অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও আম আদমি পার্টির পতন, এক আদর্শহীন রাজনীতির অবধারিত পরিণতি, এইভাবেও আলোচনাটা শুরু করা যায়। কিন্তু অমন এক দল যারা অভিষেকেই এক অন্য রাজনীতির কথা বলে আলোড়ন তুলেছিল গোটা দেশে, ক’দিন আগে পর্যন্ত বিভিন্ন সমীক্ষাতে জানানো হত যে প্রধানমন্ত্রী পদে অরবিন্দ কেজরিওয়াল কত মানুষের সমর্থন পাচ্ছেন। এমন নয় যে সেই সংখ্যা বিরাট ছিল, কিন্তু তাঁর নাম তো ছিল, অশোক গেহলট বা ওমর আবদুল্লা বা পিনারাই বিজয়নের নাম তো ছিল না। সেই দল কপ্পুরের মতো উবে যাবে? হ্যাঁ, এই তথ্যগুলো দিয়েই অরিন্দম শীল ‘কর্পূর ২’, নতুন ছবিও বানাতেই পারেন। ২০১১ সালের অন্না আন্দোলনের পর, মিটিওরিক রাইজ, এক উল্কার গতিতে ভারতের রাজনৈতিক আকাশে আত্মপ্রকাশ করেছিল এক নতুন শক্তি— আম আদমি পার্টি (AAP)। দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনের ঢেউয়ে ভেসে উঠে আসা এই দল শুরুতে নিজেকে জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে তুলে ধরেছিল, বলেছিল আমরা আম আদমির দল, ম্যাঙ্গো পিপল-এর দল। রাজনীতি থেকে আদর্শের মৃত্যু ঘটছে, বলতে চাইছি আসলে রাজনীতি থেকে মূল্যবোধের মৃত্যু ঘটেছে এই ধারণার বিরুদ্ধে এক ধরনের রেজারেকশন, এক প্রত্যাবর্তন বলেই দেখা হচ্ছিল তাদের উত্থানকে। অরবিন্দ কেজরিওয়াল, একজন সাবেক আমলা, যিনি এক সময় দিল্লির বুকে শতাব্দী প্রাচীন কংগ্রেস আর বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই করে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন, তাকিয়ে দেখুন তিনি আজ আর নিজের শহরেই থাকেন না, তাঁকে খুঁজতে হলে আপনাকে যেতে হবে দিল্লির বাইরে।
দিল্লিতে আম আদমি সরকারের জনগণের জন্য বানানো সেই ‘দিল্লি মডেল’ আজ খণ্ডহর বললেও কম, এক ধ্বংসস্তূপের কিনারায়। আম আদমি পার্টি এখন দিল্লিতে হারাচ্ছে ঘর, হারাচ্ছে লোক, হারাচ্ছে কৌলিন্য। এবং এর নেতৃত্বের ভূমিকায় থাকা কেজরিওয়াল এখন পাঞ্জাবে ব্যস্ত, যেন দিল্লির প্রতি তার আর কোনও দায় নেই। কে যেন বলেছিলেন দিল্লি কা লাড্ডু যো খায়া ওহ পছতায়া, যো নহি খায়া ওহ ভি পছতায়া। অরবিন্দ কেজরিওয়াল অবশ্য লাড্ডু খেয়েছিলেন। এক সময়ের ‘বিকল্প রাজনীতি’র চূড়া থেকে পতন এই ইতিহাসটা দেখুন, আর এইখানেই আসল প্রশ্ন হচ্ছে— এক রাজনৈতিক দল যার জন্ম হয়েছিল একটি নৈতিক সংকল্প থেকে, বিশাল করে সেই মরাল গ্রাউন্ডের কথা বলা হয়েছিল, যাঁদের মনে নেই, তাঁদের মনে করিয়ে দিই। আম আদমি পার্টি থেকে বলা হয়েছিল, এই দলে তাঁরাই প্রার্থী হবে যাঁদের সেই এলাকার মানুষেরা পছন্দ করবে, মানুষের সামান্যতম বিরোধিতা থাকলে তারা প্রার্থী হবে না। এই দল জানিয়েছিল চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে দেওয়া হবে সব হিসেব নিকেশ। এই দল জানিয়েছিল দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেই তাকে পদত্যাগ করতে হবে, সেসব নৈতিকতা যমুনার জমে থাকা পচা খালে ভেসে গেছে। কিন্তু তা এত দ্রুত পথ হারাল কেন? শুরুতে AAP রাজনীতি মানেই অ্যাবসিলিউট ট্রান্সপ্যারেন্সি, ১০০ শতাংশ স্বচ্ছতা, ভরসা, আর জনমুখী সরকার গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। না, তারা কোনও আদর্শের কথা বলেনি, বলেনি যে আমরা সাম্যবাদী, সমাজতন্ত্রী, বলেনি যে তারা গান্ধীবাদী, বলেনি যে তারা কোনও নির্দিষ্ট মতামতকে ধরে এগিয়ে যেতে চায়।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | ভারত বিরোধী ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন দেশের স্বাধীনতা কেড়ে নিতে চায়
