এই দুনিয়ায় দু’ ধরনের সরকার আছে, আমি সরকারের গঠন নিয়ে বা বলা যাক কাঠামো নিয়ে কথা বলছি। ১) যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার, ফেডেরাল গভর্নমেন্ট ২) কেন্দ্রীয় সরকার বা ইউনিয়ন গভর্নমেন্ট। প্রথমটা হল বহু অঞ্চল, বহু রাজ্য নিয়ে এক রাষ্ট্রীয় কাঠামো, যেখানে প্রত্যেকটা অঞ্চলের নিজেদের পতাকা আছে, অভ্যন্তরীণ নিয়ম কানুন আছে, এমনকী নিজেদের আলাদা হয়ে যাওয়ার অধিকারও আছে। এরকম একটা কাঠামোকে বলা হবে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার। উদাহরণ অধুনা বিলুপ্ত সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্র, আজারবাইজান থেকে জর্জিয়া হয়ে বেলারুশ, উজবেকিস্তান। প্রত্যেকের আলাদা পতাকা ছিল, সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্র থেকে আলাদা হওয়ার ক্ষমতাও ছিল, সেই কারণেই ১৯৮৯ থেকে সোভিয়েতের এইসব অংশগুলো সংবিধান মেনেই আলাদা হতে পেরেছিল। বা ধরুন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের কথা। সেও একইরকম। যেমন ধরুন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে মারিজুয়ানা, মারিজুয়ানা জানেন তো? এক ধরনের নেশার জিনিস, তো সেই মারিজুয়ানা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় যদি যান তাহলে কেউ কিচ্ছুটি বলবে না, আসুন বসুন তামুক খান জল খান গোছের ব্যাপার। কিন্তু যদি আলাবামাতে যান তাহলে কেলেঙ্কারি, জেলে যেতে হতে পারে। আমাদের দেশেও আছে, বিহারে গুজরাটে মদ চলবে না বাংলায় কেরালায় দিব্যি চলবে। তবে গুজরাটে যদি আপনাকে ডাক্তার লিখে দেন তাহলে চলবে, মানে ডাক্তার লিখে দেবেন যে মদ না খেলে এই ব্যক্তি অসুস্থ হয়ে পড়বে, অতএব আপনি ছাড় পাবেন, বিহারে ডাক্তারবাবুর কথাও শুনছে না। কিন্তু আমাদের রাজ্যগুলোর আলাদা পতাকা নেই, কাশ্মীরের ছিল, ৩৭০ ধারা তুলে দেওয়ার পর সেটাও গেছে। আমেরিকার প্রত্যেকটা ফেডেরাল সরকারের নিজেদের পতাকা আছে, যেমনটা সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রে ছিল।
দ্বিতীয়টা হল কেন্দ্রীয় সরকার, ধরুন চীন, কিউবা, বার্মা, উত্তর কোরিয়া। কেন্দ্রে একটা সরকার আছে, তারাই নিয়ম কানুন পাশ করে, তারাই লাগু করে, নিয়ম এক, আইন এক, শাসক এক, সংবিধান এক।
এবার আমাদের দেশের কথায় আসি। আমাদের দেশে একদিকে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো আছে, আবার একটা শক্তিশালী কেন্দ্রও আছে। রাজ্যের হাতে কিছু অধিকার আছে, কিছু বিষয় আছে যে বিষয়ে তাদের কথাই শেষ কথা, আবার কেন্দ্রের কাছে কিছু বিষয় আছে যা তাদের বিষয় সেখানে তারাই শেষ কথা বলবে। এখানেই শেষ নয়, কিছু বিষয় আছে যা নিয়ে দুজনেই আইন তৈরি করতে পারে নিজেদের মতো লাগুও করতে পারে। আর আইন তো জানেন এক অদ্ভুত জিনিস, আইন কোনও অজড় অমর অক্ষয় বস্তু নয়, আইনকে যেভাবে ব্যাখ্যা করা হবে আইন সে ভাবেই চলবে। এইখানেই গন্ডগোল। আমাদের সংবধান রচনা যাঁরা করেছিলেন, তাঁদের মাথায় ছিল আমাদের দেশের বাস্তব পরিস্থিতি। এত ভাষা, এত ধর্ম, এত বৈচিত্র্য সর্বত্র। তাঁরা বুঝেছিলেন যে চাপিয়ে দিতে গেলেই কেলেঙ্কারি