কোনও হ্যাঁ বলছি, গুনছি, আমাদের সোর্স বলছে, হতে পারে, যদি, সমীক্ষা বলছে, তবুও ইত্যাদির ব্যাপার নেই, কালিগঞ্জে তৃণমূল প্রার্থী আলিফা আহমদ জিতবেন কম করে ৫০ হাজার ভোটে, তার কমে নয়, মিলিয়ে নেবেন। কংগ্রেস প্রার্থী এবারে জামানতটা বাঁচাতে পারবেন, আর সেটা কম কথা নয়। বিজেপি খুব বেশি হলে ৩০% ভোট পাবে, তার বেশি নয়। এটা হল গ্রাউন্ড রিয়েলিটি, আমি জানি, শুভেন্দু অধিকারী জানেন, মমতা ব্যানার্জী জানেন, সদ্য বিয়ে সেরে ফেরা মহুয়া মৈত্রও জানেন। তাহলে আলোচনাটা কিসের? আলোচনাটা হল কেন এই ফলাফল হবে? বা আরও সাধারণ ভাবে আলোচনার ক্ষেত্রটাকে বড় করে বলা যায়, কেন বাংলাতে এই ফলাফলটা হবে?
আলোচনায় আসছি তার আগে প্রচারের কথায় আসি। বিধানসভায় বিজেপি দলের নেতা কাঁথির খোকাবাবু আপাতত মহেশপুরে আগুন জ্বালাতে ব্যস্ত, দলের বাড় বাড়ন্তের আগুন, যে আগুনে শুদ্ধ হয়ে এক হিন্দু রাষ্ট্র তৈরি হবে সেই শিখা অনির্বাণ জ্বালাতেই তিনি ব্যস্ত। দলের দুধেভাতে রাজ্য সভাপতি সুকান্তবাবু একটা চোখ রেখেছেন শুভেন্দুর দিকে ও যাচ্ছে ভবানী ভবনে তো আমি যাবো কালীঘাটে, এরকম আর কি। আর তিন নম্বর ঘোড়া এখন তাঁর নিজস্ব পকেটে পকেটে চা খেয়ে বেড়াচ্ছেন, আর তাঁর হয়ে লড়ে যাচ্ছেন আরএসএস-এর প্রাক্তন সহকর্মীরা। হ্যাঁ, একজনের মুখে এও শুনলাম শুভেন্দু তো বাটি বাটি…। তারপর আর কিছু বললেন না, তাঁরা নাকি এর মধ্যে দিল্লিও গিয়েছিলেন এটাই বলতে যে দিলীপ ঘোষকে ফিরিয়ে আনুন না হলে ৫০ টা আসনও মিলবে না। তো সেটাই বিষয় আজকে, কালীগঞ্জে বিজেপি হারবে অন্তত ৫০ হাজার ভোটে।
আসুন ২০০৬ থেকে ঐ কালীগঞ্জের ফলাফলটা একবার দেখে নিই, তাতেই অনেক কিছু পরিস্কার হয়ে যাবে। এবং সেগুলো দেখার আগে জেনে নিন, এই কালীগঞ্জের ৯১.৪% মানুষ গ্রামে থাকেন। হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সবকটা সাধের প্রকল্পের লাভ এখানে পৌঁছয়। এই বিধানসভায় মুসলমান জনসংখ্যা ৫৮.১%, চোখ বুজে যার ৮০% যাবে মমতার দিকে, মানে প্রায় ৪৫% ভোট। হিন্দু জনসংখ্যা ৪১.৩৬% যার ৭০-৭৫% যাবে বিজেপির দিকে, মানে কমবেশি ৩০%। ঐ হিন্দু ভোটের ২০-২৫% যাবে তৃণমূলের দিকে। হিন্দু বলে নয়, এরা তৃণমূল বলে, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার পায় বলে, ৫০০ টাকা মাথা পিছু খরচ করে ৪০ জনের দল বাস নিয়ে দিঘা জগন্নাথ ধাম ঘুরে এসেছেন বলে, আর প্রবল বিজেপি বিরোধী ভোটারও আছেন বৈকি, তাঁরা চাঁদ বণিকের মতোই তৃণমূলকে পছন্দ না করলেও বিজেপিকে আটকাতে ঘাসফুলে ভোট দেন। শেষ ২০০৬-র বিধানসভাতে আরএসপি প্রার্থী এখানে প্রায় ৪৯% ভোট পেয়ে জিতেছিলেন। তারপর থেকে বিধানসভা বা লোকসভার ভোটে এই বিধানসভাতে তৃণমূলের ভোট বেড়েছে। ২০১১-র ৪৭% ভোট ২০২১-এ ৫৩% হয়েছে। লোকসভাতে এই কেন্দ্রে তৃণমূলের ভোট ২০০৯-এর ৪৬% থেকে ২০২৪-এ ৫২% হয়েছে। বিজেপির ভোট সর্বোচ্চ ২০২৪-র লোকসভাতে প্রায় ৩৬% ছুঁয়েছে। এটা উপনির্বাচন, বিজেপি ৩০% ধরে রাখতে পারলেই অনেক। সব মিলিয়ে ২২-২৩ % ভোটের ফারাক তৈরি হয়ে যাবে।
আরও পড়ুন: Aajke | মুখ্যমন্ত্রী পাকিস্তানের হয়ে কথা বলছেন? তো বাবাকে জানাচ্ছেন না কেন?