কিন্তু কেবল দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়ব, মানুষের কাজ করব এই প্রতিশ্রুতি দিয়েই ২০১৫ সালে কেজরিওয়াল নেতৃত্বাধীন AAP দিল্লির ৭০টি আসনের মধ্যে ৬৭টি আসন পেয়ে এক ঐতিহাসিক জয় অর্জন করে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলেছিলেন, এটা ‘রাজনীতির গণঅভ্যুত্থান’। কিন্তু তার ঠিক এক দশক পরে দলটি এখন আত্মরক্ষায় ব্যস্ত। রাজ্যে গোহারান হেরেছে, মিউনিসিপাল কর্পোরেশন অফ দিল্লিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে, একের পর এক কাউন্সিলর দল ছেড়ে চলে গিয়েছেন, সাংগঠনিক স্তরে ধস নামছে আর ঠিক তখন কেউ নেই। কোথায় মণীশ সিসোদিয়া? রাঘব চাড্ডা? কোথায় অরবিন্দ কেজরিওয়াল? নেতৃত্বের অনুপস্থিতি স্পষ্ট, আরও স্পষ্ট তাদের হতাশা। দিল্লি, যা নাকি AAP-এর জন্মভূমি, আজ কার্যত কেজরিওয়ালশূন্য। তিনি আর সাংবাদিক সম্মেলনে আসেন না, বিক্ষোভে দেখা দেন না, রাস্তায় নেমে সরকারি নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলেন না। জুন মাসে যখন অতিশীকে পুলিশ তুলে নিয়ে যায়, তখন তিনি দিল্লিতে ছিলেন না, ছিলেন পাঞ্জাবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় একটিমাত্র বিবৃতি ছাড়া আর কিছুই করেননি। মানে বিবৃতি দিয়েই দায় খালাস। অথচ একসময় তিনিই ছিলেন সেই মুখ্যমন্ত্রী, যিনি মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিযোগ শুনতেন, সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে একের পর এক চাঞ্চল্যকর অভিযোগ তুলতেন।
সেই কেজরিওয়াল এখন যেন নিজের অতীত সত্তাকেই অস্বীকার করছেন। এবং যা করছেন তা মানুষের সামনে খুব স্পষ্ট, তিনি পাঞ্জাবে ভবিষ্যৎ খোঁজার কৌশল নিয়ে ব্যস্ত, কারণ জানেন পাঞ্জাব চলে গেলে এমএলএ পেনশন ছাড়া আর কিছুই পড়ে থাকবে না। তাই দিল্লিতে জনপ্রিয়তা হারানোর পর কেজরিওয়াল পাঞ্জাবে নতুন রাজনৈতিক সমর্থন ভূমি তৈরি করতে চাইছেন। কিন্তু পাঞ্জাবে কংগ্রেসও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। কেজরিওয়ালের অতিসক্রিয়তা সেখানে ‘দিল্লিওয়ালা হস্তক্ষেপ’ বলে দেখা হচ্ছে, যা পাঞ্জাবের আঞ্চলিক গর্বের সঙ্গে তৈরি করছে নতুন সংঘাত। পঞ্জাব আপ বিধায়কদের বড় অংশ না হলেও, এক অংশের বক্তব্য এটা অনধিকার চর্চা। উনি দিল্লিতে ডুবিয়েছেন, এবারে পঞ্জাবে দলকে ডোবাতে এসেছেন। এই গুঞ্জন থামাতে কেজরিওয়ালকে রীতিমতো গুপ্তচর বাহিনী তৈরি করতে হয়েছে। তিনি খুব ভালো করেই জানেন যে যদি পাঞ্জাবেও তারা ক্ষমতা হারায়, তাহলে AAP কার্যত অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। কারণ দিল্লি তারা ইতিমধ্যেই হারিয়েছে। তখন তারা জাতীয় দলের স্বীকৃতিও হারাতে পারে। আর্থিক দিক থেকেও সমস্যায় পড়বে। দলের সম্প্রসারণের উচ্চাকাঙ্ক্ষা মুখ থুবড়ে পড়বে, ইন ফ্যাক্ট সম্প্রসারণের কথা আপ নেতারা আর ভাবছেও না, গুজরাটে সদ্য জেতা আসনের বিধায়ক নাকি বিজেপি মন্ত্রীর বাড়িতেই বৈঠক সেরেছেন,
