মধুরেণ সমাপয়েৎ।
ইস্ট বেঙ্গলের সঙ্গে শ্রী সিমেন্টের মনোমালিন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হস্তক্ষেপে মিটে গেল বুধবারই। যার ফলে এ বছরের আই এস এল-এ ইস্ট বেঙ্গলের খেলার ব্যাপারে কোনও বাধা রইল না। বৃহস্পতিবার থেকেই দল গড়তে নেমে পড়বে শ্রী সিমেন্ট। কোচ রবি ফাউলারের সঙ্গে তাদের দু বছরের চুক্তি আছে। তাই কোচ নিয়োগ নিয়ে কোনও সমস্যা হওয়ার কথাই নয়। তাঁর পরামর্শেই বিদেশি ফুটবলার রিক্রূট করা হবে। কিন্তু ভাল বিদেশি কি পাওয়া যাবে? এ ব্যাপারে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।
প্রশ্ন উঠতে পারে যে সমস্যা গত আট মাসে মিটল না সেটা কী করে দশ মিনিটের মধ্যে মিটে গেল? মুখ্যমন্ত্রী কি ম্যাজিক জানেন? না, সে সব কিছুই নয়। গত বছর যে টার্ম শিটের উপর সই করে ইস্ট বেঙ্গল খেলেছিল সেই টার্ম শিটের উপরে ভর করে এবারও তারা খেলবে। দু পক্ষের মধ্যে সমস্যা হচ্ছিল এগ্রিমেন্ট নিয়ে। শ্রী সিমেন্ট থেকে বারবার জোর দেওয়া হচ্ছিল এগ্রিমেন্টের সই করার উপরে। কিন্তু ইস্ট বেঙ্গল ক্লাব থেকে বার বার বলা হচ্ছিল যে টার্ম শিটের সঙ্গে এগ্রিমেন্টের তফাত আছে। তারা টার্ম শিটের সব শর্ত মেনে নিয়েছে। এখনও সেটা মানতে চায়। কিন্তু এগ্রিমেন্টে যে সব শর্ত আছে তা মানা সম্ভব নয়। যার মধ্যে একটি ছিল যে ইস্ট বেঙ্গল তাঁবু, মাঠ, গ্যালারির সত্ত্ব লিখে দিতে হবে শ্রী সিমেন্টের নামে। শেষ পর্যন্ত ইস্ট বেঙ্গল সেটা কিছুতেই মেনে নিতে চায়নি। এবং তাদের সেই জেদই বজায় রইল। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে ইস্ট বেঙ্গল বার বার জোর দিয়েছে টার্ম শিটের উপরে। মুখ্যমন্ত্রীও সেটাকে মান্যতা দিয়েছেন। তাই শ্রী সিমেন্টের প্রতিনিধিরা এগ্রিমেন্ট নিয়ে কথা বলার সুযোগই পাননি। আপাতত দু পক্ষই মেনে নিয়েছে যে যার ভিত্তিতে গত বছর খেলা হয়েছিল এ বছরও সেই টার্ম শিটের ভিত্তিতেই খেলা হবে।
বুধবার ইস্ট বেঙ্গলের পক্ষ থেকে নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর সভায় উপস্থিত ছিলেন দেবব্রত সরকার, সদানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি মুখ্যমন্ত্রীর দাদা। আর শ্রী সিমেন্টের প্রতিনিধি ছিলেন তাদের কোম্পানি সেক্রেটারি শ্রী খান্ডেলওয়ালা এবং আরও দুজন। বৈঠকের শেষে দু পক্ষের প্রতিনিধিরা আনন্দের সঙ্গেই করমর্দন করেন। এখানে একটা খটকা আছে। যে শ্রী সিমেন্ট সোমবারই মুখ্যমন্ত্রীকে ই মেল করে জানিয়ে দিয়েছিল যে তারা আর ইস্ট বেঙ্গলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চায় না। এবং কোনও রকম শর্ত ছাড়াই তারা স্পোর্টিং রাইটস ইস্ট বেঙ্গলকে ফিরিয়ে দেবে। সেই শ্রী সিমেন্ট কেন আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে নিজেদের অবস্থান বদলে আই এস এল খেলতে রাজি হল? শ্রী সিমেন্ট ইস্ট বেঙ্গলকে স্পোর্টিং রাইটস ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটা মেল করে মুখ্যমন্ত্রীকে জানায়। এবং তাতে মুখ্যমন্ত্রী প্রচণ্ড বিরক্ত হন। এবং আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে দু পক্ষকে নিয়ে বৈঠকের কথা বলেন। ইস্ট বেঙ্গল তো বহু দিন ধরেই সমস্যা মেটানোর ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ প্রার্থণা করে আসছিল। তাদের প্রাক্তন ফুটবলাদের সংগঠনও চাইছিল মুখ্যমন্ত্রী সমস্যা মেটান। কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক মুখ্যমন্ত্রী ক্লাব কিংবা তাদের প্রাক্তনীদের ডাকে সাড়া দেননি। কিন্তু শ্রী সিমেন্ট তাঁকে মেল করতেই তিনি নড়েচড়ে বসলেন এবং দশ মিনিটের মধ্যে সমস্যার সমাধান করে দিলেন।
