এতক্ষণে সব্বাই জেনে গিয়েছেন যে, চাকা গড়ানোর ৫৯ সেকেন্ডের মাথায় বোয়িং ৭৮৭ আছড়ে পড়েছিল দেড় কিলোমিটার দূরে মেঘানি নগরে। ইন ফ্যাক্ট টেক অফ করার ৩১ সেকেন্ডের মাথায় প্লেনটি আছড়ে পড়ে বি জে মেডিক্যাল কলেজের ক্যান্টিনের উপর। ক্রু মেম্বার সমেত ২৪২ জনের একজন অবিশ্বাস্যভাবেই বেঁচে গিয়েছেন, কিন্তু ঐ ক্যান্টিনে যাঁরা খাচ্ছিলেন তাঁদের মধ্যে ৫ জন মেডিক্যাল ছাত্র মারা গিয়েছেন। ঘটনা ঘটার পর থেকে যে লোকজন কদিন আগেই মেঘালয়ের হত্যা নিয়ে ফেলুদা হয়ে উঠেছিলেন, তাঁরাই এখন বিমান বিশেষজ্ঞ। ফুয়েল ট্যাঙ্ক থেকে ফ্ল্যাপ, সবই বুঝিয়ে দিচ্ছেন, একেক জন একেক ধরণের কারণ নিয়ে মাঠে নেমে পড়েছেন, কারণ ঘটনা মানেই টিআরপি আর সেই টিআরপি বাড়াতে গেলে অনর্গল যা খুশি তাই বলতে হবে। আমরা আজ কিন্তু এক্কেবারে এই দুর্ঘটনা নিয়ে আলোচনা করতে বসিনি। বরং ক্রমাগত ঘটতে থাকা রেল, ট্রেন, দুর্ঘটনার কারণগুলো নিয়ে কথা বলতে এসেছি। এবং একটা কমন ফ্যাক্টর তো আছেই। সেই কমন ফ্যাক্টর হল রাষ্ট্র যাত্রী সুরক্ষা, যাত্রী সুবিধা ইত্যাদি থেকে হাত তুলে নিয়েছে। সেসব চলে গিয়েছে বা যাচ্ছে প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর হাতে। তো প্রাইভেট কোম্পানিগুলো কি আকজের নয়? তাহলে বোয়িং নির্মাতা কোম্পানি নিয়েই তো প্রশ্ন করতে হয়। সব কিছুই কি রাষ্ট্র করবে? করতে পারবে? না পারবে না। তাহলে সমস্যাটা কোথায়?
সমস্যাটা হল এই আহমেদাবাদ সমেত দেশের ৬টা এয়ারপোর্টকে প্রাইভেট কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া হবে তা ঠিক হয়েছে ২০১৯-এ। সেই ২০১৯ সালেই আদানি তাঁর কোম্পানি খুলল। ‘Adani Airport Holdings Limited is a Public incorporated on 02 August 2019. It is classified as Non-govt company and is registered at Registrar of Companies, Ahmedabad. Its authorized share capital is Rs. 100,000,000 and its paid up capital is Rs. 100,000.’- রেজিস্টারার অফ কোম্পানিস থেকে এই তথ্য পাওয়া গেল। ২০১৯ আগস্ট মাসে এই কোম্পানি তৈরি হয়েছে, আহমেদাবাদে নথিভুক্ত হয়েছে। ডিরেক্টর রা হলেন Jugeshinder Singh, Karan Gautam Adani, Malay Ramesh Mahadevia, এর মধ্যে করণ আদানি হলেন Chief Executive Officer of Adani Ports & SEZ Limited। এবং কোম্পানি খোলার মাস ছয়ের মধ্যেই তারা আহমেদাবাদ সমেত ৬ টা এয়ারপোর্টের মেনট্যানান্স এর ভার পেয়েও গেল। আদানি গ্রুপ এরপর নতুন টেন্ডারে অংশ নিলেন। মুম্বই ছত্রপতি শিবাজী ইন্টারন্যাশন্যাল এয়ারপোর্টের দেখরেখের দায় ছিল জিভিকে-র উপর। তাদের ৫০.৫ % শেয়ার নিল আদানি এয়ারপোর্ট হোল্ডিংস লিমিটেড, এয়ারপোর্ট কোম্পানি অফ সাউথ আফ্রিকা আর সাউথ আফ্রিকার ই-বিডভেসট গ্রুপের হাতে থাকা ১০ আর ১৩.৫ % শেয়ারও আদানিদের হাতে। মানে মোট ৭৪% শেয়ার হাতে নিয়ে তারাই এখন দখলদার ছত্রপতি শিবাজী এয়ারপোর্টের। যদিও এই শেয়ার হস্তান্তরণ নিয়ে কিছু আন্তর্জাতিক আইনী জটিলতা ছিল, ওসব আদানি মিটিয়ে নিয়েছে, মাথার উপর কার হাত রয়েছে সেটা একবার ভাবুন। ২০১৯-এ কোম্পানি তৈরি হল, একবছর যেতে না যেতেই তারা দেশের মুম্বই সমেত সাতটা এয়ারপোর্টের দখলদার, তারাই দেখরেখ করবে।
