উত্তরপ্রদেশে ভোটের বাদ্যি বাজিয়ে দিলেন আদিত্যনাথ যোগী। বিজ্ঞাপণ হোর্ডিংয়ে ছয়লাপ উত্তরপ্রদেশের বড় আর ছোট শহর, উত্তর প্রদেশ তো ছেড়েই দিলাম, দিল্লির বাস স্ট্যান্ড, বড় বড় হোটেলের সামনে, দিল্লির প্রায় সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গায়, বিরাট বিরাট হোর্ডিং। যোগীজির মুখ, পাশে নরেন্দ্র মোদী, না দলের সভাপতি জগৎপ্রকাশ নাড্ডা বা অমিত শাহের ছবি জায়গা পায়নি, মোদি আছেন, যোগীজির পাশে। বার্তা খুব পরিস্কার, মোদিজি’র পরে বিজেপির নতুন চেহারা।
সেই হাথরসের ধর্ষণের ঘটনার পরে, মুম্বইয়ের এক বিজ্ঞাপণ সংস্থাকে নিয়ে আসা হয়েছিল, ওই ঘটনা সামলানোর জন্য। শোনা যাচ্ছে অন্য আরেক সংস্থাকে এবার দেওয়া হয়েছে এই ক্যাম্পেনের ভার। দলের প্রচার ব্যবস্থা নয়, বিজেপি আইটি সেল নয়, এ এক সম্পূর্ণ আদিত্য যোগীর নিজস্ব ব্যবস্থা। দেশের অন্যান্য মুখ্যমন্ত্রীরা প্রচার করেন, মমতা করেন, কেজরিওয়াল করেন, উদ্ধব ঠাকরে করেন, কিন্তু যোগীজি সব্বাইকে ছাপিয়ে গেছেন। অন্যদের সবাইকে মিলিয়ে খরচ ১০০ টাকা হলে, যোগীজি নিজেই ৩০০ টাকা খরচ করছেন। গত সাড়ে চার বছরে তাঁর উন্নয়ন গাঁথার কথাই শুধু নয়, এই ক্যাম্পেনের আরও কয়েকটা দিক আছে, যা নিয়ে পরে আলোচনায় আসছি।
বহু আগে মোদীজি নিজের মত করে একটা গুজরাট মডেল বানিয়েছিলেন। দেশ ধন্য ধন্য করছিল। অমন শিল্পায়ন নাকি হয় না, আহা অমন বিকাশ নাকি আগে কখনও হয়নি। আসল পরিসংখ্যান যাই বলুক, এক পারশেপসন তৈরি হয়েছিল, এক ধারণা যে মোদি মডেল হল বিকাশের মডেল, সার্বিক উন্নয়নের মডেল। আর সেই প্রচারের দৌলতেই তিনি অস্বীকার করেছিলেন, বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে। অটলবিহারী বাজপেয়ীকেও। নিজের মত করে সাজিয়েছিলেন নিজের মন্ত্রীসভা। যেখানে তিনি এবং তাঁর পার্টনার ইন ক্রাইম অমিত শাহ ছাড়া কারোর হাতে ছিল না ছিটেফোঁটা ক্ষমতা, সব কিছু থাকত গোপন। যেদিন ঘোষণা হত, সেদিন মানুষ শুধু নয়, চমকে যেত সংবাদ মাধ্যমও। আরেক অ্যারোগান্ট, উদ্ধত আচরণ আর কথাবার্তা। কথায় কথায় মুসলমানদের কটুক্তি, প্রকাশ্যেই ঘৃণা আর বিষ ছড়ানো ছিল সেই মোদি মডেলের বিশেষত্ব, মিয়াঁলোগ অব ডর গয়ে? তারপর পরিচিত হাসি। মন্ত্রীসভা নামেই ছিল, তাঁদের হাতে কোনও ক্ষমতা ছিল না, কিছু আমলা আর দু একজনকে নিয়ে মোদিজি তাঁর সুশাসন চালাতেন। পুলিশি বাড়াবাড়ির অসংখ্য ঘটনা ছিল, ছিল গোধরার মত দাঙ্গা, যেখানে ভোটার লিস্ট দেখে আগুন ধরানো হয়েছিল। যেখানে একজন প্রাক্তন সাংসদকেও জ্যান্ত জ্বালানো হয়েছিল, ফেক এনকাউন্টারের ঘটনা ছিল, তাই নিয়ে প্রশাসনের গর্বও ছিল। শিল্পপতিদের উল্লাসভূমি হয়ে উঠেছিল গুজরাট। যেমন ইচ্ছে তেমন জমি অধিগ্রহণ, শ্রম আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলছিল তাঁদের তথাকথিত শিল্প, এই সব মিলিয়েই ছিল মোদিজির গুজরাট মডেল। আনচ্যালেঞ্জড মোদি মডেল।