এবার আসুন ছোট্ট করে এটা কেন হচ্ছে সেটা একটু বুঝে নিই। আচ্ছা এই নির্বাচনের ইস্যু কী কী হবে? চাকরি দুর্নীতি, আরজি কর মামলা, ডিএ ইত্যাদি বাদ দিলে সবটাই ভেজা তুলো প্যাঁজা মেঘ। মানে শরৎ কালের রচনা আসলেই যা যা লেখা হত, তা হল ঐ তুলোর মত পেঁজা মেঘ আর নীল আকাশ ইত্যাদি, সেরকম কিছু ইস্যু যা চলছে চলবে। কিন্তু একটু মাথা ঘামালে বুঝতে পারবেন রাজ্যজুড়ে এমন কোনও সেন্ট্রাল ইস্যু আজ অবধি নেই, যা নাকি আজ বা ২০২৬-র নির্বাচনে বিরাটভাবে কাজ করবে। শুনতে খারাপ লাগলেও এবং সত্যি করেই গ্রাউন্ড লেভেলে তৃণমূল নেতা কর্মীদের এক বড় অংশে র্যামপার্ট দুর্নীতি থাকলেও তা নির্বাচনে কোনও প্রভাব ফেলে না আর সেটা আজ থেকে নয়। খেয়াল করে দেখুন ২০১৬ সাল, বিজেপির সদর দফতর মুরলিধর লেনে পর্দা টাঙিয়ে শোভন চ্যাটার্জী, শুভেন্দু অধিকারী, সৌগত রায়, ববি হাকিমকে সব্বাই দেখলেন হাতে করে টাকা নিতে, একজনও হেরেছিলেন? একজনও নয়। মানুষ আপাতত যেভাবে এটাকে দেখেন, তাকে এভাবেই বলা যায়।
নেতারা দুর্নীতি করবে, এ তাদের হক, করুন, আমরা হিসেব করব আমরা কী পেলাম। ওসব প্রতিশ্রুতির গাজর নয়, এক্কেবারে কড়ায় গন্ডায় নগদে, রেশনে, কী পেলাম? এটা হচ্ছে মানুষের প্রথম চাহিদা, আর সেই জায়গাতেই তৃণমূল বিরাটভাবে এগিয়ে। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বান্ধবীর বাড়ি থেকে কোটি কোটি টাকা পাওয়ার পরে, ইন ফ্যাক্ট প্রায় পুরো শিক্ষা দফতরকে জেলে ঢোকানোর পরে তৃণমূল জিতেছে, বিরাট ভাবেই জিতেছে, পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের আসনেই জিতেছে। আসলে মানুষ রাজনৈতিক নেতাদের দুর্নীতির বাইরে দেখার কথা চিন্তাও করে না। বাকি রইল ডিএ, রাজ্যের পেনশনার, স্কুল শিক্ষক, কর্পোরেশন, মিউনিসিপালিটি আর সরাসরি সরকারি কর্মচারি মিলিয়ে ৪% এর কিছু কম মানুষ এই ডিএ পান। তাঁরা কিন্তু কোনও দোদুল্যমানতায় ভোগেন না, এঁদের মধ্যে তৃণমূল সমর্থক ৪০-৪৫%, বাম কংগ্রেস বিজেপি সমর্থক ৫৫-৬০%। তাতে কি নির্বাচনের ফলে কোনও ফারাক পড়বে? আর ডিএ পায়না এমন লোকের কাছে তো ডিএ-টা ইস্যুই নয়। চলুন আরজি কর ইস্যুতে। রোজকার হেডলাইন ছেড়ে তা সপ্তাহে এক দিনও পাঁচ কি সাতের পাতাতেও জায়গা পাচ্ছে না, আর যত দিন যাবে তা আরও মলিন হবে।
এই উপনির্বাচনে এই আসনের সংখ্যালঘু ভোট উজাড় হয়েই পড়বে তৃণমূলের দিকে, কারণ আমাদের খোকাবাবু। তিনি তো সাফ জানিয়েই দিয়েছেন আমাদের দরকার নেই ঐ লুঙ্গি পরা লোকজনদের ভোট, চাইনা মুসলমানদের ভোট। লালুজির মতোই বলতে ইচ্ছে করছে, “নহি মাঙ্গা তো মিলেগা নহি”। না চাইলে ভোট পাওয়া যায়। তার মানে বিজেপি এই বিধানসভায় লড়াইটা শুরুই করেছে ৫৮% পিছন থেকে, ওনাদের আবেদন ৪২% মানুষের কাছে, এবং ওনারা জানেন যে খুব বেশি হলেও তার ৭০% পেতে কালঘাম ছুটে যাবে। তার মানে ৩০% ভোট, না তা দিয়ে বাংলার এই চূড়ান্ত মেরুকরণের পরে কোনও কেন্দ্রই জেতা যায় না।