হাফ সেঞ্চুরিও তাই। ক্রিকেটার আর টিভি বিশেষজ্ঞ , ক্রিকেট প্রশাসক কিংবা কোচ হয়ে ২৫ বছর সেই একই পর্যায়ের ক্রিকেটে থেকে গেলে এভাবে সেঞ্চুরির আগে কোয়ার্টার লিখলে বাড়াবাড়ি হবে বলে মনে হয়না। আর যাঁদের জন্য এই ২৫ বছরের কথা লেখা, তাঁদের নাম যদি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় আর রাহুল দ্রাবিড় হয় – তাহলে হাততালিই মিলবে। বিরোধীতা নয়।
এই সেই ২২ জুন। লর্ডসের মাটিতে অভিষেক ঘটেছিল সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের। শুরু হয়েছিল রাহুল দ্রাবিড়ের টেস্ট কেরিয়ার। ১৯৯৬ সাল আজ বছরের পর বছর টপকে ২৫ এ পা রাখল ২০২১ সালে। সেই টেষ্টে সৌরভ মহারাজকীয় এক সেঞ্চুরি করেছিলেন। আর নব্বইয়ের ঘরে আউট হয়ে ফিরেছিলেন দ্রাবিড়।
মঙ্গলবার টুইট করে এই ২৫ বছরপূর্তি জানান দিল বিসিসিআই। লেখা হল, ” এই দিনটিতেই ১৯৯৬ সালে অভিষেক টেস্টে প্রথম সেঞ্চুরি করেছিলেন সৌরভ। টেস্ট ক্রিকেটে এই ম্যাচেই অভিষেক ঘটেছিল রাহুলের । বাকিটা আজ ইতিহাস।”
সময় গড়িয়েছে। এই দুই কিংবদন্তী ক্রিকেটার ভারতকে নেতৃত্বও দিয়েছেন সাফল্যের সঙ্গে। আর এই মুহূর্তে সৌরভ সামলাচ্ছেন ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের শীর্ষ দায়িত্ব। সভাপতি তিনি। আর জাতীয় ক্রিকেট একাডেমির ডিরেক্টর রাহুল দ্রাবিড় এবার সিনিয়র দল নিয়ে যাবেন শ্রীলঙ্কা সফরে।
সাউদাম্পটনে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালের মধ্যেই মঙ্গলবার সোশ্যাল মিডিয়ার ট্রেন্ডিং হয়েছে ভারতীয় ক্রিকেটের এইদিনটি। ১৯৯৬ সালের ২২ জুন লর্ডসে টেস্ট অভিষেকে সেঞ্চুরি করেছিলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। ২০ জুনে হয়েছিল অভিষেক। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই ঐতিহাসিক ইনিংসের দেখতে দেখতে ২৫ বছর পার করে ফেললো। সেদিন সৌরভের থেকে একটি কমপ্লিমেন্টারি টিকিট নিয়ে মাঠে ঢুকেছিলেন অনেকেই। বাংলার মানুষ সকলে। কেউ তাঁর কাকু – কাকিমা। কেউ ছিলেন তাঁর বাল্যবন্ধু ক্রিকেটার।
২৫ বছর পরও মনে আছে সেদিনের সব ঘটনা। ভারতীয় দলের চুড়ান্ত একাদশে ঢোকার কথাই ছিল না। কিন্তু শেষ মুহূর্তে হয়েছিল। ভারত আগে ফিল্ডিং করেছিল। মাঠ, পরিবেশ আর আবহাওয়ার মানিয়ে নিতে পেরেছিলেন। মহারাজ খেলছে — জানার পর থেকে মা নিরূপা নিজেকে সারাক্ষণ আটকে রেখেছিলেন দোতলার ঠাকুর ঘরে। বাড়ির আরাধ্য দেবী মা চণ্ডীর সামনে। এই ঠাকুর ঘরের উল্টোদিকে ছিল একটা ছোট লম্বা ঘর। সেখানে বসে টিভিতে ম্যাচ দেখা চলছিল। বাবা চন্ডী গঙ্গোপাধ্যায় বসে থাকতেন সেখানে। নড়তেন না। সৌরভের মা এসেও কখনও উঁকি দিয়ে যেতেন। তখন একটি সংবাদপত্রের হয়ে এই দিনটিতে সৌরভের বাড়িতে বসেই সব দেখছিলাম। তারপর সেই অন্তিম লগ্নে আবেগে ভাসল বাংলা। লর্ডসে মহারাজ হয়ে উঠলেন সৌরভ।
পরে অফিসে ফিরে রাতে থেকে গিয়েছিলাম। সৌরভ হোটেলে ফিরলে, ওঁর থেকে ফোনে অনুভূতি জানবো বলে। তখন মোবাইল ফোনের চল ছিল না। হোটেলে ফোন করে রুম নম্বর বলতে হত। সৌরভের রুম নম্বর পেয়ে গিয়েছিলাম, বাড়ির থেকে। ফোনে ধরতেই, ধীর স্থির শান্ত গলায় সৌরভ জানতে চেয়েছিল, ‘ ভালো আছো তো?’ আগেরদিনই তো কথা হয়েছে। পরদিন কেমন আছি জানতে চাওয়া! এটাই সৌরভের স্টাইল। অভিনন্দন পর্ব সেরে সেদিন জানতে চেয়েছিলাম অনেক কিছু। একটা কথা আজও ভুলতে পারিনি। ‘ ভেবেই রেখছিলাম, ২০ করে গুনবো। ১ থেকে ২০ তে পৌঁছে গেলে, আবার নুতন করে গুনতে শুরু করেছিলাম। দেখতে দেখতে সেঞ্চুরি হয়ে গেল। ‘ জানতে চেয়েছিল , আমার কেমন লেগেছে ব্যাটিং। আরে! বাংলা নুতন নায়ক পেয়ে গেছে, ব্রিটিশ রাজ্যে। ভালো লাগার তৃপ্তিই আলাদা।
