কাবুল: চেঁচাইছিলি ক্যানে?
গুপির বেসুরো গান শুনে বলেছিলেন রাজামশাই। তারপর আছাড় মেরে ভেঙে ফেলেছিলেন গুপির বাদ্যযন্ত্রটি।
পাহাড়-ঘেরা একটি সুন্দর দেশ। নাম আফগানিস্তান। অচিরেই দেশটি সুরহীন, তালহীন, লয়হীন হতে চলেছে। তালিবরা মনে করে, ইসলামে সুরসাধনা নিষিদ্ধ। তাই ঘরে ঢুকে সুরের গলা টিপে ধরছে ওরা। তবলা, হারমনিয়াম, গিটার, পিয়ানো যার ঘরে যা আছে সব কিছু ভেঙেচুরে দিয়ে শুরু হয়েছে বর্বর উল্লাস। আমলকি গ্রামের রাজার মতোই পিঠে বন্দুক নিয়ে ওরা বলছে, চেঁচাইছিলি ক্যানে?
গুপি বাঘা সিনেমার দৃশ্য যেখানে রাজা ভেঙে দিয়েছে তানপুরা
ইসলামে কি সত্যিই সঙ্গীতসাধনা নিষিদ্ধ? যদি তাই হতো আমাদের দেশে এত মুসলমান সঙ্গীতশিল্পী বেঁচে রইলেন কী করে? এই উপমহাদেশে নামী উচ্চাঙ্গশিল্পীদের অধিকাংশই মুসলমান। তাঁদের বাদ্যযন্ত্র কেউ ভেঙে দিয়েছে বলে শুনিনি। সকাল-সাঁঝে সুকুমারমতি বালক-বালিকারা সুর সাধছে আর কেউ গিয়ে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে হারমনিয়াম—-মানব ইতিহাসে এর চেয়ে ভয়ঙ্কর দৃশ্য কেউ দেখেনি। অথচ সেটাই হচ্ছে আফগানিস্তানে। কারও কিছু বলার নেই। সব দেশই জল মাপছে। কেউ তো গিয়ে বলছে না, আমরা সঙ্গীতকে খুন হতে দেব না। কোথাও কি কেউ মিছিল করে বলছে, সুরের খুনি নিপাত যাক। বলছে না। ভিয়েতনাম, প্যালেস্টাইন, নিকারাগুয়া—কত দেশের পক্ষে তো আমরা মিছিল করেছি। কিন্তু সুরের হয়ে পথে নামছি না কেন? মানুষ যেদিন সুর ভুলে যাবে, সেদিন তার মৃত্যু আসন্ন। মৃত্যুর কিনারায় দাঁড়িয়ে আফগানভূম।
যে কোনও উন্মাদ শাসকই শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীতকে সহ্য করতে পারে না। সুর তাদের অস্থির করে তোলে। রাজদণ্ড হাত থেকে খসে পড়ে। ‘দেখো ভালো জনে রইল ভাঙা ঘরে/ মন্দ যে-জন সিংহাসনে চড়ে…।’ চরণদাসের গান শুনে ক্রোধে ফেটে পড়েছিল হীরকরাজ। কিন্তু সেই গান বাঁধা হয়েছিল বঞ্চনার বিরুদ্ধে। রাজার ক্ষেপে ওঠার তবু একটা কারণ ছিল। কিন্তু আফগানিস্তানে তো সঙ্গীতেই আপত্তি। রাজার পক্ষে বা বিপক্ষে বলে কিছু নেই। যেখানেই সুর, সেখানেই চালাও তাণ্ডব। তবলার চামড়ায় গেঁথে যাচ্ছে লকলকে ছুরি, গিটারের তার ছিঁড়ে প্রলম্বিত হাসিতে কাঁপিয়ে দিচ্ছে চরাচর। এ কী কাণ্ড! তুমি কেমন করে খুন করো হে খুনি!
লালবাজারের কাছে রবীন্দ্র সরণিতে যেখানে আমার আপিস, সেখানে অসংখ্য বাদ্যযন্ত্রের দোকান। ওই রাস্তা দিয়ে হাঁটলে মাঝে-মাঝেই বাঁশির আওয়াজ শোনা যায়। তবলা, হারমোনিয়াম, পিয়ানোর সুরও ভেসে আসে। এখানে যাঁরা দোকানদারি করেন, তাঁরা শুধুই দোকানদার নন, চমৎকার বাজনাও বাজাতে জানেন। দরাদরির ফাঁকেই তিনি বাঁশিতে ধুন শুনিয়ে দেবেন, কিংবা পিয়ানোয় রবীন্দ্রগানের সুর।
যদি কোনও দিন কোনও উন্মাদ বাঁশি ভেঙে ফেলে দেয় রাস্তায়, যদি কোনও দিন কেউ গিটারের বুকে ভরে রাখে টাইম বোমা, যদি কোনও দিন কেউ মাউথ অর্গানে মাখিয়ে রাখে তীব্র বিষ….তারপর অজেয় উল্লাসে এগিয়ে চলে রবীন্দ্রনাথের বাড়ির দিকে। এই ভদ্রলোকই তো লিখেছিলেন, ‘সুরের আলো ভুবন ফেলে ছেয়ে/ সুরের হাওয়া চলে গগন বেয়ে/ পাষাণ টুটে ব্যাকুল বেগে ধেয়ে/ বহিয়া যায় সুরের সুরধুনী…।
আরও পড়ুন: যুদ্ধ বিধ্বস্ত আফগানিস্তানে বেহাল স্বাস্থ্য, পাশে দাঁড়াল ‘হু’
এ অতি যন্ত্রণার দুঃস্বপ্ন। কোনও দিন দেখব না জানি। আফগানিস্তানেও সুর থাকবে। তালিবান তবলা ছিঁড়ে ফেলুক, গিটারের তারে ফাঁস দিয়ে থামিয়ে দিক কোনও বালকের প্রাণ। কিন্তু পাখির শিস বন্ধ করতে পারবে? কিংবা নদীর কুলুকুল শব্দ?
সুর কোন ফাঁক দিয়ে কোথায় চুঁইয়ে পড়ে, কেউ জানে না। হাজার পাখির শিসে হারিয়ে যাবে শাসকের উল্লাস।
আরও পড়ুন: পাক যুদ্ধবিমানের লাগাতার বোমা, পঞ্জশিরের গভর্নর হাউজে তালিবানের পতাকা