এখন এই দেখরেখ বলতে কী বোঝায়? কাগজপত্র বলছে, ‘When Adani company is awarded the maintenance charges for Ahmedabad airport, it means they are responsible for the upkeep, operation, and improvement of the airport’s infrastructure and services. This includes tasks like cleaning, repairing, upgrading facilities, and ensuring a smooth passenger experience. Adani will be responsible for maintaining the airport’s physical infrastructure, including runways, taxiways, terminals, and other facilities.’ মানে কী? মানে হল ওই এয়ারপোর্টের রানওয়ে, ট্যাক্সিওয়ে, টার্মিনাল এর মেইনট্যানান্স-এর দায়িত্ব কিন্তু আদানির। আর সেখানে সামান্যতম গাফিলতি থাকলে এক ধাক্কায় ২৫০, ৩০০, ৪০০ মানুষের মৃত্যু হতে পারে। হ্যাঁ, সেরকম একটা কাজের দায় তাদের দেওয়া হয়েছে যাদের একটা বিমানবন্দর চালানোর অভিজ্ঞতাও ছিল না।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | মোদিজির ১১ বছর, পুরোটাই নির্ভেজাল মিথ্যে, জুমলাবাজি
টাটা কোম্পানির হাতে ছিল ১৯৩২-এ শুরু করা টাটা এয়ারলাইন্স, কাজ শুরু করেছিল ১৯৪৬-এ। ১৯৫৩-তে এই কোম্পানিকে এয়ার ইন্ডিয়া নাম দিয়ে রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়। ইন্ডিয়ান রেলওয়ে আর এয়ার ইন্ডিয়া তারপর থেকে দেশের লাইফ লাইন। একটা সময়ের পরে এই এয়ার ইন্ডিয়াকে চেষ্টা করে রুগ্ন বানানোর কাজে হাত দেয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের এক অংশের নেতারা। মজার কথা হল, সেই দলে কিন্তু বিজেপি ছিল না, বিজেপি প্রবলভাবেই এয়ার ইন্ডিয়ার রাষ্ট্রীয়করণের পক্ষে ছিল, এমনকি অটল মন্ত্রীসভার জর্জ ফার্নান্ডেজের নেতৃত্বে এয়ার ইন্ডিয়ার রিভাইভাল প্ল্যান তৈরির কথা চলছিল। তারপর এয়ার ইন্ডিয়াকে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়, আর শেষ পর্যন্ত এই মোদিজির জামানায় যখন সবই নিচ্ছে আদানি, আম্বানি তখন এক মহা ব্যতিক্রম হিসেবেই এয়ার ইন্ডিয়া তুলে দেওয়া হল টাটাদের হাতে। তখন টাটাদের হাতে প্যাসেঞ্জার নিয়ে প্লেন চালানোর কোন অভিজ্ঞতা আছে? কেন তাঁদের দেওয়া হল? কোন মহান কাজের জন্য? টাটারা খুব মহান? এরকম একটা ছবি দেখানোর চেষ্টা তো হয়েই থাকে। এমনকি এই দুর্ঘটনার পরেই যাত্রী পিছু ১ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দেবার কথাতেও কেউ কেউ জয়ধ্বনী দিচ্ছেন। যাঁদের অনেকেই আরজি করে ডাক্তারের ধর্ষণ মৃত্যুর পরে মূখ্যমন্ত্রীর ক্ষতিপূরণের ঘোষণার