আহে নীলশৈল, প্রবল মত্ত বরণা। হে নীল পাহাড়ের বাসিন্দা, আমার দুঃখের পদ্মবন ধ্বংস করার জন্য আমি তোমার কাছে প্রার্থনা করি। গভীর জলে হাতির রাজা যখন তোমাকে ডেকেছিল, তুমি চক্র পাঠিয়ে তাকে কুমির থেকে রক্ষা করেছিলে। গভীর বনে হরিণী কষ্ট পাচ্ছিল, তুমি তাকে বিশাল বিপদ থেকে রক্ষা করেছিলে। কুরু সভায় দ্রৌপদী তোমাকে ডেকেছিল, তুমি তাকে অসীম বস্ত্র পাঠিয়ে তার সম্মান রক্ষা করেছিলে। রাবণের ভাই বিভীষণ তোমার আশ্রয় চেয়েছিল, তুমি তাকে শুধু আশ্রয়ই দাওনি, লঙ্কার রাজাও করেছিলে। প্রহ্লাদের পিতা ছিলেন নিষ্ঠুর, দুষ্ট মানুষ, তুমি স্তম্ভ থেকে বেরিয়ে তাকে ছিন্নভিন্ন করেছিলে। সালাবেগ বলেন, আমি জন্মে যবন। তোমার পদ্মপায়ে আমার বার্তা শোনো।
বোঝাই যাচ্ছে এক ভক্তের বন্দনা। এর আদত লেখাটা ওড়িয়া ভাষায় এক জগন্নাথ বন্দনা। হ্যাঁ, একটা সময় পর্যন্ত এমনকী ওড়িশাতেও ব্রাহ্মণদের কথাই ছিল শেষ কথা, তাঁরা ব্যবহার করতেন সংস্কৃত ভাষা, কিন্তু একটা সময়ের পরে তার জায়গা নেয় ওড়িয়া কথ্য ভাষা, লেখা হতে থাকে নানান ভজন কীর্তন আর সে সবই ছিল ওড়িয়া ভাষায়, তারমধ্যে অন্যতম হল এই আহে নীলশৈল, প্রবল মত্ত বরণা। এ পর্যন্ত শুনে ভাবছেন আমাদের আজকে-তে এ নিয়ে কেন কথা বলছি? সেটা কি এইজন্য যে আমাদের রাজ্যে এক বিশাল জগন্নাথ মন্দির স্থাপন হয়েছে? মমতা ব্যানার্জি নিজেই তা উদ্বোধন করেছেন খানিকটা মোদিজির রাম মন্দির উদ্বোধনের মতো? না সেই কারণে নয়, ঠিক এই সময়ে যখন ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে মূর্খ বা তস্য মূর্খ সাংবাদিকেরা বা বিজেপি আইটি সেল পাঠ পড়াচ্ছে, ধর্ম নিরপেক্ষতা এখন এক সফিস্টিকেটেড গালিগালাজ হয়ে উঠেছে, সেই সময়ে এই আহে নীলশৈল নিয়ে আলোচনা হওয়াটা খুব খুব জরুরি। কারণ এই ভজন লিখেছিলেন এক মুসলমান মানুষ, সালাবেগ, হ্যাঁ লালবেগের ছেলে সালাবেগ, যাঁর সমাধিস্থলের পাশে এসে ৫ মিনিটের জন্য জগন্নাথের রথকে দাঁড় করানো হয় আজও। সেটাই আজ আমাদের বিষয় আজকে, জয় জগন্নাথ।
ভগবান জগন্নাথ, তাঁর ভাই বলভদ্র এবং বোন সুভদ্রার পুজো হয় পুরীর মন্দিরে, যা অনেকের মতে হিন্দুদের চারধামের মধ্যে একটা, আর তাই এটা হিন্দুদের পবিত্র তীর্থস্থান। কিন্তু কী আশ্চর্যভাবেই এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক যবন, এক মুসলমান ভক্ত সালাবেগের কাহিনি। না, সালাবেগ তাঁর ধর্ম ত্যাগ করেননি, তিনি তাঁর ধর্মে থেকেই জগন্নাথের ভক্ত হয়েছিলেন, কবিতা লিখেছিলেন, যার মধ্যে বেশ ক’টা এখনও গাওয়া হয় ওড়িশাতে।
ভাই বলভদ্র পথ দেখান।
মাঝখানে আসেন,
সুন্দর চাঁদমুখের বোন,
কোলাহলপূর্ণ জনতার সাথে মিশে যান।
‘অন্ধকার’ পিছনে পিছনে আসে।
সালাবেগা বলে, আমি একজন যবন।
আরও পড়ুন: Aajke | বাঙালি আর কতদিন চুপ করে সবকিছু সহ্য করবে?
