যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান (Afghanistan) থেকে আমেরিকার বেরিয়ে যাওয়ায়, ভারত এবং অন্যান্য প্রতিবেশী দেশগুলির উদ্বেগ এবং নিরাপত্তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে । কোনও সন্দেহ নেই যে তালিবান (Taliban) ‘মিত্র’ – চিন, পাকিস্তান এবং ইরান – বিদ্রোহী গোষ্ঠীর প্রতি তাদের সমর্থন বাড়িয়েছে । কিন্তু, সাবধানে । এখনও তালিবানকে স্বীকৃতি দেয়নি কেউ । সেনা প্রত্যাহারের প্রভাব শেষ হওয়ার পরে কোন দিকে বাতাস বইবে তাও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বেজিং-ইসলামাবাদ । তালিবান ‘মিত্র’রা আফগানিস্তানে নতুন সরকারের অপেক্ষায় রয়েছে, যারা এই অঞ্চলে বৃহত্তর শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ।
সেনা প্রত্যাহার শুরু হওয়ার পর থেকেই আমেরিকা ও তার মিত্ররা আফগানিস্তান থেকে তাদের জনগণকে বের করে আনতে হিমশিম খাচ্ছে । বিপরীতে, তালিবানরা গোপনে রাজধানী কাবুলে তাদের লোকজনের পদচারণা বৃদ্ধি করেছে, বিশেষ করে কাবুল বিমানবন্দরের হামলার পর, যাতে পরিস্থিতির পুরোপুরি তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। এটা মনে রাখতে হবে, তালিবানের ‘দ্বিতীয় আচরণ’ ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিক থেকে দৃশ্যত ভিন্ন । জবিউল্লাহ মুজাহিদের সাংবাদিক সম্মেলন থেকে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, তাঁরা সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে মোকাবিলা করতে শিখেছেন । তাঁরা ‘পারসেপশন ম্যানেজমেন্ট’-ও শিখেছেন ।
মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর তালিবানদের শক্তি ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে-পাচ্ছে । যা অন্য জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে কঠিন শর্তে আলোচনায় তাদের আস্থা জুগিয়েছে । আফগানিস্তানের আশেপাশের বেশির ভাগ দেশই বিদ্রোহের মুখোমুখি হচ্ছে । চিনের উইঘুর, ইরানের আইএস, পাকিস্তানের টিটিপি, অথবা কাশ্মীরের ভারত থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদ । যদিও ভারত ছাড়া এই দেশ গুলি তালিবানদের প্রতি তাদের আনুগত্য দেখিয়েছে এবং একই সঙ্গে নিজ দেশে বিদ্রোহ নিয়ে উদ্বিগ্ন ।
আরও পড়ুন: খাদের কিনারে অর্থনীতি, শীঘ্রই সরকার গঠনের আহ্বান তালিবানের
কাশ্মীরে টহল দিচ্ছেন জওয়ানরা (ফাইল চিত্র)
চিনের জন্য বাদাকশান প্রদেশ একটি মাথাব্যথা । যেখানে ইটিআইএম (ইস্টার্ন তুর্কিস্তান ইসলামিক মুভমেন্ট) সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্র এবং তার বন্ধুদের বিরুদ্ধে তালিবানদের হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছে । ইটিআইএম চিনের জিনজিয়াং প্রদেশের উইঘুর মুসলমানদের জন্য লড়াই করে । বদাকশান চিনের জিনজিয়াং প্রদেশের সঙ্গে প্রায় 95 কিলোমিটার সীমান্ত ভাগ করে নিয়েছে । একই ভাবে চেচেন যোদ্ধাদের ককেশাস এমিরেটস রাশিয়ার জন্য উদ্বেগের কারণ ।
আরও পড়ুন: লন্ডভন্ড কাবুল বিমানবন্দরের কন্ট্রোলরুম, সারাতে টেকনিক্যাল টিম উড়িয়ে আনল তালিবান
লাগামহীন তেহরিক-এ-তালিবান এক দশকেরও বেশি সময় ধরে পাকিস্তানকে নেতৃত্ব দিয়েছে এবং যথেষ্ট খুন-খারাপি ও অর্থনৈতিক ক্ষতি করেছে । স্বাভাবিক ভাবেই এই জঙ্গি গোষ্ঠীটি সাধারণ পাকিস্তানিদের জন্য একটি বড় নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ তৈরি করেছে । কারণ, সেখানে প্রকাশ্যে-ধর্মীয় স্থানে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে একাধিক রক্তপাত ঘটিয়েছে ।