আসলে আদর্শহীন এক দলে মূল্যবোধও যখন ক্ষয়ে যায়, তখন তাদের দরকার হয় এক ক্যারিশম্যাটিক নেতা, যিনি জয় এনে দেবেন, কিন্তু সেই জয় এনে দিতে না পারলে দলে থাকার অর্থ খুঁজে পান না ওই দলের নেতারা। হ্যাঁ, আদর্শহীনতাই পতনের মূল কারণ, AAP-এর সবচেয়ে বড় সংকট আদর্শহীনতা। দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন থেকে উঠে এলেও, দলটি আদর্শগত অবস্থান গড়ে তুলতে পারেনি। কোন অর্থনীতিকে তারা সমর্থন করে? তাদের জাতিগত বা ধর্মীয় রাজনীতি নিয়ে অবস্থান কী? কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক বা ফেডারেল কাঠামো নিয়ে তাদের নীতিগত দর্শন কী? এই প্রশ্নগুলোর কোনও সুস্পষ্ট উত্তর নেই। একটা সময় কেজরিওয়াল হিন্দু ভোট টানতে হনুমান চালিসা পড়ে প্রচারে গিয়েছেন, আবার অন্য সময় সংখ্যালঘু ভোটারদের মন জেতার জন্য উল্টো বক্তব্য রেখেছেন। এই দ্বিচারিতা মানুষ টের পেয়েছে। রাজনৈতিক সুবিধাবাদের জন্য একের পর এক রণনীতিগত ইউ-টার্ন দলটির বিশ্বাসযোগ্যতাকে ধ্বংস করেছে। ভারতের রাজনীতিতে উল্কাগতি উত্থান ও পতনের চক্র নতুন তো কিছু নয়। আপ-ই একমাত্র দল নয়, যারা এই পরিণতির মুখোমুখি।
অতীতে চরণ সিংয়ের লোক দল, দেবগৌড়ার জনতা দল, কিংবা রাজ ঠাকরের এমএনএস— এইসব দলও এক সময় আলোচনার কেন্দ্রে ছিল, কিন্তু আদর্শ, সাংগঠনিক কাঠামো ও দীর্ঘমেয়াদি ভিশনের অভাবে হারিয়ে গেছে। ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে, কেবল ক্ষোভ বা আবেগের উপর ভর করে কোনও দল টিকে থাকতে পারে না। শক্ত সংগঠন, আদর্শ ও জনগণের সঙ্গে স্থায়ী সম্পর্ক না থাকলে, যে কোনও দল এক সময় হারিয়েই যায়। AAP-এর পতন কেবল এক দলের পতন নয়, এটি ভারতের রাজনৈতিক সংস্কৃতির এক পাঠ, কেবল চটকদারি কথা বলে মানুষকে আজ বোকা বানানো কঠিন, আরও কঠিন যখন মানুষ এক ট্রানজ্যাকশনাল পলিটিক্স বুঝে ফেলেছে। আমার জন্য কী করেছেন? আমরা কী পেয়েছি? এগুলো আজ সাধারণ মানুষ ভাবে, তারপরে ইভিএম-এর বোতাম খুঁজে নেয়। রাজনীতিতে ‘বিকল্প’ গড়ে তোলা সহজ নয়, এবং সেটি ধরে রাখা আরও কঠিন। কেজরিওয়াল যদি সত্যিই জনতার নেতা হয়ে উঠতেন, তবে এই সময় তিনি দিল্লিতে থাকতেন, মানুষের পাশে দাঁড়াতেন, দলকে ধরে রাখতেন। তিনি তো মমতার পরিচিত, একটু জেনে নিতে পারতেন, হয় এবার নয় নেভার বলার পরে ২০০১ সালে তৃণমূল-কংগ্রেস জোটে লড়ে তৃণমূল এই বাংলাতে ৬০টা, হ্যাঁ মাত্র ৬০টা আসন পেয়েছিল। হেরে যাওয়ার পর ভোট লুঠ ইত্যাদি হাজার একটা অভিযোগ তুলেও তিনি রাস্তা ছাড়েননি। লড়ে যাচ্ছেন তেজস্বী যাদব, লড়ছেন অখিলেশ যাদব, মার খেয়ে জেলে গিয়েও লড়েছেন চন্দ্রবাবু নাইডু। কিন্তু কেজরিওয়ালকে দেখুন পালিয়েছেন দিল্লি ছেড়ে, তিনি পাঞ্জাবকে বেছে নিয়েছেন— যেখানে হয়তো শেষ ভরসার জায়গা খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু ইতিহাস বলে, যারা নিজের ঘর ছেড়ে পালায়, তারা বাইরেও বেশিদিন ঠাঁই পায় না। না, নিদান হেঁকে দিচ্ছি না, রাজনীতি আর ক্রিকেটে কখন যে কী হয়, কেউ জানে না, AAP-ও হয়তো এখনও পুরোপুরি শেষ হয়নি, কিন্তু স্পষ্টতই তারা সেই পথেই হাঁটছে— যে পথ ভারতের অনেক ‘আন্দোলনজাত’ দলের শেষকৃত্যের মিছিল হয়ে গেছে।
দেখুন খবর: