রাবড়ি তৈরি করা দেখেছেন? রাবড়ি? তলায় আগুন জ্বালানো থাকে, গনগনে আঁচে দুধ ফুটতে থাকে আর ওপরে পাখা নাড়তেই থাকেন কারিগর, পাখার ঠান্দা হাওয়ায় সর জমে, সেই সর দিয়ে হবে রাবড়ি। তো এই উপায় ভারতীয় রাজনীতিতে এনে হাজির করেছে বিজেপি দল, আমাদের প্রধানমন্ত্রী, আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বিজেপির বড় বড় নেতারা এবং বিজেপির আইটি সেল। ভারতবর্ষের এক বিরাট সংখ্যক মানুষ শিক্ষার সুযোগ পাননি, যাঁরা পেয়েছেন তাঁদেরও বিরাট অংশ প্রকৃত শিক্ষা যাকে বলে তার ধারে কাছে ঘেঁষতে পারেননি। মানে ধরুন এমনিতে এমএ বা বিএ পাশ কিন্তু বিশ্বাস করেন রাহু-কেতুর জন্য সূর্যগ্রহণ চন্দ্রগ্রহণ হয় বা তাঁরা বিশ্বাস করেন যে গ্রহণের সময়ে খাওয়া উচিত নয়, বিড়াল পার হলে গাড়ি থামানো উচিত, হাঁচি কাশি টিকটিকিতে বিশ্বাস করেন। সেই আমাদের দেশে এখন দুটো ন্যারেটিভ তৈরি হচ্ছে, দুটো আলাদা গল্প। একই দল দুটো গল্প, দুটো ধারণার প্রচার করেই যাচ্ছে। একটা বেশিরভাগ মানুষের কাছে বলা হচ্ছে আর একটা কিছু মানুষ মাঝেমধ্যে বলছেন। গুলিয়ে যাচ্ছে? দাঁড়ান একটু পরিষ্কার করে বলি। আবার কথা উঠছে নাগরিকত্ব বিলের, কিন্তু এবারের আড়াল হল, ভোটার লিস্ট, এসআইআর। যে ভোটাররা ভোট দিয়ে সরকার তৈরি করেছে, তাদের মধ্যে কারা নাগরিক, কারা নাগরিক নয় সেটা খোঁজা হচ্ছে। আর সেই আলোচনার মধ্যে দুটো প্রধান ন্যারেটিভ কী কী?
১) এই স্পেশ্যাল ইনটেন্সিভ রিভিশন অফ ভোটার লিস্ট কোনও মানুষের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার জন্য নয়, বরং এটা হল অনুপ্রবেশকারীদের বেছে বার করে সীমান্তের ওপারে পাঠিয়ে দেওয়ার। ঠিক যেমন সিএএ সময় বলা হয়েছিল এই আইন ৩টে দেশের সংখ্যালঘু ধর্মীয় কারণে নিপীড়িতদের নাগরিকত্ব দেওয়ার আইন। এটা বলছেন প্রধানমন্ত্রী, বলছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, বলছেন বড় বড় নেতা মন্ত্রীরা।
২) এবারেও তলার সারি বিজেপি কর্মী, স্যোশ্যাল মিডিয়ায় বিজেপি কর্মী নেতারা বলছেন, হিন্দুরা প্রত্যেকে নাগরিক, তাদের ভোট থাকবে পাবে কিন্তু মুসলমানদের ভোটার লিস্ট থেকে এদেশ থেকে তাড়াতে হবে। হিন্দুদের কোনও কাগজ লাগবে না কিন্তু মুসলমান একজনকেও ছাড়া হবে না। খুব পরিষ্কারভাবেই এটা স্যোশাল মিডিয়াতে প্রচার করা হচ্ছে। এদের কাউকে কোনও জবাবদিহি করতে হবে না সংসদের কাছে বা বিধানসভায়। এই পদ্ধতিতে মেরুকরণ করার কাজ চলছে দেশ জুড়ে। প্রতিটি বিষয়ে। মুসলমানদের জনসংখ্যা হিন্দুদের ছাপিয়ে যাবে, মুসলমানদের ৪-৫ বউ, মুসলমানরা ভীষণ নোংরা, মুসলমানরা অশিক্ষিত, ওদের কোরানে লেখা আছে হিন্দুদের কোতল করতে হবে, সবচেয়ে বেশি অপরাধী মুসলমান ধর্মের মানুষেরা ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রতিটা বিষয়ে তলায় পাঠানো হচ্ছে মিথ্যে তথ্য আর ওপরে অন্য কথা বলা হচ্ছে। বছরের পর বছর পাশাপাশি বসবাস করে আসা পড়শিদের থেকে আলাদা হচ্ছে হিন্দুরা। কেন? আপনার পাশাপাশি মানুষজনের সঙ্গে কথা বলুন, পরিষ্কার বুঝতে পারবেন।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | বিহারে প্রশান্ত কিশোর, এক্স ফ্যাক্টর! এই মূহুর্তে অ্যাডভানটেজ মহাগঠবন্ধন