প্রশ্ন উঠতেই পারে যে শ্রী সিমেন্ট এত দিন এগ্রিমেন্টে সই করা নিয়ে ঝুলোঝুলি করল তারা কেন টার্ম শিটের ভিত্তিতে খেলতে রাজি হয়ে গেল। আসলে শ্রী সিমেন্টের মূল ব্যবসা ফুটবল নয়। তারা সিমেন্টের কারবারী। তাদের ব্যবসা মূলত উত্তর এবং পশ্চিম ভারতে। কিন্তু এখন তারা পূর্ব ভারতেও তাদের ব্যবসা বাড়াতে চায়। সে জন্য কয়েক মাস আগেই তারা পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরে ৬০০ একর জমি কিনেছে। সেখানে তাদের সিমেন্টের কারখানা গড়ার কাজ শুরু হয়ে গেছে। পাশপাশি বাঁকুড়া জেলাতেও তারা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করতে চায়। তার প্রোজেক্ট রিপোর্টও তৈরি হয়ে গেছে। জমি কিনে কাজ শুরুও হবে তাড়াতাড়ি। পুরুলিয়া এবং বাঁকুড়ার জমির ব্যাপারে তারা রাজ্য সরকারের সহায়তা নেয়নি বা নেবে না। তবে শুধু তো জমি দিয়ে এত বড় প্রোজেক্ট চালু করা যায় না। আরও অনেক ব্যাপার আছে যেখানে সরকারি সাহায্য দরকার হয়। তাই নিজেদের ব্যবসার খাতিরেই শ্রী সিমেন্টকে মুখ্যমন্ত্রীর সামনে নীচু হতে হল। যে এগ্রিমেন্ট নিয়ে গত দশ মাস ধরে তারা ঝুলোঝুলি করল তা নিয়ে কোনও রকম বাক্যব্যয় না করে তারা শুধু টার্ম শিটের ভিত্তিতেই খেলতে রাজি হয়ে গেল।
সেক্ষেত্রে কি জয় হল ইস্ট বেঙ্গলের? বাস্তব দৃষ্টিতে সে রকম মনে হলেও ইস্ট বেঙ্গল কিন্তু সে রকম কিছু ভাবছে না। শীর্ষ কর্তা দেবব্রত সরকার নবান্ন থেকে ফিরে ক্লাব তাঁবুতে বসে বললেন, ” সব কিছুরই একটা নেগেটিভ দিক থাকে। আর একটা পজিটিভ দিক থাকে। পজিটিভ দিকটা পেতে গেলে ধৈর্য ধরতে হয়। আমরা ধৈর্য ধরে ছিলাম। তাই পজিটিভ দিকটা দেখতে পেলাম।’ আর কী বলছেন শ্রী সিমেন্ট ইস্ট বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের সি ই ও শিবাজি সমাদ্দার? শিবাজিবাবু প্রথমেই ধন্যবাদ দিলেন মুখ্যমন্ত্রীকে। বললেন, “মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে যে ঝামেলা মিটে গেল এর জন্য অজস্র ধন্যবাদ ওনাকে। আর আমাদের কাজ এখন ভাল করে টিমটা করা। সেই কাজ আমরা অবিলম্বে শুরু করব।”
অতএব সব পক্ষেই এখন শান্তির আবহ। এফ এস ডি এল চাইছিল ইস্ট বেঙ্গল যেন আই এস এল খেলে। স্টার স্পোর্টস চাইছিল ইস্ট বেঙ্গল যেন খেলে। শ্রী সিমেন্টও যে খেলতে চাইছিল না তা নয়। কিন্তু ক্লাবের মালিকানা বিনা পয়সায় নেওয়ার দুঃস্বপ্ন দেখতে গিয়েই নিজেদের সমস্যা নিজেরাই তৈরি করে ফেলল। এখন তার খেসারত তাদেরই দিতে হবে। এত দেরিতে মাঠে নেমে ভাল বিদেশি কিংবা স্বদেশি প্লেয়ার তারা পাবে না। কোচ অবশ্যই ভাল। কিন্তু খেলবে তো প্লেয়াররাই। তাই ইস্ট বেঙ্গল মাঠে নামবে। কিন্তু ফল ভাল হবে না। এটা প্রথম দিন থেকেই সমর্থকদের মাথায় রাখা ভাল। গত বছর এগারো দলের লিগে ইস্ট বেঙ্গল নবম স্থান পেয়েছিল। এবার তার চেয়ে যদি ভাল হয় তা হলেই অনেক।
তবে আপাতত এ সব ভাবার অবকাশ নেই। ইস্ট বেঙ্গল যে আই এস এল খেলবে সেটাই বড় খবর। স্বস্তির খবর। শান্তির খবর।