এক বিজেপি হাফ নেতা, কমিটেড ভক্ত দেখা হলেই যিনি সজোরে জয় শ্রীরাম বলতেন, ইদানিং বলতেন অব কি বার ৪০০ পার, সেই তিনি রবিবার বিকেলে ভারি মনমরা হয়ে পার্কে বসেছিলেন। তো আমি চা-ওলা, আরে না বাবা, সত্যি সত্যি চা-ওলা, তাঁকে ডেকে চা দিতে বলে চায় পে চর্চা শুরু করেছিলাম, তো সেই ভদ্রলোকের মুখে যা শুনলাম তা যাঁরা হস্তবিচার জ্যোতিষী ইত্যাদি নিয়ে চর্চা করেন তাঁদের মুখেই শুনেছি, দলটা না সাড়ে সাতিতে ঢুকে গেছে। মাত্র ক’দিন আগে, বলা ভালো ক’ মাস আগে মনে হচ্ছিল কেকওয়াক, ডান ডিল, ৩৭০ তো হবেই, তারও বেশি হওয়া সম্ভব। কিন্তু এখন চারধার থেকে বাজে হাওয়া বইছে। অমন যে অমন রাজস্থান, সেখানেও নাকি চাপ আছে। কর্নাটকে চাপ তো ছিলই, তার উপরে আবার দেবেগৌড়ার নাতির হাজার দুয়েক পেন ড্রাইভে রাখা ছবি এখন ভাইরাল, এফআইআর হয়েছে। আর সেই নাতি, এবারে হাসান আসন থেকে যিনি প্রার্থী ছিলেন সেই প্রজ্জ্বল রেভন্না ধাঁ, দেশ ছেড়েই পালিয়েছেন, ধর্ষণ আর শারিরীক অত্যাচারের অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। তাঁর কাকা কুমারস্বামী অবশ্য বলেছেন উপ্পু থিন্ডা ভানু নিরু কুডিয়াবেকু, মানে হল যে নুন খেয়েছে, তাকেই জল খেতে হবে। কিন্তু সেই তিনি নুন খাওয়ার পরে আর দেশে বসে জল খাবার রিস্ক নেননি, জার্মানি চলে গেছেন, ফিরবেন কি না জানা নেই। ওদিকে এখনও ১৪টা আসনের ভোট বাকি। এদিকে বীরভূমে এত্ত খেটে এক জাঁদরেল আইপিএসকে আনা হল, সেই দেবাশিস ধরের প্রার্থীপদ খারিজ। ওদিকে বিহারে জেডিইউর প্রচারে সভা ভরা তো দূরের কথা, সংসদীয় আসনের বিধায়করাও হাজির হচ্ছেন না। আমাদের বাংলায় ফাটিয়ে দেব, হারিয়ে দেব, দেখে নেব ইত্যাদি বলার পরে ডায়মন্ড হারবারে একজনকে দাঁড় করানো হল, যাঁর দু’বার জামানত গেছে। আসানসোলে বিজেপি প্রার্থীর সামনেই ধুন্ধুমার কাণ্ড বেঁধে গেল, দে দমাদ্দম, দে দমাদ্দম, আলুওয়ালিয়া অবাক হয়ে দেখছেন হিন্দু অভ্যুত্থান।
মহারাষ্ট্রে অজিত পাওয়ারের সঙ্গে দল ছেড়েছিলেন ছগন ভুজবল, তো তিনি বলেছেন সহানুভূতির হাওয়া বইছে শরদ পাওয়ার উদ্ধব ঠাকরের দিকে। অজিত পাওয়ারের দল আবার কৃষকদের জন্য এমএসপি দাবি করেছে। সব মিলিয়ে দল সাড়ে সাতিতে ঢুকে পড়েছে। তো আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনাদের সব খোল চাবি মোদিজি তো আছেন, ঠিক সামলে নেবেন, উনি ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন, সাড়ে সাতি নাকি হাতিকেও কাবু করে দেয়। ওনার মনের অবস্থা বুঝেই আমি সেই ছোট্টবেলায় পুকুর থেকে কুমির ধরা মোদিজির সঙ্গে হাতির শক্তি ইত্যাদি নিয়ে আর কথা বাড়াইনি। কিন্তু দু’ দফার ভোটের শেষের হিসেব করতে বসেছিলাম। প্রথম দফার ১০২ আর পরের ৮৮ মিলে ১৯০টা আসনের ভোট শেষ, মানে দেশের এক তৃতীয়াংশ সাংসদের ভবিষ্যৎ আপাতত স্ট্রং রুমের ভিতরে ইভিএম-এ বন্দি। প্রথম দফার আসনগুলোর মধ্যে ৪৯–৪৯ ছিল এনডিএ আর ইন্ডিয়া জোটের, বাকি ৪ অন্যান্যদের, কাজেই প্রথম দফাতে আসলে যে যার আসন বাঁচাতে ব্যস্ত ছিল, নিজেদের আসন বাঁচিয়ে যদি কিছু এক্সট্রা পাওয়া যায়। এবং প্রথম দফার ভোট বলে দিয়েছিল, ভোট কিন্তু একতরফা পড়ছে না।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | মোদি–শাহ ক্ষমতায় এলে গণতন্ত্রের আয়ু কতদিন?