হবে। তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে যেমন জোর দিয়েছিলেন, তেমনই একটা শক্তপোক্ত কেন্দ্রীয় সরকার তৈরি করার কথাও বলেছিলেন। এটা আমাদের সংবিধান পড়লে স্পষ্ট হবে। কংগ্রেস দল নীতিগতভাবে এ ধারণার বিরোধিতা করেনি, কিন্তু বহুবার যুক্তরাষ্ট্রীয় ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্য নেই এমন কাজ করেছে, জরুরি অবস্থার কথাই ধরুন না কেন। কিন্তু এই যুক্তরাষ্ট্রীয় ধারণার বিরুদ্ধে কংগ্রেস দল বলেনি, দেশের অন্যান্য দলও এর বিরুদ্ধে বলেনি আর আঞ্চলিক দলগুলো তো যুক্তরাষ্ট্রীয় অধিকার নিয়েই গড়ে উঠেছে। একমাত্র ব্যতিক্রম বিজেপি। তারা সংবিধানের এই যুক্তরাষ্ট্রীয় অংশটি মুছে ফেলে এক শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার তৈরি করার পক্ষে, তারা দেশে প্রেসিডেন্সিয়াল সিস্টেম লাগু করার পক্ষে, তাদের আদর্শ ও দর্শন এই কথা বলে, সোচ্চারে বলে।
লক্ষ করে দেখুন, তারা ইতিমধ্যেই নির্বাচনী লড়াইটাকে মোদি বনাম না-মোদিতে এনে দাঁড় করিয়েছে। তারা সারা দেশে এক আইন এক সংবিধান, এক ভাষা এসবের কথা বলেই যাচ্ছে। সংবিধান বলছে আমাদের কোনও রাষ্ট্রভাষা নেই। হিন্দি মোটেই রাষ্ট্রভাষা নয়, কিন্তু বিজেপি বারবার সচেতনভাবেই এই বিতর্ককে উস্কে দিচ্ছে। কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা তুলে দেওয়া ছিল এই দর্শনেরই অঙ্গ। আসলে এক ভাষা এক দেশ এক নেতা এক ভোট এক সিভিল কোড ইত্যাদি বলে আসলে তারা যা করতে চায় তা হল এক) আমাদের দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে এক শক্তিশালী ইউনিয়ন গভর্নমেন্ট তৈরি করা, এক শক্তিশালী কেন্দ্রীয় কাঠামো তৈরি করা। ২) সেই কাঠামোর মাধ্যমে দেশের সংখ্যালঘু মানুষদের অধিকার কেড়ে তাদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে তোলা। ৩) সারা দেশের যাবতীয় বৈচিত্র্য শেষ করে, ভিন্ন জাতি-উপজাতির আইডেন্টিটিকে শেষ করে এক কল্পিত বিশাল হিন্দু রাষ্ট্র তৈরি করা। এ এক ভয়ঙ্কর প্রোগ্রাম, এরকমই এক প্রোগ্রাম হাতে নিয়ে অ্যাডলফ হিটলার সারা জার্মান জাতিকে ধ্বংসের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছিল। এবং এ এক নিশির ডাকের মতো।
আরও পড়ুন: বিজেপি আইটি সেল, দায়িত্বজ্ঞানহীন মিডিয়া, তৃণমূল এবং হাকিমের বিচার
একটু সেই ইতিহাসের দিকে তাকানো যাক। ১৯২৫-তে তিনি নাৎসি পার্টি, বা জার্মান সোশ্যালিস্ট পার্টির দায়িত্ব নিলেন। ১৯৩০-এ নাৎসি পার্টি সাধারণ নির্বাচনে ১৪ থেকে ১০৭ হয়ে গেল, হিটলার তখন প্রকাশ্যেই বলছেন দেশের অর্থনীতি ফেরানোর কথা, দেশের এই হালের জন্য তিনি ইহুদিদের দায়ী করছেন, বিরোধীদের ইহুদি তোষণের অভিযোগও করছেন, মানুষ শুনছে। ১৯৩১-এ রাষ্ট্রপতি হওয়ার চেষ্টা করলেন, পারলেন না। ৩২-এ তিনি প্লেনে চেপে সারা জার্মানিতে প্রচার করলেন, তাঁর সঙ্গী হলেন প্রচার সচিব জোসেফ গোয়েবলস। ১৯৩৩ জানুয়ারিতে তিনি কোয়ালিশন সরকারের চ্যান্সেলর নির্বাচিত হলেন, ৩৩-এর ফেব্রুয়ারিতে ও দেশের সংসদ ভবন রাইখস্ট্যাগে আগুন লাগানো হল, গণতন্ত্র বিপন্ন, ইহুদি আর কমিউনিস্টদের চক্রান্ত ইস্যু নিয়ে আবার নির্বাচন। মার্চ ১৯৩৩-এ আর কোনও দল নেই, কেবল