অর্থনীতির পরিসংখ্যান নতুন করে দেব না। যা অবস্থা তাতে ক্লাস টেনের একটি ছেলেও বলে দেবে যে ঠিক এই মুহূর্তে অন্য কিচ্ছু নয় প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, নির্মলা সীতারামনের উচিত অর্থব্যবস্থায় মনোযোগ দেওয়া। গ্রামের গরিব মানুষের হাতে টাকা পৌঁছনো। তাঁদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়লে অর্থনীতির চেহারা বদলাতে শুরু করবে। অথচ এই সরকার তিন তালাক নিয়ে ব্যস্ত, ৩৭০ ধারা নিয়ে ব্যস্ত, রামমন্দির নিয়ে ব্যস্ত বা ধরুন সিএএ, এনআরসি, এনপিআর এসব নিয়েই পড়ে রয়েছেন, এখন নতুন ইস্যু এসআইআর। কেন? তারা বোকা আর আপনারা চালাক? না এরকমটা নয়। একটু ইতিহাসের দিকে তাকান। যে সময় কংগ্রেস বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করছেন তখন হিন্দু মহাসভা বাংলাকে ভাগ করার কথা বলছে। আরএসএস-এর জন্মদাতা বিনায়ক দামোদর সাভারকর দ্বিজাতিতত্ত্বের কথা বলছেন। গান্ধী নয় যে সাভারকরকে আরএসএস রাষ্ট্রপিতা বলে সেই সাভারকর বলছেন, জার্মানরাই যেখানে গরিষ্ঠ সেখানে ইহুদিরা করছে কী? তিনি হিটলারকে সমর্থন করছেন। Bunch of Thoughts-এ সংঘগুরু গোলওয়ালকর বলছেন হিন্দুরাষ্ট্রের কথা, বলছেন লড়াইটা মুসলমান দের সঙ্গে, ব্রিটিশদের সঙ্গে নয়। সাভারকর বলছেন 19th session Hindu Mahasabha, Ahmedabad, 1937 “As it is, there are two antagonistic nations living side by side in India. Several infantile politicians commit the serious mistake in supposing that India is already welded into a harmonious nation, or that it could be welded thus for the mere wish to do so. These our well-meaning but unthinking friends take their dreams for realities. That is why they are impatient of communal tangles and attribute them to communal organizations. But the solid fact is that the so-called communal questions are but a legacy handed down to us by centuries of cultural, religious and national antagonism between the Hindus and Moslems. When time is ripe you can solve them; but you cannot suppress them by merely refusing recognition of them. It is safer to diagnose and treat deep-seated disease than to ignore it. Let us bravely face unpleasant facts as they are. India cannot be assumed today to be a Unitarian and homogenous nation, but on the contrary there are two nations in the main: the Hindus and the Moslems, in India.” মানে খুব পরিষ্কার, হিন্দু এবং মুসলমান একসঙ্গে থাকতে পারে না। দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রথম উদগাতা তো এই বিনায়ক দামোদর সাভারকর, পরে হুবহু এই তত্ত্ব নিয়ে মাঠে নামেন জিন্নাহ। আরএসএস মুখপত্র Organiser, স্বাধীনতা দিবসের আগের দিন (August 14, 1947) “Let us no longer allow ourselves to be influenced by false notions of nationhood. Much of the mental confusion and the present and future troubles can be removed by the ready recognition of the simple fact that in Hindusthan only the Hindus form the nation and the national structure must be built on that safe and sound foundation… the nation itself must be built up of Hindus, on Hindu traditions, culture, ideas and aspirations.”
