কলকাতা: সে দিনটাও ছিল রবিবার ৷ তিনি হেরে গিয়েছিলেন ৷ দল পেয়েছিল বিপুল জয় ৷ তার পরই ছোট্ট মেয়েটাকে নিয়ে প্রকাশ্যে এসেছিলেন ৷ আজও নিজের ঐতিহাসিক জয়ের পর নেত্রীর পাশে সেই ছোট্ট আজানিয়া ৷ আর তত ক্ষণে রাজ্যের সর্বত্র সবুজ আবিরে ছেয়ে গিয়েছে ৷ জাতীয় নেত্রী হওয়ার পথে আরও এক কদম এগিয়ে গিয়েছেন ৷
সলতেটা অনেক দিন ধরেই পাকানো হচ্ছিল । দেশজোড়া বিরোধী ঐক্যের ছবিটা সাম্প্রতিক কালে সবচেয়ে স্পষ্ট করে প্রথম বারের জন্য তুলে ধরেছিল বছর দুয়েক আগের ব্রিগেডের সমাবেশ । সে দিনই বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলের চেয়ারপার্সন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলেন জাতীয় রাজনীতির আলোয় । আজ ভবানীপুর উপ-নির্বাচনে ৫৮ হাজারের বেশি ভোটে জিতে মমতা বুঝিয়ে দিলেন দেশে বিজেপি বিরোধী মুখ তিনিই ৷ তাঁকে কেন্দ্র করেই আগামী দিন যে যাবতীয় রাজনৈতিক সমীকরণ আবর্তিত হতে চলেছে, সেটাও স্পষ্ট হয়ে গেল দেশের সামনে ৷
তৃণমূলের যাত্রাপথে অধিকাংশ সময়টাতেই জাতীয় রাজনীতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রাসঙ্গিক থেকেছেন । বরাবরই তিনি দিল্লিতে গুরুত্ব পেয়েছেন । কিন্তু গুরুত্বটা পেয়েছেন এক জন গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক নেত্রী হিসেবেই। জাতীয় স্তরের নেত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখেনি দেশের রাজনৈতিক শিবির এর আগে কখনও । কিন্তু, গত বিধানসভা ভোটে বিজেপিকে উড়িয়ে দেওয়ার পরই জাতীয় নেত্রী হিসেবে এবং বিজেপি বিরোধী মুখ হিসেবে স্পষ্ট হতে শুরু করে তাঁর নাম ৷
রবিবার ভিকট্রি সাইন নয়, ১,২,৩ মানুষকে ধন্যবাদ দিন হাত তুলে বললেন মমতা৷
এ কথা ঠিক, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল এখনও সে ভাবে শিকড় গাড়তে পারেনি বাংলার বাইরে । যদিও সম্প্রতি ত্রিপুরা-গোয়ার মতো রাজ্যে নিজেদের প্রসার ঘটাতে শুরু করেছে ঘাসফুল ৷ কিন্তু, মূলত আঞ্চলিক শক্তি বাংলার শাসক দলটা থেকে গেলেও দলের নেত্রী যেন এখন সে পরিচয়ের অনেক ঊর্ধ্বে । ‘দোর্দণ্ডপ্রতাপ’ নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহদের দিকে নিরন্তর চ্যালেঞ্জ ছোড়ার স্পর্ধা দেখাতে পারেন যিনি, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে গোটা বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরকেই যে তিনি পথ দেখাতে পারেন, তা নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে খুব একটা মতপার্থক্য নেই ।
রবিবার কালীঘাটে বাড়ির বাইরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ও তৃণমূল কর্মী-সমর্থকরা৷
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিপুল গরিষ্ঠতা নিয়ে নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হওয়ার পর থেকেই বিরোধী শিবির ছত্রভঙ্গ, শ্রীহীন হয়ে পড়েছিল । কিন্তু দাপুটে বিজেপির জমানায় ওই দশায় পড়ে থাকলে যে অস্তিত্বের সঙ্কট তৈরি হয়ে যাবে, তা বিরোধী দলগুলোর বুঝতে সময় লাগেনি । সেই থেকেই কাছে আসা শুরু । তবে নানা ইস্যুকে কেন্দ্র করে বিরোধী শক্তির জোট বাঁধা শুরু গত বছর খানেক ধরে । সেই প্রক্রিয়ায় প্রথম থেকেই সক্রিয় থেকেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । কখনও সংসদে কংগ্রেস এবং অন্যান্য বিরোধী দলের সঙ্গে ফ্লোর কো-অর্ডিনেশনে গিয়ে ট্রেজারি বেঞ্চকে ঘিরে ফেলা, কখনও সংসদ কক্ষের বাইরে একের পর এক নজরকাড়া ধর্নার আয়োজন— মোদি বিরোধিতার পরিসরে তৃণমূল এ ভাবেই