নাৎসি পার্টি, ট্রেড ইউনিয়ন বা অন্য সংগঠন বেআইনি করে হিটলারই সর্বেসর্বা। ১৯৩৪, জুলাইয়ে তিনিই রাষ্ট্রপতি। আওয়াজ উঠল, এক দেশ এক জাতি এক নেতা। ইহুদিরা চিহ্নিত হল দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে। তারপর তো জানেন সবাই কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের সেই নারকীয় ঘটনার কথা। হ্যাঁ, সেই দিকেই এগিয়ে চলেছে দেশ আমার। ইউনিফর্ম সিভিল কোড আসছে, এসেই গেছে এক দেশ এক ভোটের বিল। এরই মধ্যে কৃষকদের এমএসপি নেই তাঁরা লড়ছেন, কেউ শোনার নেই, জিডিপি নামছে, কেউ দেখার নেই। পড়শিদের সঙ্গে সম্পর্ক খুউউব খারাপ, তলানিতে বললেও কম বলা হয়, বাণিজ্যে ঘাটতি বাড়ছে, বাজার টলমল করছে, দুই ফড়ে আদানি আম্বানির মুনাফা বাড়ছে, দেশের অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ছে। সাংঘাতিক সাংবিধানিক সঙ্কট তৈরি হচ্ছে।
এর মধ্যে গতকাল অমিত শাহ, দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, এক ইঞ্চিও পেছবেন না। বিজেপি একটা এসপার ওসপারের খেলায় নেমেছে। আমাদের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙে চুরমার করে একটা কেন্দ্রীয় সরকার, রাষ্ট্রপতি ধাঁচের ব্যবস্থা, এক ভাষা এক আইন এক দেশ চায়, এবং দলে তাঁদের এমন কোনও সুবিবেচক নেই বা থাকলেও তারা বোঝানোর মতো অবস্থায় নেই যে এরকম একটা চেষ্টা দেশটাকে রসাতলে নিয়ে যাবে। প্রবল প্রতিরোধ হবে, বিদেশে মুখ পুড়বে, পোড়া শুরু হয়ে গেছে। এসবের সামান্য ধারণা থাকলে বিজেপি দু’ পা পিছিয়ে ভাবার চেষ্টা করত কিন্তু তারা জেনে গেছে এই সংখ্যাগরিষ্ঠতার ঝটকা দিয়েই সংবিধানটাকে তাদের মতো করে তৈরি করে নিতে হবে। আজ সংসদের মধ্যে বিজেপিকে আটকানো খুব অসম্ভব? না তাও নয়, কারণ এক দেশ এক ভোটের যে বিল তারা এনেছে তা পেশ করার সময়েই ভোটাভুটি হল, এমনিতে সংখ্যাধিক্য তো তাদের আছে, কিন্তু তাদের কাছে এখনও দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই, তা সংখ্যা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কাজেই তারা মুখ না পুড়িয়ে আপাতত ৯০ দিনের জন্য এই বিল জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটির কাছে পাঠিয়ে দিল। কী ভাবছেন, সহমত গড়ে তোলার জন্য? সে গুড়ে বালি, ওরা এই ৯০ দিনে দল ভাঙার চেষ্টা করবে, বিজু জনতা দলের দিকে তাদের নজর আছে, অন্য আরও কয়েকটা ছোট দলের সঙ্গে কথা চলছে, সেই কাঙ্ক্ষিত সংখ্যাগরিষ্ঠতার ব্যবস্থা হয়ে গেলেই তারা আবার বিল নিয়ে হাজির হবে। দেশের মানুষের খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান, শিক্ষা-স্বাস্থ্য নিয়ে তাদের কোনও চিন্তা নেই।
চতু। আসলে তারা সভ্যতার চাকাকে পেছনের দিকে নিয়ে যেতে চায়, এক অসভ্য বর্বরদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
The post Fourth Pillar | যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে টুকরো টুকরো করবেন মোদি-শাহ first appeared on KolkataTV.
The post Fourth Pillar | যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে টুকরো টুকরো করবেন মোদি-শাহ appeared first on KolkataTV.