মানে দেশ গড়তে হবে কেবলমাত্র হিন্দুদের নিয়েই। অন্য সব ধর্মের মানুষ থাকবে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে। গোলওয়ালকর কী বলছেন দেখা যাক। Madhav Sadashiv Golwalkar, (1947). We, or Our Nationhood Defined. ৪৩ নম্বর পাতা। Race pride at its highest has been manifested here. Germany has also shown how almost impossible it is for Races and cultures, having differences going to the root, to be assimilated into one united whole, a good lesson for use in Hindusthan to learn and profit by. মানে হিটলারের জার্মানি যা শিখিয়েছিল সেটা ভারতবর্ষকে শিখতে হবে। বিশ্বের ঘৃণ্যতম ডিক্টেটর হিটলারের কাছ থেকে শিখব আমরা বুদ্ধ মহাবীর গান্ধীর উত্তরাধিকারীরা? আরএসএস-এর আর এক গুরু হেডগেওয়ার ১৯২৫-এ আরএসএস তৈরি করেছিলেন। ১৯২৯-এ লাহোরে কংগ্রেস পূর্ণ স্বরাজের দাবি তুলল। ১৯৩০-এ ২৬ জানুয়ারি তেরঙা পতাকা তুলে স্বাধীনতা দিবস পালন করার সিদ্ধান্ত নিল। সেদিন হেডগেওয়ার নাগপুরে আরএসএস-এর সদর দফতরে গেরুয়া ঝান্ডা তোলার সিদ্ধান্ত নেন। তারপর থেকে স্বাধীনতার অনেক পরেও নাগপুরে সদর দফতরে জাতীয় পতাকাও তোলা হয়নি। খিলাফত আন্দোলনের সময়ে হেডগেওয়ার বলেছিলেন মুসলমানরা প্রথমে মুসলমান পরে ভারতীয়। আচ্ছা আমি খামোখা এনাদের কথা শোনাচ্ছি কেন? শোনাচ্ছি এই জন্য যে এঁরাই হলেন বিজেপি আরএসএস-এর গুরু, এনাদের পথেই চলছে বিজেপি, বিজেপি সরকার, এনাদেরকেই আদর্শ বলে মনে করেন মোদি অমিত শাহ। কাজেই এমনি এমনি এসআইআর করা হচ্ছে, ৩৭০ তুলে নেওয়া হল, তিন তালাক মুসলমান নারীদের উন্নতির জন্য তুলে নেওয়া হল বা ধরুন হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে বলে নাগরিকত্ব বিল আনা হল এসব যারা ভাবছেন তাঁরা মুর্খের সাম্রাজ্যে আছেন। বিজেপি আরএসএস মোদি শাহ জাবড়েকররা চায় হিন্দুরাষ্ট্র। প্রতিটা পদক্ষেপ সেই দিকে নিয়ে চলেছে। এবং মোদি জানেন, অমিত শাহ জানেন বিজেপি জানে আরএসএস প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দিচ্ছে হয় এবার নয় নেভার। একবার যদি পিছু হটতে হয় তাহলে তাঁদের এই সাধের হিন্দুরাষ্ট্র অধরা থেকে যাবে। তারা এখন তাঁদের স্বপ্নের বড্ড কাছে।
