কলকাতা : অযত্নে, অবহেলার মধ্যেই পড়ে রয়েছে ভারতের প্রথম ফাঁসির সাজা প্রাপ্ত মহারাজ নন্দকুমারের স্মৃতি বিজড়িত ফাঁসির স্থান। সম্প্রতি সেই স্থান সংস্কারের দাবি জানানো হয়েছে।
দিনটি ছিল ১৭৭৫ সালের ৫ই অগস্ট। তিনিই প্রথম ভারতীয় যিনি প্রকাশ্য ফাঁসির সাজায় দণ্ডিত হন। বর্তমান বীরভূমের নলহাটি থানার ভদ্রপুরে ব্রাহ্মণ পরিবারে ১৭০৫ সালে জন্ম মহারাজ নন্দকুমারের। ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বর্ধমান, নদিয়া ও হুগলির দেওয়ানীর দায়িত্ব পান মহারাজ নন্দকুমারকে। তার আগেই ১৭৬৪ সালে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ মহারাজ নন্দকুমারকে ‘মহারাজা’ উপাধি দিয়েছিলেন। ১৭৭৩ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস গভর্নর জেনারেল হয়ে আসার পরই তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন। যেখানে বলা হয়, ওয়ারেন হেস্টিংস বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতিমূলক কাজ করছেন, কিছু স্হানীয় জমিদার, মিরজাফরের স্ত্রী মুন্নী বেগমের কাছ থেকে হেস্টিংসের ঘুষ নেওয়ার বিষয়টি মহরাজ নন্দকুমার ফাঁস করে দেওয়ায় কোর্ট অব ডাইরেক্টসের কাছে সে অভিযোগ যায়। ১৭২৮ সালে ইংল্যান্ডে দুর্নীতি দমন আইন তৈরি করা হয়েছিল, যার সাজা ছিল ফাঁসি। মহারাজ নন্দকুমারের ওপর হেস্টি়ংসের রাগ ও বিদ্বেষের কারণে মহারাজ নন্দকুমারকে শাস্তি দেওয়ার সুযোগ খুজছিলেন। হেস্টিংস মহারাজ নন্দকুমারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনার কাগজপত্র তৈরি করার সময়েই জনৈক মোহন প্রসাদ নন্দকুমারের বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ করেন। অভিযোগ, সুপ্রিম কোর্ট তৈরির চার বছর আগে একটি উইলে জালিয়াতি করা হয়। সুপ্রিম কোর্ট নন্দকুমারের বিচার করে ও দোষী সাব্যস্ত করে ফাঁসির সাজা ঘোষণা করা হয়। মহারাজ নন্দকুমারকে এই মিথ্যা অপবাদে ফাঁসানো হয়।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভারতবাসীদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য কলকাতায় হেস্টিংসের সামনে প্রকাশ্য রাস্তায় ফাঁসি দেওয়া হয় মহারাজ নন্দকুমারকে। কথিত আছে, ফাঁসির আদেশদানকারী বিচারক স্যার এলিজা ইম্পে ওয়ারেন হেস্টিংসের বন্ধু ছিলেন। মহারাজ নন্দকুমারকে ফাঁসি দেওয়ার জন্য তড়িঘড়ি সেই ফাঁসির আদেশ দেওয়া এবং তা কার্যকর করা হয়। এই ঘটনা থেকে ইংরেজরা এই বার্তা দিতে চেয়েছিল যে, যাতে কেউ ইংরেজদের অন্যায় কাজের বিরুদ্ধে মুখ না খোলে বা তাদের বিরুদ্ধে কথা না বলে। পরবর্তীকালে অবশ্য বিচারপতি ইম্পে ও ওয়ারেন হেস্টিংসকে আইনি হত্যার অপরাধী হিসাবে অভিযুক্ত করে।
কলকাতার হেস্টিংস অঞ্চলের অনেকেই জানেন যে, এখানে কোনও একজনকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তিনি কে? কেন তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল? সেই ইতিহাসের কিছুই জানে না অনেকেই। আর জানবেই বা কি করে ? যেভাবে অযত্নে পড়ে রয়েছে সেই নন্দকুমারের স্মৃতি বিজড়িত ফাঁসির জায়গাটি। সেখানে রয়েছে কেবলমাত্র একটি লোহার রডের ঘেরাটোপ। সেই লোহার ঘেড়াটোপের ওপর কাপড় শুকানো হচ্ছে। আর ঘেরাটোপ জুড়ে রয়েছে অযত্নে গজিয়ে ওঠা বড় বড় ঘাস ও গাছপাতা। হাইকোর্টের পাশে অবস্থিত রাস্তার ওপর মহারাজ নন্দকুমারকে ফাঁসি দেওয়া হয়। যার থেকে এই রাস্তার নাম হয়ে যায় ‘ফাঁসি লেন’। যদিও কলকাতা শহরের অনেকেই জানেন না এই নাম। আজও সেই ফাঁসি দেওয়ার কপিকল রয়েছে সেখানে।
সরকারের কাছে আবেদন জানানো হয়, অবিলম্বে মহারাজ নন্দকুমারকে ফাঁসি দেওয়ার জায়গাটি সংরক্ষণ করা হোক। দেওয়া হোক হেরিটেজ মর্যাদা। সেই সঙ্গে মহারাজা নন্দকুমারের ইতিহাস জানানো হোক সাধারণ মানুষকে। এই ইতিহাস জানার অধিকার প্রত্যেকটি ভারতবাসীর আছে এবং এই জায়গাটাই হতে পারে একটি দর্শনীয় স্থান যার ইতিহাস অনেকেই জানেন না।