সামনের সারিতে থেকেছে বরাবর । এর পরে কখনও অখিলেশের মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কখনও কেজরিওয়ালের পাশে দাঁড়িয়েছেন, কখনও নোটবন্দির বিরুদ্ধে তাঁর তীব্র কণ্ঠস্বর অন্য সব প্রতিবাদকে ম্লান করে দিয়েছে, কখনও এনআরসি ইস্যুতে বিজেপির সামনে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তাঁর দল । মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিরন্তর সঙ্ঘাতই ক্রমশ তাঁকে বিরোধী শিবিরের চোখের মণি করে তুলেছে সংশয় নেই । রবিবার ভবানীপুরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক জয়ের পর কার্যত স্পষ্ট হয়ে গেল আগামী দিনে, দেশে মোদি বিরোধী মুখ তিনিই ৷
রবিবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক কন্যা আজানিয়া বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃণমূল কর্মী-সমর্থকরা
এবার একটু পিছিয়ে যাওয়া যাক ৷ মে মাসে ফল প্রকাশের পর, পর পর তিন বার জেতা এবং গতবারের চেয়ে বেশি আসনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃণমূল কংগ্রেসের জয় থেকে প্রমাণ হয় বিজেপি বাংলা দখল করার জন্য যে পরিকল্পনা নিয়েছিল, তা ব্যর্থ হয়েছে ৷ সাধারণত যে রণনীতিতে বিজেপি উত্তর ভারত বা অন্যত্র ভোটে লড়ে কিংবা নির্বাচনী লড়াইয়ে সফল হয়, পশ্চিমবঙ্গে সেই মেরুকরণ কাজ করেনি ৷
আরও পড়ুন –সকাল থেকেই ফাঁকা বিজেপি অফিসে বেলা গড়াতেই পড়ল ‘ঝাঁপ’
তা-ছাড়া জাতপাতের যে রাজনীতি সেটাও ব্যর্থ হয়েছে বাংলায় ৷ কারণ, মতুয়া ভোট সম্পূর্ণ ভাবে বিজেপির দিকে যায়নি ৷ তফসিলি জাতি, উপজাতিদের ভোট ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে হারিয়েছিল তৃণমূল ৷ সেটার অনেকটাই তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থীরা ফেরত পেয়েছেন ৷
একই সঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সামগ্রিক ভাবে বিধানসভার যে ফল তাতে ব্যর্থ হয়েছে বিজেপি ৷ অসম বিজেপি পুনর্দখল করেছে বটে ৷ কিন্তু তামিলনাড়ু, কেরল ও পশ্চিমবঙ্গে প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হয়েছে গেরুয়া শিবির ৷ পশ্চিমবঙ্গ দখল করতে পারলে গোটা ভারতে প্রভাব বিস্তার করতে বিজেপির সুবিধা হত ৷ তাই প্রথম থেকেই বিজেপির লক্ষ্য ছিল বাংলা ৷
কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে জয়ের আনন্দ ভাগ করে নিতে ঘর থেকে রাস্তায় বেরিয়ে এলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷
অন্যদিকে করোনা মোকাবিলা নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের যে নেতিবাচক সমালোচনা হচ্ছে, তা অনেকটাই প্রশমিত করা যেতে পারত ৷ কিন্তু ভোটের কারণে সেটা করা যায়নি ৷
এই পরিস্থিতিতে আজ মমতার বিপুল জয় জাতীয় স্তরের নেতা হিসেবে পরিচিতি সুপ্রতিষ্ঠিত করল বলা যায় ৷ কারণ, যেখানে রাহুল গান্ধির মতো নেতা ব্যর্থ ৷ অসম বা কেরল, কোনওটাতে সাফল্য পায়নি কংগ্রেস ৷ বরং পুদুচেরি কংগ্রেসের রাজ্য ছিল, সেটাও হারিয়েছে ৷ নরেন্দ্র মোদি, রাহুল গান্ধি ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় – এই ত্রয়ীর মধ্যে নির্বাচনে সাফল্য পেলেন মমতাই ৷
আরও পড়ুন –কোথাও নেই বামেরা, নোটা থেকে এগিয়ে সিপিএমের শ্রীজীব
এর আগে সমস্ত মোদি বিরোধী শক্তিকে এক হতে মমতা চিঠি দিয়েছিলেন ৷ এবার কেন্দ্রে মোদি বিরোধী লড়াইকে মমতা আরও জোরদার করবেন ৷ সেক্ষেত্রে বিরোধী নেত্রী হিসেবে তিনি স্বাভাবিক পছন্দের জায়গায় যেতে পারেন ৷
আজ যেন স্পষ্ট হয়ে গেল দেওয়ালের লিখন ।