বিশ্ববন্দিত বাঙালি পরিচালক সত্যজিৎ রায়, ২ মে তাঁর জন্মদিন। তাঁর প্রতি আমার স্মৃতিচারণা।
পেশায় আমি লেখক নই। তবে তিন দশকের বেশি সময় ধরে চিত্র-সাংবাদিকতা করছি। সেই সূত্রেই মাঝেমধ্যে আলো-আঁধারির পাশাপাশি কলম নিয়ে আঁকি-বুকি কেটেছি। এই পেশায় আসার একেবারে প্রথম পর্বে পেশাগত কারণে বিশ্ববরেণ্য কিংবদন্তি বাঙালি চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়কে বেশ কয়েকবার অন্তরঙ্গভাবে দেখার সুযোগ এসেছিল। তাঁর সঙ্গে প্রতিটি সাক্ষাত আজও স্মৃতিপটে অমলিন হয়ে রয়েছে।
আরও পড়ুন:মহারাজা তোমারে সেলাম
উপমহাদেশের এই বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা বাংলা চলচ্চিত্রকে শুধু নতুন দিগন্তের দিশা দেন নি,নিয়ে গিয়েছিলেন অন্য উচ্চতায়। চলচ্চিত্রপ্রেমিরা সে কথা বিনম্রভাবে স্বীকার করে নিয়েছেন ।
মনে আছে, ১৯৮৫ সালে তাঁকে ‘সোভিয়েত ল্যান্ড নেহেরু পুরস্কার’ দিয়ে সম্মানিত করেছিল সাবেক সোভিয়েত সরকার। সেই প্রথম বিশপ লেফ্রয় রোডে তাঁর বাড়িতে ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলাম। জীবিতকালে যারা তাঁর বাড়িতে গেছেন জানেন পুরনো দিনের এই বাড়িতে তাঁর ড্রয়িং রুমে ঢোকার জন্য বিরাট দরজাটি তিনি সবসময় নিজেই খুলে দিতেন কেউ এলে। এমনকি ল্যান্ডলাইনে ফোন করলে তিনি নিজেই সেই ফোন তুলতেন। পুরনো দিনের লিফট, কাঠের সিঁড়ি। বাড়ির অন্দরমহলে ঢোকার অন্যদিকে আর একটি দরজা আছে।
দরজার বাইরে আমি ছাড়া সেদিন আরও দু-তিনজন অল্পবয়সী মেয়ে অপেক্ষা করছিল। দেখে মনে হলো তারা কলেজ ছাত্রী। আমি তাদের জিজ্ঞাসা করলাম, আপনারা!
লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ থেকে তারা এসেছেন। কারণ, সত্যজিৎবাবু কলেজের বিশেষ পত্রিকা সংখ্যায় একটি লেখা দেবেন বলেছেন। এরমধ্যেই বিশালাকার সেই দরজা খুলে বিরাট মাপের মানুষটি আমাদের মুখোমুখি। তাঁকে এক হাতের দূরত্বে দেখতে পেয়ে স্বভাবতই আমরা সকলেই কয়েক মুহূর্তের জন্য বাকরুদ্ধ। তাঁর স্বাভাবিক ব্যারিটোন ভয়েজে জিজ্ঞাসা করলেন ‘আপনারা কারা’। নিজেদের পরিচয় দেবার পর উনি ছাত্রীদের জানালেন লেখাটা এখনো রেডি হয়নি। দু-তিনদিন পরে ফোন করবেন। ছাত্রীরা চলে যাবার পরেও আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিনি বললেন ‘আপনি!’ উনি ভেবেছিলেন আমি ওদের সঙ্গে গিয়েছি।
বললাম, আমি ‘সোভিয়েত দেশ’ চিত্র-সাংবাদিক। তারপর তিনি সাদরে আমাকে তাঁর ড্রয়িং রুমে বসতে বললেন। তাঁর ড্রয়িং রুমে যারা গেছেন তারা জানেন চারিদিকে শুধু বই এবং নিজের আঁকা কিছু ড্রইং এলোমেলো ছড়িয়ে রয়েছে। এমনকি সোফার উপরেও এলোমেলো প্রচুর বই। আমাকে বললেন ওগুলো একটু সরিয়ে বসুন। কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখলাম সে ঘরের দক্ষিণ দিকের বিরাট জানলা দিয়ে যেন সৃষ্টির বাতাস বইছে। উনি সব সময় একটি বিশেষ চেয়ারে নিজস্ব কায়দায় ফুটরেস্টে পা তুলে বসতেন। ঘরের দেওয়ালে দেখলাম বিশাল একটি মানচিত্র। বিভিন্ন দেশের পাশে ছোট ছোট কিছু হাতে লেখা। দেখে মনে হল বিভিন্ন তারিখ লেখা। সম্ভবত তাঁর বিদেশ ভ্রমণের দিনক্ষণ। তাঁর মৃত্যুর পর থেকে সে ঘর বন্ধ থাকে। তবে বছর দুয়েক আগে সেই ঘরে আর একবার আমার ঢোকার সৌভাগ্য হয়েছিল। আজও সেঘর একই রকম আছে। পুরনো বই-আসবাবপত্র বিশেষ করে সেই চেয়ারটির দিকে তাকিয়ে তাঁকে যেন মানসচক্ষে দেখতে পাচ্ছিলাম। তবুও বিরাট এক শূন্যতা। সেই শূন্যতারই ছবি তুলেছিলাম সেদিন।
ফটো: অরণ্য সেন