পরদিন কাগজের প্রথম পাতায় এই ‘ ২০ ‘ রানের লক্ষ্যে ছুটে সেঞ্চুরি করার খবরটা ছাপা হয়েছিল। আর রাহুল দ্রাবিড়ের সঙ্গে কটকে কথা হয়েছিল সেই দিনটি নিয়ে। রাহুল আফসোস করে বলেছিল, ‘ সৌরভ পেরেছিল, আমি পারিনি। আমি নিজে সৌরভের থেকে জেনেছিলাম , কী মানসিক শক্তি দিয়ে মোকাবিলা করেছিল।
সৌরভ সবসময় বলতেন , ” আমরা পাঁচজন একদিন প্রায় একসঙ্গে হয়তো সরে যাব, কী হবে দলটার ? ” কোন পাঁচজন? সৌরভের তালিকার পাঁচ ছিলেন, সচিন – রাহুল – কুম্বলে – সেহবাগ – ভিভিএস। সচিনের পরই রাখতেন , রাহুলকে। সেই রাহুলকে ওয়ান ডে টিমে একাদশে রাখতে নেতা সৌরভ তাঁকে দিয়ে কিপিং পর্যন্ত করিয়েছিলেন। আর রাহুলের অন্যতম প্রিয় বন্ধু শ্রীনাথ শুধু অভিযোগ জানতেন, রাহুল উইকেটের পিছনে থাকলে তাঁর উইকেট শিকারের সংখ্যা কমে যাবে। আসলে শুরুতে শ্রীনাথের ভরসার উইকেটকিপার ছিলেন না রাহুল। কিন্তু সুযোগ পেয়ে নিজেকে আরও উন্নত করে নিয়েছিলেন রাহুল।
সৌরভ আজও এই বাকি চার মুর্তিকে নিয়েই চলতে চান । তাই কুম্বলে সিনিয়র দলের কোচ হয়েছিলেন। এখন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় বোর্ড সভাপতি হয়ে, যুব দলের থেকে রাহুলকে টেনে এনে সিনিয়র টিমের কোচ করে শ্রীলঙ্কা সফরে পাঠাচ্ছেন। জানেন – রাহুল আরও ভাল কিছু ক্রিকেটারকে এই সফর থেকে তুলে আনবে।
আজ সৌরভের সেই সেঞ্চুরির ২৫ বছর পূর্তিতে সকলে মেতেছিলেন । কিন্তু রাহুল দ্রাবিড়ও সৌরভের অভিষেক টেস্টের সেঞ্চুরিতে সঙ্গী ছিলেন। সৌরভ করেছিলেন ১৩৬ রান। আর সৌরভের পর সাত নম্বরে নেমে করেছিলেন ৯৪ রান।
ঐতিহাসিক লর্ডস স্টেডিয়ামে সৌরভ টেস্টের তৃতীয় দিন শতরান পূরণ করেন। প্রথম ইনিংসে ইংল্যান্ড ৩৪৪ রান করেছিল। ভেঙ্কটেশ প্রসাদ পাঁচ উইকেট শিকার করেছিলেন।
সেই ম্যাচে সৌরভ তিন নম্বরে ব্যাট করতে নেমেছিলেন। ৩০১ বলে ১৩১ রানের একটি ইনিংস খেলেন। ওই ইনিংসে ২০ বার বল বাউন্ডারির বাইরে পাঠিয়েছিলেন। আর ষষ্ঠ উইকেটে সৌরভ সঙ্গী আরেক অভিষেক হওয়া রাহুল দ্রাবিড়কে নিয়ে ৯৪ রান তুলেছিলেন। ম্যাচ ড্র হয়ে যায়।
এরপর টিম ইন্ডিয়ার মানসিকতারই রদবদল ঘটে যায়। সৌরভকে ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়। দেখতে দেখতে তিনি দেশের সফলতম অধিনায়কদের মধ্যে একজন হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর অধিনায়কত্বে ভারত পাকিস্তানের মাটিতে পাকিস্তানকেই টেস্ট সিরিজে হারিয়ে এসেছিল।
২০০৩ সালে ক্রিকেট বিশ্বকাপে সৌরভের নেতৃত্বে ভারতীয় ক্রিকেট দল ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। শুরুর দিকে সৌরভ একান্ত আলাপচারিতায় প্রায়ই বলতেন, ‘ দেশের হয়ে ১০ বছর টানা খেলে যেতে চাই।’
তা করেন। সৌরভ ১১৩টি টেস্ট এবং ৩১১টি ওয়ান ডে ইন্টারন্যাশনাল ম্যাচ খেলেছেন। তাঁর মোট ১৬টি টেস্ট সেঞ্চুরি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সৌরভ সবমিলিয়ে মোট ১৮,৫৭৫ রান করেছেন। ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের প্রেসিডেন্ট আসনে বসেন।
২৫ বছরের আবর্তে তিনি এবং বন্ধু রাহুল আজও দেশের ক্রিকেটে জড়িয়ে।