অনুমান করা হয় সালাবেগের জন্ম ১৭ শতকের গোড়ার দিকে। তিনি একজন মুসলিম পিতা এবং ব্রাহ্মণ মায়ের পুত্র ছিলেন,ভুবনেশ্বরের আঞ্চলিক শিক্ষা ইনস্টিটিউটের ইতিহাসের অধ্যাপক প্রীতীশ আচার্য এই কাহিনি বলেছেন। ‘ইমপ্যাক্ট অফ ইসলাম অন ওড়িশা কালচার’ বইয়ের লেখক মুহাম্মদ ইয়ামিন তাঁর একটি প্রবন্ধে মির্জা নাথনের বাহারিস্তান-ই-গালিবি এবং রামদাসের দণ্ড্যতাভক্তি রসামৃত থেকেও তিনি দেখিয়েছেন সালাবেগের জীবন কাহিনি। খুব ছোট্ট করে বলি? সালাবেগের বাবা জাহাঙ্গির কুলি খান বা লালবেগ ১৬০৭ থেকে ১৬০৮ সাল পর্যন্ত বাংলার সুবেদার ছিলেন। এক সামরিক অভিযানে দণ্ডমুকুন্দপুরে এক তরুণী বিধবা ব্রাহ্মণ নারীকে দেখে, তার যৌবনের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে লালবেগ তাকে অপহরণ করেন। তিনি তাঁর প্রেমে পড়েন এবং পরে তাঁকে বিয়ে করেন। তাঁদের একমাত্র পুত্র ছিলেন সালাবেগ। এদিকে সালাবেগের মা ছিলেন জগন্নাথের ভক্ত। আবার তিনি তাঁর নতুন জীবনেও সুখী ছিলেন। সালাবেগ বড় হওয়ার পর তিনিও বাবার সঙ্গেই যুদ্ধে যান আর সেখানেই এক লালবেগ নিহত হন এবং সালাবেগ গুরুতর আহত হন। বলা হয় তাঁর মা জগন্নাথের কাছে প্রার্থনা করেন এবং সালাবেগ সুস্থ হয়ে ওঠেন। এই ঘটনা সালাবেগকে প্রভু জগন্নাথের ভক্ত করে তোলে। কাজেই খানিক কৃতজ্ঞতার বশেই তিনি পুরীতে তাঁকে দর্শন করতে যান। কিন্তু দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে অবিশ্বাসের কারণে পুরোহিতরা সালাবেগকে মন্দিরে প্রবেশ করতে দেননি। কাজেই উপায় না দেখে তিনি বার্ষিক রথযাত্রার জন্য অপেক্ষা করেন, যেখানে প্রভু জগন্নাথ, দেবী সুভদ্রা এবং প্রভু বলভদ্রকে বিশাল রথে করে বড় দণ্ডে নিয়ে আসা হয়, রথযাত্রার সময় ছিল তাঁর জগন্নাথ দর্শন। সেই দর্শনের জন্য তিনি একটা ছোট্ট কুটির তৈরি করেন, সেখানেই থাকা শুরু করেন, রথযাত্রা শেষ হলেই তিনি বেরিয়ে পড়তেন দেশ থেকে দেশান্তরে।
এক বছর তিনি বৃন্দাবন থেকে কুটীরে ফিরতে দেরি করেন, কারণ পথে তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। বুঝতে পেরেছিলেন যে তিনি রথযাত্রার সময় পুরীতে পৌঁছতে পারবেন না, তাই তিনি প্রভু জগন্নাথের কাছে প্রার্থনা করেন যেন তিনি তার কুটীরে না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। এদিকে জগন্নাথের রথ সালাবেগের কুটীরের কাছে পৌঁছনোর পর থেকে তাকে এক ইঞ্চিও নাড়ানো যাচ্ছে না। হাতিরাও রথ ঠেলার চেষ্টা করে ব্যর্থ। নাকি সাত দিন ধরে সেই জায়গায় আটকে থাকে রথ, শেষে সালাবেগ আসেন। এবার কেউ তাকে প্রভুর কাছে যেতে বাধা দেয়নি। তিনি গিয়ে দর্শন করেন এবং পুজো করেন। তিনিই জগন্নাথের একমাত্র ভক্ত যাঁর সমাধি তাঁর রথ যে পথে দিয়ে যায় সেই পথে অবস্থিত আর রথ তাঁর সমাধির বাইরে পাঁচ মিনিটের জন্য এখনও থামানো হয়। হ্যাঁ যখন সারা দেশে হিন্দু-মুসলমান, হিন্দু-মুসলমান বিভাজনের হাওয়া সেই সময়ে প্রত্যেকের জানা উচিত এক মুসলমানও ছিলেন জগন্নাথের ভক্ত যাঁর সমাধির সামনে এখনও রথ দাঁড়ায়। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম যে দেশে প্রভু জগন্নাথ দাঁড়িয়ে যান তাঁর মুসলমান ভক্তের সমাধির কাছে, সেই দেশে ধর্ম নিয়ে কেন এত বিভেদ? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
আসলে এসবই পুরোহিতত্বের অবসান ঘটিয়ে এবং ঈশ্বরের সাথে সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমেই হিন্দু ধর্মের সংস্কারের লক্ষ্যে কবীর, নানক, মীরাবাই এবং তুলসীদাসের মতো কবি ও লেখকদের মতোই সালাবেগের রচনাও ছিল সেই পথের পথিক। সপ্তদশ শতাব্দীর ভক্তি সাহিত্য ছিল পুরোহিতদের মধ্যস্থতা ছাড়াই ঈশ্বরের কাছে পৌঁছনোর পথ। সেই পথের কথাই অনেক পরে নজরুল বলেছিলেন,
বলতে পারিস, বিশ্ব-পিতা ভগবানের কোন সে জাত?
কোন ছেলের তার লাগলে ছোঁয়া অশুচি হন জগন্নাথ?
নারায়ণের জাত যদি নাই
তোদের কেন জাতের বালাই?
তোরা ছেলের মুখে থুথু দিয়ে মার মুখে দিস ধূপের ধোঁয়া॥
জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াৎ খেলছ জুয়া!
ছুঁলেই তোর জাত যাবে? জাত, ছেলের হাতের নয় তো মোয়া।