অবকি বার ৪০০ পার, ইত্যাদি বাওয়াল আসলে পাক্কা ব্লাফ, এমনকী রাজস্থানে প্রথম দফার ভোটেই গোটা দুই আসন বিরোধীদের কাছে আসতেও পারে, যেরকম তামিলনাড়ুতে একটা আসন পেতেই পারে বিজেপি। ফল তো জানা যাবে সেই ৪ জুন কিন্তু মানুষের মতিগতি আর এলাকার খবর বলছে ওই ৪৯–৪৯ কিন্তু এবারে ৪৩–৫৫ বা ৪২–৫৬ হতেই পারে, মানে ইন্ডিয়া জোট খানিক এগিয়ে থাকতে পারে। এবারে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল ৮৯টা আসনে তো মধ্যপ্রদেশে বেতুল সংসদীয় নির্বাচনের এক প্রার্থীর মৃত্যুর জন্য সেই আসনের নির্বাচন স্থগিত রাখা হয়েছে। এবারে এই ৮৮টা আসনের মধ্যে বিজেপি আর তার সহযোগীদের হাতে ছিল ৬২টা আসন, বিরোধীদের দখলে ২৬টা। এবারের লড়াই ছিল এনডিএর নিজের আসন ধরে রাখার, আর ইন্ডিয়া জোটের কিছু বেশি আসন জেতার। এই ৮৮টার মধ্যে কেরালারই ২০টা আসন ছিল, গতবারের ফলাফল ইউডিএফ ১৯ এলডিএফ ১। তো এবারে কী হবে? এলডিএফ সম্ভবত ২, ইউডিএফ ১৭ আর এই প্রথম কেরালাতে ত্রিশূর আসন জিতে খাতা খুলবে বিজেপি। তিরুবনন্তপুরমেও জোর লড়াই হবে শশী থারুর আর বিজেপির রাজীব চন্দ্রশেখরের মধ্যে। কিন্তু বিরাট কোনও পরিবর্তন হবে না। এবার কর্নাটক, গতবারে ২৮টা আসনে বিজেপি ২৫, সহযোগী নির্দল ১, কংগ্রেস ১ আর জেডিএস ১, এই তো ছিল। এবারে কর্নাটকে হারার পরেই জেডিএস-এর হাত ধরেছে বিজেপি, ভোক্কালিগাদের দলের হাত ধরে হিন্দু আর ভোক্কালিগা ভোট জুড়ে ভাঙন আটকানোর চেষ্টা। তো এই পর্যায়ে ১৪টা আসনে ভোট এলাকার বড় অংশই ভোক্কালিগাদের, লড়ছে জেডিএস, বিজেপি এমনকী জেতা আসনও ছেড়ে দিয়েছে। ভোট হয়েছে বেঙ্গালুরু গ্রামীণ সমেত চার বেঙ্গালুরু আসনে। আর বাকি ১০টা আসন ওল্ড মাইশুরুর, মানে টিপুর রাজ্য জুড়ে। বিরাট সংখ্যক মুসলমান আছেন।
কর্নাটকে ভোক্কালিগারা হল উত্তর ভারতের জাঠেদের মতন, ধনী কৃষক, দেবেগৌড়ারা সেই ভোক্কালিগাদের প্রতিনিধি, কিন্তু সেখানে কংগ্রেসের ডি কে শিবকুমারও আছে, তিনিও ভোক্কালিগা। এই ১৪টা আসনে ৬টা আসন হাতছাড়া হবে বিজেপির, এরপরের পর্যায়েও গোটা আট আসনে দারুণ লড়ছে কংগ্রেস, কাজেই ২৫ তো দূরস্থান, গোটা ১২ রাখতে পারলেও বিজেপি খুশি হবে। কংগ্রেস এই দফাতে ৬, পরের দফাতেও ৬টার মতন আসন পাবে। এবার চলুন রাজস্থানে, এই দ্বিতীয় দফাতে রাজস্থানে ১৩টা আসনে ভোট হয়েছে, মানে রাজস্থানে ভোট শেষ। জোর লড়াই হয়েছে বারমের, টংক সওয়াই মাধোপুর আর বাঁসওয়াড়াতে। দুই দফার ভোটে কম করেও তিন কি চারটে আসন তো খোয়াবেই বিজেপি, তার বেশি হলে অবাক হব না। চুরু, শিকর, বাঁসওয়ারা, বারমের, টংক সওয়াই মাধোপুর আর নাগোর এই ছটা আসনে জেতার জন্য লড়ছে কংগ্রেস, ইন্ডিয়া জোট। আগের দিনই বলেছি এই রাজস্থানে এবার জিতে দিল্লি যেতে পারেন সিপিএম-এর অমরা রাম, শিকর আসন থেকে। মধ্যপ্রদেশের ৬টা আসনে ভোট হয়েছে, এ রাজ্যে কংগ্রেসের লক স্টক ব্যারেল চলে গেছে বিজেপিতে, ওই আগের দফার জেতা