এর ওপরে ভর দিয়েই তিনি এলেন কেন্দ্রে, সেই একই গোপনীয়তা, যে গোপনীয়তাতে ডিমনিটাইজেশনের মত সিদ্ধান্তকেও, অর্থমন্ত্রীকে, অর্থ দফতরকে বাদ দিয়েই নেওয়া হয়। মোদিজির এখনকার ক্যাবিনেট, নামেই ক্যাবিনেট, প্রত্যেকটা সিদ্ধান্ত তাঁর, প্রত্যেক দফতর পিএমও’র অধীন, কাজ যা হচ্ছে তা তো সবাই জানে, কিন্তু প্রচার? ঢাকের বাজনায় কান ঝালাপালা, মোদিজির জন্মদিন পালন করা হল, তিনি ৭১, দেশজুড়ে জন্মদিন পালন হচ্ছে। ঠিক এই মডেলটাই যোগী আদিত্যনাথ তাঁর মত করে তৈরি করেছেন উত্তরপ্রদেশে। তিনি বিজেপি হাইকমান্ডকে পাত্তাও দেন না। হাইকমান্ডের মর্জিতে সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বদল হয়, উত্তরপ্রদেশে মুখ্যমন্ত্রী তো বাদই দিলাম, একজন মন্ত্রীও আদিত্যনাথের সম্মতি ছাড়া হয়নি, হবেও না। আরও বড় ব্যাপার হল, সে রাজ্যে বাকি মন্ত্রীদের কোনও ক্ষমতাই নেই, তাঁরা কাঠপুতুলের মত পদে বসে আছেন মাত্র। মোদিজির ঘনিষ্ঠ আমলা এ কে শর্মাকে, উত্তরপ্রদেশে পাঠানো হল, শোনা যাচ্ছিল, তিনি নাকি উপমুখ্যমন্ত্রী হবেন, কোথায় কি? তিনি এখন উত্তরপ্রদেশ বিজেপির সহসভাপতি, হ্যাঁ ১৭ জন সহসভাপতির মধ্যে একজন, লক্ষ্ণৌতে আছে এই পর্যন্তই, ব্যস। জিতীন প্রসাদকে নিয়ে গিয়ে একটা বড়সড় পদ দিয়ে ব্রাহ্মণ ভোট পাবার ইচ্ছে ছিল, যোগীজি চাননি, জিতীন প্রসাদ সাইড লাইনে বসেই আছেন, সাড়াশব্দও নেই। যে বিজেপি হাইকমান্ড, মানে মোদি – শাহ এক চুটকিতে জীবনে কোনও দিন কোনও মন্ত্রকের দায়িত্বে না থাকা, কোনও প্রশাসনিক দায়িত্বে না থাকা, ভূপেন্দ্র প্যাটেলকে মুখ্যমন্ত্রীই শুধু করেননি, পুরো মন্ত্রীসভার খোলনলচে বদলে দিয়েছেন, যেখানে একমাত্র শর্ত মোদি – শাহের প্রতি আনুগত্য। সেইরকমই অবলীলায় ইয়েদুরিয়াপ্পাকে সরিয়ে বোম্মাইকে এনেছেন, কোনও প্রতিবাদ হয়নি, অসমে জিতে আসা মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনওয়ালকে সরিয়ে, এনেছেন হিমন্ত বিশ্বশর্মাকে, মন্ত্রিসভার রদবদল করেছেন সবাইকে অবাক করে দিয়ে। এক বাবুল সুপ্রিয় ছাড়া কোনও বিদ্রোহ নেই। সেই আয়রন হাইকমান্ড যোগীর সামনে অসহায়, সেখানেই যোগীর নতুন মডেলের কার্যকরিতা, তিনি তাঁর মঞ্চের পেছনে মোদিজির ছবি টাঙাচ্ছেন, ব্যস, তার বেশি কিছু নয়।
সেই যোগীজি কুশিনগরে গেলেন, মঞ্চে দাঁড়িয়ে কুশিনগর মেডিক্যাল কলেজের ঘোষণা করলেন, ঘোষণা করলেন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের, সে কবে হবে তা অবশ্য কারোর জানা নেই। এই সাড়ে চার বছরে ওই কুশিনগরের বাসিন্দারা বন্যায় ভেসেছেন, ঘর ভেঙে গেছে, ত্রাণ নিয়ে হাজারো অভিযোগ, সেইখানে মঞ্চে দাঁড়িয়ে যোগীজি বললেন, আব্বাজান বলে যারা ঝোলা নিয়ে বের হত, তাঁদের দিন চলে গেছে। খুব পরিস্কার মেসেজ, এখন থেকেই তিনি নেমেছেন, ভোট মেরুকরণে, প্রকাশ্যেই বললেন, এর আগে রেশন চুরি করতো তারাই, যারা আব্বাজান বলে বের হত। সেই চুরি করা রেশন নাকি নেপাল আর বাংলাদেশে বিক্রি হত, সেসব নাকি বন্ধ হয়ে গেছে। দেশ জুড়ে নিন্দার ঝড় উঠল, মোদিজি চুপ আর আদিত্যনাথ তো তাই চেয়েছিলেন, এখবর ছড়িয়ে পড়ুক উত্তরপ্রদেশের গ্রামে গঞ্জে, তবে তো হবে মেরুকরণ, তবে তো ঝোলা ভরবে হিন্দু ভোটে। ভাবা যায়, এই উচ্চকিত প্রচারে এক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, ১৫০ জনের বেশি ক্রিমিনালকে গুলি করে মেরেছে পুলিশ, ৩০০০ এর বেশি আহত। ১৫০ টা এনকাউন্টার নিয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী আহ্লাদে ডগমগ, সেই মুখ্যন্ত্রীর দল অন্য রাজ্যে হিউম্যান রাইটস কমিশন পাঠায়! সেই প্রচার বইতেই লেখা হয়েছে বিমারু, অসুস্থ উত্তরপ্রদেশ এখন বিকাশের পথে, তথ্য বলছে, শিশুমৃত্যুর হার উত্তরপ্রদেশে সবথেকে বেশি, করোনার চিত্র তো আমরা দেখেইছি, সেখানে গর্ব করে বলা হচ্ছে যারা সি এ এ – এন আর সি আন্দোলনে রাস্তায় নেমেছিলেন, অবরোধ, ধর্ণায় অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাঁদের কাছ থেকে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির ক্ষতি ইত্যাদির অভিযোগে ক্ষতিপূরণ নেওয়া হয়েছে। ওই প্রচার বইতেই হিসেব দেওয়া হয়েছে, কতগুলো কসাইখানা বন্ধ হয়েছে, সেগুলোকে বে আইনী ঘোষণা করা হয়েছে, এবং রাজ্যে লভ জেহাদের কানুন আনা হচ্ছে। এরফলে হিন্দুনারীরা থাকবে সুরক্ষিত, এগুলো লুকিয়ে চুরিয়ে নয়, কোনও ধানাই পানাই নেই, নির্বাচনের মাস চার পাঁচ দেরি আছে, যোগীজি বুঝিয়ে দিতে চান, তাঁর পে ডিগ্রি, হিন্দুত্বের জয়পতাকা নিয়ে এক গেরুয়াধারী সারা উত্তরপ্রদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সংবিধান কী বলল, কী বলেছে তাতে তাঁর কিসসু যায় আসে না। একে একে পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মত, বিজেপি আর এস এস তাদের মুখোশ খুলে ফেলছে, অটলজী নাকি উদার ছিলেন, আদবানীজী কট্টর, বিয়ে করেছেন, মেয়ে বৌ নিয়ে সংসার, অবরে সবরে হিন্দী সিনেমা দেখেন, তিনি রামমন্দির যাত্রা শুরু করলেন। তাঁর উদার মুখোশ যখন খুলেই গেছে, তখন মঞ্চে মোদিজি, আরও বড় হিন্দু, বিয়ে করেছেন, সংসার করেন না। হিমালয়ের গুহায় গিয়ে গেরুয়া পরে ধ্যান করেন, মিঁয়া মুসররফ এর নাম করে মুসলমানদের টিটকিরি দেন, সিনেমার নায়ক নায়িকাদের সঙ্গে গল্পগাছা করেন। সিনেমা দেখেন বলে জানা নেই। এবার তাঁর রাজ্যপাটের দায়িত্বের দাবীদার হাজির, তিনি নিজেই হিন্দু সন্ন্যাসী, কনফোড় যোগী, সকালে গোমাতার সেবা করে দিন শুরু করেন। মঞ্চ থেকেই হাসতে হাসতে যারা আব্বাজান বলে, তাঁদেরকে চোর, ক্রিমিনাল বলেন, এনকাউন্টারের সংখ্যা লিখে দেন নির্বাচনী প্রচার বইতে, আন্দোলনকারীদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের কথা লিখে দেন ওই প্রচার বইতেই। সেই তিনি এক নতুন ক্ষমতার কেন্দ্র হয়ে উঠছেন, উঠেছেন। কাজেই ২০২২ এর গোড়ায় উত্তরপ্রদেশের নির্বাচন সবদিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ, একদিকে যোগীজি, অন্যদিকে বিরোধী দলের নেতারা, কৃষক আন্দোলনের নেতারা, মোদি – শাহ এখানে নিতান্তই দর্শক, যদি যোগী হেরে যান, তাহলে মোদিজির পরাজয় নিশ্চিত। যদি যোগীজি জিতে যান, তাহলে বিজেপিতে উত্থান হবে এই হিন্দু নেতার, সে বিজেপির চেহারা হবে আলাদা, সে বিজেপি হবে গোরখনাথ মন্দিরের এক মহন্তর। ইতিমধ্যেই যে মহন্তের ভক্তরা বলতে শুরু করেছেন, দেশের আগামী নেতা হবেন এক সন্যাসী, এক হিন্দু, সেদিন থেকে নাকি শুরু হবে রাম রাজত্ব!