সর্বোপরি, দিল্লির চিন্তা সব থেকে বেশি বেড়েছে । তালিবানের সঙ্গে তাদের কোনও ঘনিষ্ঠ বা দূরবর্তী সম্পর্ক নেই । এই গোষ্ঠীটি পাকিস্তানের আইএসআই -এর নির্দেশে বা তার সামরিক সাহায্যে জঙ্গি কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে । কাশ্মীরের দিকে জঙ্গিদের বরাবরই একটি আলাদা নজর চোখে পড়েছে । এর আগে, আফগানিস্তানে যখন তালিবান শাসন ছিল তখন দিল্লি মাসুদ আজহারের মতো জঙ্গি নেতাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল । পর্তুগিজ পাসপোর্টে প্রবেশের পর নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে কাশ্মীরে আজহারকে গ্রেফতার করা হয়েছিল । কিন্তু, সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় । প্রথমে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান ছিনতাই । এর পর মুক্তিপণ হিসেবে জইশ জঙ্গিকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় কেন্দ্র ।
মোদির সঙ্গে আলোচনায় কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি (ফাইল চিত্র)
আজহারের মুক্তি ভারতের বিরুদ্ধে জঙ্গিদের পুনর্গঠন এবং কৌশল গঠনে খুবই বড় হয়ে দেখা দেয় । লস্কর এবং হিজবুল মুজাহিদিনের মতো অন্যান্য গোষ্ঠীর বিপরীতে আজহার সীমান্ত এলাকা থেকে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয় । জইশের প্রতিষ্ঠাতা এবং তার সহযোগীরা এই অঞ্চলে খুব বেশি লাভ করতে পারেনি কারণ বহু বছর ধরে অশান্তি এবং জম্মু-কাশ্মীরে রাষ্ট্রপতি শাসনের পর সরকার গঠন এক কঠোর শৃঙ্খলায় বেঁধে দিয়েছিল উপত্যকাকে । এখন জইশ কমান্ডার মাসুদ আজহার কাশ্মীরের বিদ্রোহীদের সমর্থনের জন্য তালিবানদের সঙ্গে আলোচনা করছে । তালিবান নেতৃত্বের সঙ্গে দেখা করার জন্য কান্দাহারে পা রাখতে দুই বার ভাবেনি ।
আরও পড়ুন: কাশ্মীর আমাদের এক্তিয়ারে নয়, জঙ্গি গোষ্ঠীকে সহযোগিতা না করার আশ্বাস তালিবানের
কাশ্মীরের বর্তমান পরিস্থিতি মোটেই ১৯৯০-এর মতো নয় । স্থানীয় অনেক নেতাই কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আস্থা হারিয়েছেন । যে সব নেতা আগে দিল্লির সুরে সুর মিলিয়ে কথা বলতেন, আজ তাদের মুখেই বিচ্ছিন্নতাবাদী স্বর । দিন কয়েক আগেই মেহবুবা মুফতির মতো নেতাদের মুখে কেন্দ্র বিরোধী কথা শোনা গিয়েছে ।
তারা হয়তো কেন্দ্রীয় নেতাদের কথা আর বিশ্বাস করেন না । এই সব নেতাদের বক্তব্য বুঝিয়ে দিচ্ছে কোনও ভাবেই তারা দিল্লির পক্ষে নন । অগস্ট 2019-এর পর কাশ্মীরে তৈরি হওয়া জনরোষ ছাইচাপা আগুনের মতো রয়েছে । 370 ধারা বিলোপ-সহ কেন্দ্রীয় সরকারের একাধিক ভ্রান্ত নীতির ফলে বিক্ষুব্ধ তরুণদের প্রভাবিত করা পাকিস্তানের জঙ্গি নেতাদের পক্ষে কোনও বড় সমস্যা নয় । মনে রাখতে হবে, আজহারের জইশ-এ-মহম্মদ 2000 সালে শ্রীনগরের একটি সেনা ঘাঁটিতে হামলার জন্য সেখানকার এক যুবককে ব্যবহার করেছিল । সেটাই ছিল কাশ্মীরে ফিদায়েঁ (আত্মঘাতী) হামলার সূচনা ।
মোল্লা আব্দুল গনি বরাদরের নেতৃত্বেই আফগানিস্তানে সরকার গড়তে চলেছে তালিবান (ফাইল চিত্র)
বিশ্লেষকদের মত, আবার নতুন করে পাশতুন অঞ্চল বিদ্রোহীদের জন্য আস্তানা হয়ে ওঠার আগে দিল্লিকে তালিবানদের রোখার একটি পরিকল্পনা করতে হবে । একই সঙ্গে কাশ্মীরের নেতৃত্বের হারানো বিশ্বাস অর্জন করতে হবে । কাশ্মীরের বিদ্রোহীদের কার্যকারিতার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার জন্য স্থানীয় প্রশাসনের একটি পরিকল্পনা করতে হবে ।
আরও পড়ুন: আমেরিকার কাছ থেকে অর্থ নিয়ে তালিবানকে মদত জুগিয়েছে পাকিস্তান: আমেরুল্লাহ সালেহ
এখানেই দিল্লির বিদেশ নীতির দূরদর্শিতা । বিদেশ নীতি বিশেষজ্ঞ এবং আলোচকদের কূটনৈতিক দক্ষতার উপর নির্ভর করবে কী ভাবে তারা তালিবানদের কাশ্মীরে ঢোকার আগেই আটকাতে পারে ।