ছিন্দওয়াড়া বা মণ্ডলা আসনে কংগ্রেস লড়ছে, সেখানেই চোখ থাকবে আমাদের। এবারের ৬টা আসনের ৬ তাই বিজেপির। মহারাষ্ট্রে ৮টা আসনে ভোট হয়েছে, এখানে আগের হিসেবে সবটাই এনডিএর, কিন্তু এবারে ৮টার মধ্যে ৩-৪ খানা আসন ইন্ডিয়া জোট পেতে পারে। অজিত পাওয়ারের এনসিপিকে মরিয়া দেখাচ্ছে, নার্ভাস দেখাচ্ছে, তাদের ইস্তাহারে তারা এমএসপির দাবি জানিয়েছে, অবশ্য এটা হয়তো পরের এসকেপ রুট।
উত্তরপ্রদেশের জাঠবহুল ৮টা আসনে ভোট ছিল, গতবারের ফলাফল বিজেপি ৭, বিএসপি ১। তো সেই বিএসপি প্রার্থী অমরোহা থেকে এবারে কংগ্রেসের প্রার্থী, রাহুল, অখিলেশ একসঙ্গে জনসভা করেছেন কিন্তু তিনি জিতবেন বলে মনে হচ্ছে না। বাকি সাত আসনেও বিজেপি এগিয়ে কারণ তাদের সঙ্গে এবারে রাষ্ট্রীয় লোকদল, জয়ন্ত চৌধুরি আছেন। এই ৮টার মথুরাতে লড়ছেন হেমা মালিনী, আর মীরাটে লড়ছেন রামায়ণের সেই অরুণ গোভিল, দুজনেই বহিরাগত, হেমা মালিনী তৃতীয়বার, এলাকাতে নির্বাচনের সময়েই আবার এসেছেন, দুজনেই জিতবেন। আমাদের দেশে ভোটে কাজ করে হেরেছেন, কাজ না করে জিতেছেন, অকর্মণ্য লোকজন জিতেছেন, কাজের লোক হেরেছেন, এর উদাহরণ কি কম আছে? কান্তি গাঙ্গুলিকে হারিয়েছেন দেবশ্রী রায়, কেন? কেউ জানে না। তো উত্তরপ্রদেশে বিজেপি আটে আট, কিন্তু তা বলে এর পরের দফাতেও তাই হবে? সম্ভবত না, আগামিকালই হয়তো রাহুল আর প্রিয়াঙ্কা আমেঠি রায়বেরিলি থেকে দাঁড়ানোর কথা ঘোষণা করবেন, ওদিকে কনৌজ থেকে লড়ছেন অখিলেশ, এর প্রভাব পড়বে। পড়লে জানাব। চলুন বিহারে, ৫টা আসনে ভোট হয়েছে। একটা, কিষাণগঞ্জ ছিল কংগ্রেসের, বাকি পূর্ণিয়া, কাটিহার, বাঁকা আর ভাগলপুর ছিল জেডিইউর। এবারে নীতীশের দল কম করে ৩টে আসন হারাবে। পূর্ণিয়া, কাটিহার আর বাঁকা আসনে গতকাল যা ভোট হয়েছে, তাতে জেডিইউ জিতছে না, আরজেডি ফিরছে। পূর্ণিয়াতে অবশ্য পাপ্পু যাদব এগিয়ে, মুসলমান যাদব ভোটের সমীকরণ তাঁর পক্ষে, আরজেডির অফিসিয়াল প্রার্থী বীমা ভারতীকে অনেক পিছনে ফেলেই সদ্য কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার পরেও দলের নির্দেশ না মেনে নির্দল হয়ে দাঁড়িয়ে পাপ্পু যাদব সংসদে যাবেন। তার মানে মোটের ওপর এই ৮৮টা আসনের ভোটের শেষে হিসেব বলছে গতবারের জেতা ৬২টা আসনের গোটা ১১-১২টা আসন এনডিএ জোট হারাতে চলেছে। মানে ফলাফল হতে পারে ৫০–৩৮। এর সঙ্গে আগের হিসেবটা জুড়ে দিই। মোট ১৯০টা আসনে ভোট হল দু’ দফায়, বিজেপি বা এনডিএ ৯২-৯৩ আর ইন্ডিয়া জোট ৯৫-৯৬, অন্যান্য ২-৩টে আসন পেতে পারে। তার মানে দু’ দফার হিসেব সাফ বলে দিচ্ছে কেকওয়াক নয়, ডান ডিল নয়, এবারে মোদি ওয়েভ নেই, পুলওয়ামা, বালাকোট নেই, আবার উল্টোদিকেও প্রবল হাওয়া নেই। আসনে আসনে ভোট হচ্ছে। এখন থেকে বলে রাখছি মিলিয়ে নেবেন, ধাক্কা আসবে বিহার, মহারাষ্ট্র, কর্নাটক আর আমাদের বাংলা থেকে, চার রাজ্য মিলিয়ে কম করে ৩৫-৪০টা আসন হারাতে চলেছে বিজেপি।