পরে বলতে শুনেছিলাম কি আনসেনসেটিভ, ছিঃ। সেই তাঁরাই টাটা দিয়েছে এক কোটি, কি আননন্দ। তো, সত্যিটা কী? অরূপ চক্রবর্তী কাউন্সিলর লিখেছেন, শোনাচ্ছি, “রতন জি কে নিয়ে শুরু হয়ে গেছে রোমান্টিসিজম। Air India দুর্ঘটনার পর টাটা গ্রুপ মৃতদের পরিবারকে ১ কোটি টাকা করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ব্যাস দুর্ঘটনার মৃত্যু মানুষগুলোকে ভুলে রতন প্রেমীরা আবেগে বাঁচতে শুরু করেছে। কারও কারও চোখে জল এসে গিয়েছে।
চলুন একটু হিসাব করি। Air India-এর যে ফ্লাইটটি দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে, সেটি ছিল Boeing 787-8 Dreamliner। এই ধরনের একেকটি বিমানের দাম প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। কিন্তু বিমানের দাম যতই হোক, প্রতিটি এয়ারলাইন্স বিমানের উপর বিমা করে রাখে, আর সেই বিমার টাকাতেই দুর্ঘটনার ক্ষতি সামলানো হয়। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নিশ্চয় হয়নি। এই বিমানের বিমা, যাকে বলা হয় ‘Hull Insurance’, তা প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ মিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ ১,৬০০ থেকে ২,৫০০ কোটি টাকার মতো। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের ক্ষেত্রে প্রতিটি যাত্রীর জন্যও আলাদা বিমা থাকে। সেটিও কম নয়, সব মিলিয়ে প্রায় ৪,০০০ কোটি টাকারও বেশি। এখন যদি আমরা দেখি, ২৪১ জন যাত্রী মারা গেছেন, এবং যদি প্রত্যেক পরিবারকে ১ কোটি টাকা করে দেওয়া হয়, তাহলে সবমিলিয়ে খরচ পড়ে ২৪১ কোটি টাকা, যা বিমা থেকেই আসবে। অর্থাৎ এই ক্ষতিপূরণ আসলে কোনও দয়াদাক্ষিণ্য নয়, এটা বিমা কোম্পানির কাছ থেকে পাওয়া যাবে। এটুকু দেওয়াটা বাধ্যতামূলকই। মেরা ভারত মহান, মেরা আদানি আম্বানি আরও মহান, মেরা টাটাজি ভি মহান, এছাড়া তো আর কিছু বলার নেই।
অভিযোগ তো উঠেছে সস্তার পরিত্যক্ত যন্ত্রাংশ দিয়ে তৈরি হয়েছে বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার। একেকটি বিমানে অন্তত ৫৩টি এমন যন্ত্রাংশ রয়েছে, যার গুণমান নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। তড়িঘড়ি অর্ডার সাপ্লাইয়ের চক্করে বিধিবদ্ধ প্রক্রিয়ায় বিমানটি তৈরি করা হয়নি। ইঞ্জিন কিংবা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশের সঠিক প্রক্রিয়া মেনে মেরামতি কিংবা রক্ষণাবেক্ষণের তেমন সুযোগ এতে নেই। বিমানের ইমার্জেন্সি সিস্টেম ঠিক ভাবে কাজ করে না। আপাতকালীন পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে চার বারের মধ্যে অন্তত একবার এই বিমানের মুখ থুবড়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। খোদ বোয়িং সংস্থার পরীক্ষা নিরীক্ষাতেই ড্রিমলাইনার বিমানটি বহুবার পাশ করতে পারেনি। এই বিষয়ে আমেরিকার সাউথ ক্যারোলাইনার বোয়িং কারখানার শ্রমিক জন বার্নেট মুখ খোলায় ২০২৪-র মার্চে তাঁর রহস্যজনক মৃত্যু হয়। তাঁরই মতো নাছোড়বান্দা আরেক বোয়িং শ্রমিক রিচার্ড কুয়েভাস গত বছর সংবাদমাধ্যমকে জানান, বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার বিমানটির আগাগোড়া নকশাতেই নাকি গণ্ডগোল আছে। নিরাপত্তার কোনও নিয়মবিধি মেনে এই বিমানকে তৈরি করা হয়নি। তিনি জানান, এর ফলে উড়ানের সময় তা বেশ বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। এই বিষয়টি বোয়িং কর্তৃপক্ষকে জানালে তারা অভিযোগ উড়িয়ে দেয়। এ নিয়ে জানাজানি হলে কুয়েভাসকে রীতিমত প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়।
২০১১-এ প্রথম বারের জন্য বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার বিমানটি এয়ার ইন্ডিয়ার জন্য আমদানি করা হয়। তখন সংস্থাটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ছিল। ২০১৭ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত এই বিমানের যাত্রী নিরাপত্তা সংক্রান্ত ত্রুটি নিয়ে দুনিয়া জুড়ে একাধিক অভিযোগ ও বিতর্ক ওঠে। মামলায় দায়ের করা হয় বিভিন্ন দেশে আদালতে। একাধিক দেশে ড্রিমলাইনার বিমান নিষিদ্ধ পর্যন্ত করা হয়। এরই মধ্যে ২০২২- এয়ার ইন্ডিয়ার মালিকানা টাটার হাতে তুলে দেওয়া হয়। এয়ার ইন্ডিয়ার ‘বদনাম’ মুছে, তাকে নতুন রূপ’ দিতে ২০২৫-এ বেশ কয়েকটি পুরনো বিমানে নতুন রং চাপিয়ে, তাতে ঝাঁ চকচকে রূপ দিতে প্রায় ৪০ কোটি টাকা ব্যয় করার ঘোষণা করে টাটা। নির্দিষ্ট ভাবে বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার বিমানের সংখ্যা বাড়ানো হবে, তাতে নতুন আসবাব যোগ করা হবে এবং পরিষেবা আরও উন্নত করা হবে বলে জানানো হয়। এদিকে দেশে দেশে এই বিমান কতটা নিরাপদ তা নিয়ে আদালতে মামলা চলছে! “বেসরকারি হলে পরিষেবা ভালো হয়,” এই যুক্তি দিয়ে বছর দুয়েক আগে দেশের ফ্ল্যাগশিপ এয়ারলাইন্স’-র তোফা টাটার হাতে তুলে দেন মোদিজি। এয়ার ইন্ডিয়াকে সরাসরি বেসরকারি মালিকানায় তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তকে ‘মাস্টার স্ট্রোক’ বলে আখ্যা দিয়ে বসল গোদি মিডিয়া। প্রায় সত্তর বছর সরকারি মালিকানায় ‘ধুকতে থাকা’ এয়ার ইন্ডিয়া বেসরকারি মালিকানায় ফেরায় তার খোলনলচে পাল্টে যাবে বলে ঢালাও প্রচার শুরু করে কর্পোরেট মিডিয়া। বিশ্বের শীর্ষ বিমান সংস্থাগুলিকে এবার এয়ার ইন্ডিয়া সরাসরি টেক্কা দেওয়ার ক্ষমতা রাখবে বলেও দাবি করা হলো। বৃহস্পতিবারের ঘটনায় এআই-১৭১’র সঙ্গে মোদির ‘মাস্টার স্ট্রোক’-ও মুখ থুবড়ে পড়েছে। কিন্তু নিশ্চিন্ত থাকুন, কদিন পর থেকেই এই মিডিয়া আপনার জন্য নতুন উত্তেজনার থলি নিয়ে মাঠে নামবে। আপনি ভুলেই যাবেন ২৬ টা প্রাণের কথা। যাদের হারাল, তাঁদের হারাল। আবার একটা দুর্ঘটনা হবে, তখন আবার নতুন খোরাক নিয়ে হাজির হবে গোদি মিডিয়া। এভাবেই দেশ চলছে।