ভাবুন না সংসদে ২৪০ জন এমপি বিজেপির, একজনও মুসলমান নেই, উত্তরপ্রদেশের মতো বিরাট এবং মুসলিম বহুল রাজ্যে জেতা তো ছেড়েই দিন একজন বিজেপি প্রার্থীও নেই। তারা nearer to their target. যা তাদের গুরুদেবরা বলে গিয়েছিল, যা তাদের দর্শন আজ সময় এসেছে তাকে বাস্তব রূপ দেবার। অর্থাৎ এক আদর্শগত লড়াইয়ের মুখোমুখি আমাদের দেশ, আমার স্বদেশ ভারতবর্ষ। একদিকে প্রকাশ্যে এবং পরোক্ষে হিন্দুরাষ্ট্রের স্বপ্ন, অন্যদিকে সংবিধান বাঁচানোর লড়াই। বড় অসম এ লড়াই। কেন? কেন অসম লড়াই বলছি জানেন? বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকা রাজনৈতিকদলগুলোর দেউলিয়াপনা। এদের প্রত্যেকে কখনও না কখনও বিজেপির সঙ্গে ঘর করেছে, আজ তারা সাভারকর পড়িয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছে আরএসএস বিজেপির আসল প্ল্যানের কথা বলছে, হিন্দুরাষ্ট্র তৈরি করার কথা বলছে কিন্তু সেদিন মনে ছিল না। সিপিএম সিপিআই বাম দলগুলোর কথা বলবেন? কলকাতায় ব্রিগেডে হাত ধরাধরি করে ছবি তোলানোর কথা মনে নেই? মনে নেই ভিপি সিং সরকারের একদিকে এনারা অন্যদিকে অটল এবং আদবানি? একই কাজ করেছে এসপি, বিএসপি, তেলুগু দেশম। তৃণমূল নেত্রী নিজে বিজেপির মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী ছিলেন। ফারুক আবদুল্লার ন্যাশন্যাল কনফারেন্স বা মেহবুবা মুফতির দল, বিজেডি, ডিএমকে, এআইডিএমকে, অকালি, কে নয়? প্রত্যেককে আসলে ব্যবহার করেছে নিঃশব্দে তাদের শক্তি বাড়িয়েছে। আজ থ্রি নট থ্রি। আর কংগ্রেস মুসলিম জনসংখ্যাকে ভোটব্যাঙ্ক ছাড়া কিছুই মনে করেনি, মুসলিম তোষণের দায় তো এদেরই এবং সেটা তো অনেকাংশে সত্যি। শাহ বানু মামলা থেকে রাজীব গান্ধীর অযোধ্যার তালা খুলে দেওয়া সবটাই তো আসলে বিজেপিকে বড় করেছে, বাড়িয়ে তুলেছে। এবং আরও দুর্ভাগ্য হল এটা ইতিহাস। কিন্তু অনেক সময় আমরা বলি না যে ঠিক আছে যা হয়েছে হয়েছে, অতীত বাদ দিয়ে বর্তমানের মুখোমুখি হতে হবে। সেখানেও দেখুন কত সংশয় দ্বিচারিতা। অন্যদিকে হিন্দুরাষ্ট্রের অটল আদর্শ নিয়েই বিজেপি লড়ছে। তবু ভাবতে ভালো লাগবে ফাসিস্ত বিরোধী সবথেকে বড় জোট তৈরি হবে সময়ের দাবি মেনেই, বিরোধীরা আটকে দেবেন এই ঘৃণ্য চক্রান্ত। ভাবতে ভালো লাগবে যে আমাদের দেশ আমাদের সুমহান ঐতিহ্য বসুধৈব কুটুম্বকমের কথা বলবে আবার। কেন এমন আশা করছি? করছি কারণ রাস্তায় তো বারবার নেমেছেন ছাত্ররা, রাস্তায় যুবকরা, রাস্তায় মহিলা বৃদ্ধরাও নেমেছেন। ওই শীতেও শাহিনবাগে প্রতি রাত মহিলারা বসে ছিলেন, ২০ দিনের শিশুকে নিয়ে হাজির ছিলেন মা। আজও ৫০ শতাংশ হিন্দু বিজেপিকে ভোট দেয় না, তাদের সাম্প্রদায়িক চক্রান্তে পা দেয় না। ওইখানেই লুকিয়ে রয়েছে আমাদের ভরসা। আমাদের আশা ওইটুকুকে ঘিরে। নতুন প্রজন্ম বুঝে ফেলেছে এই ষড়যন্ত্র, তারাই আটকে দেবে ফাসিস্তদের।